-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
৩৫
আকাশটা
কি অপূর্ব রঙ ধারণ করেছে।
আকাশী আর কমলা মিলে আলো ছড়াচ্ছে পৃথিবীতে।
অস্তগামী সূর্যের কমলা রঙে পুকুরের অপর পাড়ের গাছপালাগুলো অবর্ণনীয় রূপ ধারণ করেছে।
শীলা মুগ্ধ হয়ে দেখে।
কদিন আগে একটা গল্পে কনে দেখা আলোর কথা পড়েছিল।
আম্মার কাছে জানতে যাইলে বলেছিলেন শেষ বিকেলে শরৎ হেমন্তে কখনও কখনও মিষ্টি একটা আলো তৈরি হয় যে আলোয় সাধারণ একটা মেয়েও অসাধারণ অপরূপ দেখায়।
শীলার মনে হচ্ছে আজকের আলোটা যেন তেমনই।
বাগিচার ঘন জড়ানো গাছের পাতাগুলো যেন আলোকস্নান করছে।
শীলার মনে পড়ল রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটা কলি- আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে।
আশ্চর্য গাছে
গাছে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো
পর্যন্ত এ সূর্যস্নানে বর্ণময়
হয়ে উঠেছে। আম্মাকে
যদি ডেকে আনা যেত-
আম্মা বলতে পারত। কিন্তু
আম্মা তো এ সময়ে
বৈঠকখানা বাড়ির পুকুরঘাটে আসবেন
না। মেয়েরা এলেও
বৌরা আসতে পারে
না।
একমনে আলোর
নাচন দেখতে দেখতে চোখের
সামনে ধীরে ধীরে আলো নিভে
আসে। পাতলা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়ে। অমনি
বাদুড়গুলো পাখা ঝাপটা দিয়ে
আকাশ কালো করে উড়তে
শুরু করে। কোথায়
কতদূরে ওদের যাত্রা শুরু
হল কে জানে। তরুণী
শীলার মনে পড়ে বাদুড়কে
উড়তে দেখলে ছোটবেলায় তারা
দল বেঁধে বলত – কলা বাদুড়ের
ছা, মামার দেশে যা,
একটা কলা তুই খাইস,
আরেকটা আমারে দিস।
মসজিদের পুকুরপাড়ে
সোনালু গাছটাতে হলুদ সোনালু
ফুল ফুটে আলো হয়ে আছে। সোনালুর ঝুরি নেমে এসেছে। হাত বাড়ালেই ধরা যায়। শীলা ডাকল রুবী আর নীরুকে, "আয় আমরা
ফুল পাড়ি।"
তারপর হঠাৎ মনে পড়ে রুবীরতো
অসুখ আছে। ফুল পাড়তে
গেলে যদি হঠাৎ ওর অসুখ
উঠে যায়। তখনও
ওরা জানতনা এই রোগটাকে
মৃগী বলে।
সমবয়সী এই বোনটি অসম্ভব ভালবাসত শীলাকে।
অন্যরা ওর সাথে তেমন মিশত না।
অসুখের কারণে ওরও অনেকসময় মেজাজ ভাল থাকত না।
মাকে হারিয়েছিল ছোটবেলায়।
পৃথিবীতে শীলাই তার একমাত্র বন্ধু।
বড় হয়ে শীলা
যখন হোস্টেলে চলে গেল তখন বাড়ি
এলে রুবী ছায়ার মত তার সাথে
লেপ্টে থাকত। সুখ-দুখের
সব কথা বলত। তার যে কোনদিন
বিয়ে হবে না এটা সে বুঝে
গিয়েছিল। শিশুদের প্রতি
অন্যরকম একটা আকুলতা ছিল। দিনে দিনে অসুখ বেড়ে
যাওয়াতে কেউ ওর কোলে
বাচ্চা দিতে চাইত না। একেকসময় এমন করে বাচ্চাদের
দিকে তাকাত তারপর একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত তোর বাচ্চা
হলে কিন্তু আমার কোলে
দিবি। শীলা ঘাড় নেড়ে
বলত আচ্ছা।
অথচ ভাগ্যের এমন পরিহাস
শীলার বিয়ের আগেই আগুনে
পুড়ে রুবীর মুখের বাঁ দিক চোখসহ
ঝলসে গেল। সুন্দর
মুখটা কেমন হয়ে গেল। সবসময় মুখের পাশটা বড় ঘোমটায়
ঢেকে রাখত। তারপর
যখন মহুল হলো ও হাত বাড়িয়ে
কোলে নিতে গেলে বাচ্চাটা একটু ভয় পেয়ে যেত।
তারপর একদিন সকাল বেলায়
হঠাৎ ফোনটা ঝনঝনিয়ে বাজতে
শীলা ছুটে গেল- "কার ফোন?"
নীরু ফোন করেছে-
"রুবি আপা পানিতে
ডুবে মারা গেছে"
বলতে বলতে ডুকরে কান্না। শীলার বুকটা সেদিন পাথর
হয়ে গিয়েছিল। এমন প্রিয়
বন্ধু সে কি আর এ জীবনে
পাবে? ক্ষুদ্র এ জীবনে
এত বিচ্ছেদ কেন?
"মা, তুমি
এত কি ভাবছ? ভাতের
মাড়তো শুকিয়ে গেছে। মাড় ফেলবে
না।"
"হ্যাঁ,
হ্যাঁ। ফেলব তো। কাঠি দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে
নিজেই আফসোস করল, ইস আজ গলাভাত খেতে হবে। নাকি
আর কটা চাল ধুয়ে
চড়িয়ে দেব।"
"কী দরকার
মা। একদিন গলাভাত
খাওয়া কোন ব্যাপার। ডাল মেখে
খেতে ভালই লাগবে।"
"কিন্তু
তোর বাবার তো কষ্ট
হবে।"
"বাবার আরও বেশি
কষ্ট হবে তুমি তাঁর
জন্য নতুন করে ভাত রাঁধলে। তুমি কি এটা এত দিনেও
বোঝনি মা!"
"থাম পাক্কু
মেয়ে। বেশি পাকামো
করিস না।"
"সত্যি
কথা বললে পাকামো হয় বুঝি?
জানতাম না। কিন্তু
তুমি কি ভাবছিলে বললে
না তো।"
"কী আর ভাবব? অতীত ভাবছিলাম।"
"এবার সুবর্ণগ্রাম
থেকে ফিরে এসে তুমি
বড্ড বেশি নস্টালজিক হয়ে পড়েছ
মা।"
"আসলেই তাই। বাবার মৃত্যুর পর এবারই
প্রথম গেলাম তো। বহুদিন
পর সবাইকে দেখে ঘুমে
জাগরণে কেবলই যাদের ফেলে
এসেছি, যে পথে হেঁটেছি,
যে বাটে মাঠে ঘুরেছি
সেই সবকিছু এমনকি গাছের
পাতাটা, পাখিটা ফিরে ফিরে
মনে আসে।"
"মা,
তুমিতো কবি হয়ে যাচ্ছ।"
"কবিতার জন্মতো
দুঃখের ভিতরই। শোক থেকে
শ্লোক। আর আমিতো
সাহিত্যের ছাত্রী বটে।"
"শিক্ষকও বটে। তাই না মা।" মা-মেয়ে দুজনেই
হেসে ফেলল। মনিকা মায়ের
গলা জড়িয়ে বুকে মুখ রাখল। শীলাও মেয়েকে জড়িয়ে ধরল।
ক'দিন থেকে
রাতে শোয়ার পর সহসা
ঘুম আসে না শীলার। বার বার মনে পড়ে সেই ঘর,
বিছানা, বইয়ের র্যাক, এমনকি চাল রাখার
বিশাল তামার ডেকচিটা।
ডেকচির ওপর একটা ছোট্ট
ঘটি ছিল মুষ্টি চালের। আম্মার একজোড়া প্রিয় কবুতর
ছিল। ওরা এসে সে ঘটির
মধ্যে ঢুকে খুটে
খু্টে চাল খেত। শীলাদের দেখলে ঘাড় বাঁকিয়ে
তাকাত কিন্তু সরে যেত না। পরিষ্কার ঘরে ওরা প্রায়ই
বিষ্ঠা ত্যাগ করত। এ নিয়ে
শীলার সাথে আম্মার মিষ্টি
খুনসুটি হতো। "আচ্ছা আম্মা এরা কি আমার
ভাই-ভাইয়ের বৌ। আরো তো কবুতর আছে কিন্তু
এ দুটোর প্রতি আপনার এত মায়া
কেন?"
"কি জানি
মানুষের কিসে যে কখন মায়া
পড়ে যায়।"
আম্মা হাসতেন। বই পড়ছেন আম্মা। গভীর
মনোযোগ। শীলার ভাল লাগে
না। সে কার সঙ্গে
গল্প করবে। শুরু
হয় আম্মাকে বিরক্ত করা। "আমার খিদে
পেয়েছে। আমার কিছু
খেতে ইচ্ছা করছে। এই দ্যাখেন
আমার জামাটা এইখানে ছিঁড়ে
গেছে। সেলাই করতে
হবে। দ্যাখেন না"
আম্মা রেগে
যেতেন। বই রেখে
কিছুক্ষণ চোখ বড় করে তাকিয়ে
হেসে ফেলতেন। "আমাকে পড়তে দেখলে তোর কি গায়ে
জ্বর উঠে।"
"হ্যাঁ,
উঠে তো। বই রেখে
দেন। আমাকে গল্প
বলেন।" কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে কোলের
ওপর টেনে নিয়ে গল্প
বলতেন- রামের সুমতি। হ্যারিকেনে
আলো-ছায়ায় শীলা দেখত
রামকে তার বউদিকে। বউদির
জন্য রামের কষ্ট। রামের
দুরন্তপনায় বউদির কষ্ট। রামকে
আলাদা করে দিয়েছে। কিন্তু
ছোট্ট রামতো ভাত রাঁধতে
পারে না। রাঁধতে
গিয়ে হাত পুড়িয়ে
– আহারে। আম্মার কথনের
আশ্চর্য দক্ষতায় শীলার চোখ দুটো
ভিজে উঁঠত।
অনেক বছর হয়েও রামের কথা মনে হলে বুকটা
হা হা করে উঠত। আবার মানুষের গল্প- মাদাম
কুরি, জোয়ান অব আর্ক,
লিও টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি,
বেগম রোকেয়া, গান্ধী-নেহেরু
কত যে গল্প। আর রেডিওতে
নাটক আর গান। কলকাতার
আকাশবাণী থেকে রবীন্দ্রসংগীত, পুরণো
দিনের গান, সঞ্চয়িতার কবিতা-
মনের ভিতর কেমন একটা
ভাললাগা, অচেনা একটা জগৎ ছায়া-আবছায়ায়
মাখামাখি হয়ে শীলাকে রোমাঞ্চে
ভরিয়ে তুলত।
শীলা অবাক হয় রাশিয়ার
সমাজতন্ত্র, জারের পতন, ফরাসী
কাস্তিল দুর্গের পতন আর গিলেটিনের
ঘটনা কেমন সন-তারিখ
মিলিয়ে বলতেন আম্মা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনেও অনেক বন্ধুকে দেখেছে
এসব বিষয়ে বিন্দুমাত্র জানে
না।
এইতো আম্মা গোসল
করিয়ে চুপ আঁচড়ে, জামা
জুতো পরিয়ে শীলাকে স্কুলে
পাঠাচ্ছেন। গ্রামের প্রাইমারী
স্কুল। ছেলেমেয়েরা সবাই
খালি পায়ে আসে। মেয়েরা
দু-একজন শাড়ীও পরে। নাকে তাদের নথ, নাকের
ভিতরে মাঝখানে ফুটো করে নাকঠাসা
ভরে দেয়া। ছেলেরা
বেশিরভাগ ধুলিমলিন স্যান্ডো গেঞ্জি
পরা- এর মাঝে ধপধপে
জামাজুতোয় নিজেকে বড়ো বেমানান
লাগত শীলার। লজ্জা
পেত। ফাঁকতালে থাকত
কখন আম্মা রান্নাঘরে যাবে
আর সে জুতো জোড়া
খুলে ছুট দেবে।
কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে। ঝমঝম বৃষ্টি, বাতাস আর মাঝে
মাঝে ঠা ঠা বাজ পড়ার
শব্দ। বাড়ির আর আশপাশের
সবাই আম কুড়াতে ছুটেছে। লীলা, শরীফ, তারিকভাই তারাও
নেমেছে। শীলা গৃহবন্দী। জানালা দিয়ে দেখা ছাড়া
আর কিছু করার নেই। আম! কত চাও। খাঁচা ভর্তি করে এনে দেবে
কিন্তু বাইরে যাওয়ার হুকুম
নেই – কি জানি যদি কিছু
হয়।
তবু কি শিশুমন
থেমে থাকে। ভরা বর্ষায়
খালবিল, নদীনালা যখন টইটম্বুর
তখন লীলা, শরীফ, রুবীর
সাথে শীলাও নৌকায় চড়ে বসে। তালের ডোঙা এদিক ওদিক
দোলে। তারই ভিতর
ফ্রকটা পিছন থেকে টেনে
তুলে মাথা নামিয়ে বসে থাকতে
হয়। কি জানি
কার চোখে পড়ে আর কাকার
কানে যায়।
আশ্চর্য। এখন ভাবতে
কেমন লাগে- লীলাদের সাথে
সেও বাবাকে কাকাই ডাকত। আম্মা মাঝে
মাঝে বলতেন, কাকাকে বাবা
ডাকতে। শীলাও দুষ্টুমি
করত- "বাবা, বাবা।"
বাবা হাসতেন আর বলতেন-
"না, তোমার
বাবা আছেন। দেখ না উনি তোমাকে
দেখতে আসেন।"
হ্যাঁ আসেন
তো। অপূর্ব কান্তিমান
এক পুরুষ। সাহেবী
পোশাক পরা। উজ্জ্বল
বাদামী চোখ। যে কদিন
থাকতেন শীলাকে সারাক্ষণ কাছে
কাছে রাখতেন। রাত ঘুমাতে
হত তার কাছে। এই বিষয়টা
শীলার ভাল লাগত না। তারতো আম্মা আর কাকাকে
ছাড়া ঘুম আসে না। এ মানুষটাও তাকে বুকে আগলে
রাখে কিন্তু তার ভয় করে। আরেকটা ভয় কাজ করত যা ছোট্ট
শীলা কাউকে বলতে পারত
না। বাবা এলেই
বাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের চাচা-চাচীরা
বলতেন- "শীলা, এবার
তো তোমার বাবায় তোমারে
নিয়া যাইব। ঢাকা
শহরে। যাইবা?"
এই ‘যাইবা’
শব্দটা শুনলে শীলার ছোট্ট
বুকটা গুড়গুড় করে উঠত। হৃৎপিন্ডে দমাদম ঢাকের কাঠিতে
নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। কিন্তু এত কিছুর
পরও মানুষটার প্রতি প্রচন্ড একটা আকর্ষণ ছিল। নতুন
বই দিত। ঈদকার্ড
পাঠাত। নদীর ধারে কাশবনে শীলার ছোট্ট
হাত ধরে বেড়াতে বেড়াতে
শহরের গল্প করত। কিন্তু
যখনই বলত- "যাবে
আমার সাথে মা?
তোমাকে শহরের স্কুলে ভর্তি
করে দেব। তোমার
আরও দুটি ভাইবোন আছে তাদের
সাথে থাকবে।"
এ কথা শুনলেই
শীলার গুটিয়ে যেত।
ইচ্ছে করত তখনই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাকা আর আম্মার কাছে
ছুটে যেতে যেখানে গেলে
সে নিশ্চিন্ত। বড় হয়ে আম্মার কাছে
শুনেছিল বাবা-মা ছোটবেলা
থেকেই একজন আরেকজনকে পছন্দ
করত। পরিণত বয়সে
সে ভাললাগা ভালবাসায় পরিণত
হয়েছিল। অনেক হ্যাপা
করে বিয়ে হওয়ার পর বছর না ঘুরতে
শীলার জন্ম। পরের
বছর আবার শিশুর জন্ম
দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু
হলে বাবা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন।
শীলা তখন মা হারিয়ে
আম্মার কোলে। সেই বাবা শীলার সতের
বছর বয়সে যখন হঠাৎ
মারা গেল তখন শীলার
মনটাই ভেঙে পড়েছিল। ততদিনে
বাবাকে সে চিনেছে। ভাইবোনদেরকেও
পেয়েছে। ছোট ছোট ভাইবোন
আর বাবার জন্য শীলার
বুকের ভিতর উথাল পাথাল
কান্না। জীবনের প্রথম
সেই শোক দীর্ঘদিন শীলাকে
বিষণ্ণ করে রেখেছিল। নিজেকে
শেকড় ছেঁড়া উন্মূল মানুষ
মনে হত।
"এ্যাই তুমি এখনও ঘুমাওনি।" এক ঘুম দিয়ে সজাগ হয়ে মামুন বলল।
"না। ঘুম আসে না যে। এবার সুবর্ণগ্রাম থেকে আসার
পর কেবলই পুরনো স্মৃতিগুলো
ফিরে ফিরে আসে। কোনটার
সঙ্গে কোনটার মিল নেই জানো। এই এটা মনে হল তো ঐ আরেকটার
দিকে মন ছুটল। আমাদের একজন দাদা
ছিলেন ভীষণ রাগী। আমরা
যখন বৈঠকখানার বড় উঠানটাতে
বউচি বা এরকম কিছু
খেলতাম তখন খুব হৈ চৈ হত আর দাদা
মোটা একটা লাঠি নিয়ে
ছুটে আসত আর যাকে
সামনে পেত তাকেই বাড়ি
দিত। আমরা সবাই
মিলে তালি দিয়ে দাদাকে
আরও খেপাতাম।
জানো,
আমাদের পুকুরপাড়ে না একটা
ঝাঁকড়া গাছ ছিল। সম্ভবত
ডুমুর ওটা থেকে মাঝে
মাঝে কেমন একটা গন্ধ
আসত আর আমরা ছুটোছুটি
করে চ্যাঁচাতাম- পেত্নী
ডাইল রান্ধে, ডাইলের গন্ধ।
আর পুকুর পাড়ের
ঐ যে বিশাল তুলাগাছটা যেতা
তুমিও দেখেছ সেটা নিয়ে
কত ভয়ঙ্কর কাহিনী যে ছিল। রাতের বেলা একটা জ্বিন
নাকি সাদা ধবধবে পোশাকে
আকাশ থেকে নেমে তুলাগাছ
আর বটগাছের ডালে পা ছাড়িয়ে
দাঁড়িয়ে থাকত। একটু
সন্ধ্যা হলে ওখান দিয়ে
যেতে আমরা একজন আরেকজন
ধরে একরকম চোখ বন্ধ
করে পার হতাম। কি ভয়,
কি ভয়। অথচ এখন গাছগুলো
নেই সব কেটে সাফ।"
"শীলা"
"হুঁ"
"এসব গল্প
কালকে হবে। আজ ঘুমাওতো। সকালে তোমার কলেজ আছে আমার
অফিস। রাত জাগলে
শরীর খারাপ হবে যে।"
"কী করবো
বলো ঘুম যে আসে না। বার বার মনে হয় খালাম্মাকে
বেঁচে থাকতে একবার দেখলাম
না। কত আদর করত।" বলতে
বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শীলা। মামুন চুপ করে ওর মাথায়
হাত বুলায়। এক সময় শীলার চোখের পাতা
জড়িয়ে আসে ঘুমে।
****
৩৬
আর দুসপ্তাহ মাত্র, কিন্তু এখনও অনেক
দাওয়াত দেয়া বাকি। রফিককে
নিয়ে ছুটতে হচ্ছে বাজারে
দোকানে। এর মধ্যে
অফিসে যেতে হয়। বাড়িতে
লীলা কাজকর্ম গোছাচ্ছে। মানুষের
অভাব নেই তবু সবকিছু
সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য
জহির নিজেই উদ্যোগী। কিন্তু
কদিন ধরে কোন কাজেই
মন বসছে না। এরকম
একটা কাজের সময়ে ফালতু
ঝামেলায় সাবেরাও চুপচাপ। খুব প্রয়োজন
না হলে কথা বলে না। জহিরের নিজের মাথায়ও অশান্তি
জট পাকিয়ে আছে। পলিটিক্স
করে জীবনে একটা বিষয়
আয়ত্ত করেছে সেটা হলো ধৈর্য। জীবনে কোন কোন বিষয়কে
কিছুটা সময়ের ওপর ছেড়ে
দিলে সেটা আপনিই সহজ হয়ে আসে। অথচ অরিনের বিষয়টা কিছুতেই
সহজভাবে নিতে পারছে না জহির। যেদিন মেয়ে এসে বলেছিল
যাবে না। সবাইকে
ছেড়ে এতদূরে যেতে ইচ্ছে
করছে না। তখন সেটাকে
স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল। ভেবেছিল ছেলেমানুষী আবদার।
সাবেরা যেদিন
জানাল সেদিনও তার ভাবনায়
ছিল ধমক ধামক দিলে
সব ঠিক হয়ে যাবে। শাসনকে ভূতেও ভয় পায় আর এ তো তার নিজের
মেয়ে। বুদ্ধি থাকলে
এমন কাজ কেউ করে।
কিন্তু গতসপ্তাহের
ঘটনায় তার মনটা টাল খেয়ে
গেছে। আরিয়ানা একটু
স্পষ্টবাদী, কিন্তু অরিন
চিরদিনই শান্ত ভদ্র। অথচ অভীকে
এই বাসায় আসতে মানা
করতে বলতে সেই মেয়েই
কি না বলল- অভী এই বাসায়
না এলে সে নিজেই
বাসা ছেড়ে যাবে। কি সাংঘাতিক। মানসম্মান
নিয়ে খেলা!
জহির মেয়ের বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।
আরিয়ানা এ নিয়ে
বাবার সাথে বাকবিতন্ডা করেছে- "এখন
তোমাদের যুগ নেই বাবা।
তোমরা বলবে আর আমরা ডার্বিডল সেজে বিয়ে করে ফেলব।"
"তাহলে কী করতে চাস? যা বের হয়ে দ্যাখ তখন বুঝবি দুনিয়াটা কেমন।"
"এখনও কী দুনিয়াটা
খুব ভাল বাবা?"
আরিয়ানা প্রশ্ন করেছিল। "তোমাদের ভাইবোনদের মিল নেই। আমাদের স্বাধীনতা নেই যেন তোমার
ইচ্ছের পুতুল আমরা dancing doll.
"চুপ।" মেয়েকে
ধমকে উঠেছিলেন।
"সত্যি কথা বলতে
গেলেই শাসন। But বাবা mind it, our life is ours and we must have take decision about this.
"ও ইংরেজি
শিক্ষার এই পরিণাম, খুব চ্যাটাং
চ্যাটাং কথা শিখেছ। কিন্তু
তোমার বোনকে বলে দিও আমার
ডিসিশানই শেষ কথা এবং সেটা
তোমার বেলায়ও।" বলে আর দাঁড়াননি। যে মুখরা
মেয়ে। আরো কি না কি বলে বসে সেই ভয়টা
আছে।
কাল থেকে প্রেশারটাও
বেড়েছে। এর আগে দুবার
হার্ট এ্যাটাক হয়ে গেছে। বেশি উত্তেজনাও সহ্য
হয় না। অথচ বিষয়টা
মাথা থেকে যাচ্ছে না। মেয়েটা কীভাবে এমন করতে
পারল! আম্মার মৃত্যু পরবর্তী
অনুষ্ঠানটা গ্রামে করে যেমন
স্মরণীয় করে রাখতে চাচ্ছেন
অরিনের বিয়ের জন্য তেমনি
একটা বিরাট পরিকল্পনাও রেখেছেন। আত্মীয় বন্ধুরা যেন তা অনেকদিন
মনে রাখে তেমনি একটা
জাঁকজমকের অনুষ্ঠান ঢাকায় করবেন। আর মেয়েটা কি না। নাহ আর ভাবতে পারছেন
না। এটা হতে পারে
না।
মনঃসংযোগ করতে
চেষ্টা করলেন। অনেক
কাজ হাতে। এরপর
বায়রার একটা মিটিং আছে সেখানে
যেতে হবে। যদিও
বহুদিন থেকে এই ব্যবসায়
তার ভাটা চলছে,
তবু লাইসেন্সটা ধরে রাখতে
হয়। সত্যি বলতে
আজকের এই পাকাপোক্ত অবস্থানে
আসার মূলেতো ঐ আদম ব্যবসাটাই।
একটা সিগারেট
খেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। হার্ট এ্যাটাকের পর ডাক্তার
বলেছিল সিগারেট ছেড়ে দিতে। কিন্তু আশৈশবের এ অভ্যাস
আজও ছাড়তে পারেনি। আর কোন কিছু
নিয়ে টেনশান হলে না খেয়ে
পারে না। টেবিলের
ড্রয়ার থেকে প্যাকেট বের করে লাইটার
জ্বেলে সিগারেট ধরালেন। তারপর
পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে
ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।
সিগারেটে ধোঁয়া
ছাড়তে ছাড়তেই হঠাৎ মনে হল অভীর
বাবা-মাকে ডাকলে কেমন
হয়। সোজাসুজি বলে দেওয়া, এটা কোনমতেই সম্ভব
নয় তোমরা তোমাদের ছেলেকে
সামলাও। সম্পর্কে বউয়ের
বড় ভাই হলেও বয়সে
ছোট বলে সম্বন্ধীকে সবসময়েই
তুমিই বলে এসেছেন। শ্বশুর
শাশুড়ীর আদরের দুলাল হলেও
বাড়ির বড়জামাই হয়ে ইস্তক
জহির তার ওপর কর্তৃত্বই
ফলিয়েছেন। সুতরাং আজও তাকেই
উদ্যোগী হতে হবে।
সিগারেটের বাকি
অংশটা ছাইদানিতে গুঁজে দিয়ে
তড়াক করে উঠে বসলেন। চশমাজোড়া চোখে লাগিয়ে মোবাইলে
কল দিলেন।
মিনিট পনের
না যেতেই সাবেরা এসে হাজির
হল।
"তুমি ভাইয়াকে ফোন করেছ?"
"হ্যাঁ।"
"কেন?
কেন ওদের আসতে বলেছ
জানতে পারি কি?"
"অভীর ব্যাপারে
কথা বলব। ওরা যেন অভীকে
সামলায়। আমার মেয়ের
পিছনে লেলিয়ে না দেয়।"
"এত বিশ্রীভাবে
কথা বলছ কেন? লেলিয়ে
দেওয়া বলতে কি বোঝাচ্ছ?"
"কী বুঝাতে চাইছি
তা নিশ্চয় তুমি বুঝেছ। আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই
অভীর কাছে
বিয়ে দেব না। তাছাড়া
ঐ ভ্যাগাবন্ড ছেলেটার জন্য অরিন
আমেরিকা না গেলে আমি লোকের
কাছে মুখ দেখাতে
পারব না।"
"অভী ভ্যাগাবন্ড? আমার ভাইয়ের ছেলেকে
তুমি এ কথা বলতে
পারলে! তোমাদের এরকম একটা
ছেলে আছে? ভালমানুষ হলেই
ভ্যাগাবন্ড হয়ে যায়?"
"তাছাড়া আর কী? দিনরাত তো
আছে গান-বাজনা, নাটক-ফাটক নিয়ে।
ওর হাতে তোমাদের ব্যবসা টিকবে মনে কর? দুদিনেই সব উড়ে যাবে।"
"আমাদের
ব্যবসা অনেক পাকাপোক্ত। পাঁচ পুরুষের ব্যবসা। এত সহজে
উড়বে? তোমরা মাত্র
আদম ব্যবসা করে জাতে
উঠলে। কতদিনের ব্যবসা
তোমাদের যে এত বড়াই
করছ?" সাবেরা
ফুঁসে উঠল। "ব্যবসা, ব্যবসা, ব্যবসা আর টাকা-
পৃথিবীতে এছাড়া আর কিছু
বোঝনা তোমরা। এত ছোট মন কেন?"
"সাবেরা"- ধমকে উঠলেন জহির।
"চুপ, জোরে
কথা বলবে না। বাড়িতে
আরও মানুষ আছে। তোমার
আসল রূপটা বাচ্চাদের কাছে
প্রকাশ হয়ে যাবে। ওরাতো
এখনও জানে না, টাকা
আর সম্পদের জন্য তোমরা
কতটা স্বার্থপর হতে পার। কতটা লোভী হতে পার।"
"সাবেরা,
কী বলছ এসব আবোল
তাবোল?"
"ঠিকই
বলছি। তোমারই তোমাদের
খালার মেয়ে শীলাকে কিভাবে
ঠকিয়েছ, আমি জানি না!
দেশের লোকদের জমিজমা কেনার
নামে একরকম গ্রাস করছে। তোমাদের এ লোভের শেষ কবে হবে-
মরলে?"
"তুমি কি পাগল
হয়ে গেলে সাবেরা। একে আমি সামনে
একটা বিরাট কাজ নিয়ে
আছি। তারপর মেয়ের
পাগলামী।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ
পাগল হয়ে গেছি। কিসের
কাজ। মায়ের মৃত্যুতে
বিরাট আয়োজন করে লোক খাওয়াবে। এটাও কি ভন্ডামী নয়। গ্রামের লোককে দেখানো তোমরা
কত বড় ধনী। কই এতদিনেও
এলাকায় একটা ভালকাজ করেছ? মানুষের জন্য একটা
স্কুল-হাসপাতাল। কোন কিছু
করেছ? শুধু জমি কিনেই
যাচ্ছে। কি হবে এত জমি দিয়ে,
কে খাবে?"
জহির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে
থাকেন। চিরদিনের শান্ত
ভদ্র সাবেরার এ কোন রূপ?
এরা সবাই মিলে কি তার মাথাটা
খারাপ করে দেবে।
"তাহলে
তুমি কী চাও?"
জহির জানতে চাইল।
"আমি কি
চাইব? তুমি আমার
ভাই-ভাবীকে কিছু বলতে
পারবে না। অভীর
এ বাড়িতে আসা বন্ধ করেছ, আমি কিছু বলিনি। কিন্তু ওদের ডেকে অপমান
করবে এটা আমি মেনে
নেব না।"
"ঠিক
আছে আমি ফোন করে ওদের বলে দিচ্ছি।
কিন্তু তুমি তোমার মেয়েকে" বলতে গিয়ে থমকে বললেন- "অরিনকে
সাবধান করে দাও।
আমেরিকা যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলো।"
"সেটা তার ইচ্ছা।
আমি কেন বলব? জোর খাটালে তিক্ততাই বাড়বে।"
"যেটাই হোক,
আমার কথা তাকে শুনতে
হবে। নয়তো আমি আরও কঠোর
হতে বাধ্য হব।"
"দেখা যাক। কার কতটুকু ক্ষমতা।" সাবেরা যেন যুদ্ধের
ঘোষণা দিল। তার একমুহূর্ত
দেরি না করে দরজা
ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল।
No comments:
Post a Comment