Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - দহনের কাল


 _______________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - দহনের কাল
_________________________________________________

দহনের কাল

 

গত কদিন ধরে অদ্ভুত এক উত্তেজনার মধ্যে আছেন মনমোহন পালিত আর তার বন্ধু আনোয়ার যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনাল এবার সাঈদীর বিচারের রায় দেবে রায় কী হয় কী না হয় এ নিয়ে উত্তেজনা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে দেশের তরুণরা ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছে টেলিভিশন মোবাইলে এ খবর একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে তরুণদের আহবানে সবাই সাড়া দিচ্ছে নব্বইয়ের গণ অভ্যুথানের পর আবার এই জাগরণ জনগণ রাজাকারের ফাঁসি চেয়েছে কিন্তু রায়ে যাবজ্জীবন এ রায় মানুষকে বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেখেছে এবং জেনেছে তাদেরকে ক্ষুব্ধ করেছে

          মনমোহন বন্ধুকে প্রশ্ন করেন- তুমি কি মনে করো এবার কিছু একটা হবে?

          -কি জানি,বড় বিচিত্র এই বাংলাদেশ জীবন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে সে ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি নব্বইয়ের অভ্যুথানের পর নতুন আশা জেগেছিল সে আশাও ব্যর্থ হল। এবার কি হবে কে জানে। এখন জামাত-শিবির শক্ত ভিত্তি পেয়ে গেছে। ওরা পারে না এমন কাজ নেই। তৃণমূল পর্যন্ত ওদের কর্মকান্ড পৌঁছে গেছে। আর দেইল্যা রাজাকার দেশের মানুষের কাছে মাওলানা সাইদী হয়ে গেছে।

          -সে তো জানি। কিন্তু নতুন কিছু আশা করতে দোষ কী? আমাদের ছেলে মেয়েরা যেভাবে খেপেছে। দেখো কিছু একটা হবে। কাল তো রায় তাই না?

          -হ্যাঁ। চলো এবার উঠি। সন্ধ্যা হল বলে।

          দিঘির পাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে বসে কথা বলছিলেন দুই বন্ধু। ঘাটের হেলান ঘরে লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন আনোয়ার। মনমোহন তাকে সাহায্য করলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁপানি রোগী। যুবা বয়সে কমেছিল। এখন বয়সে ভাটা পড়তেই আবার বেড়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় পায়ে গুলি লাগার পর খুঁড়িয়ে হাঁটত। এখন লাঠি ব্যবহার করে। মনমোহনও কথা বলতে বলতে বন্ধুর সাথে তার বাড়ি পর্যন্ত যান।

          -তোমার বড় ছেলের খবর কী?

          -ভাল আছে। আমেরিকায়  গ্রিনকার্ড পেয়েছে। তো এখন আস্তে আস্তে সবাইকে নাকি ওখানে নিয়ে যাবে।

          -তুমিও যাবে নাকি?

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন মনমোহন।

          -তুমি কি পাগল হয়েছ মনু? এই বয়সে এই শরীরে আমি সেখানে গিয়ে কী করব? ওদের বোঝা হব? একটা কথা জেনে রাখো মরি যদি এই বাংলার মাটিতেই মরব।

          -আমারও সেই কথা।

         

সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ভাবতে ভাবতে পথ চলেন। কাল যদি রায় হয় তাহলে জামাত-শিবির কি মেনে নেবে? বিএনপিও তো ওদের পক্ষে। সরকারী দল আওয়ামী লীগও নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে দাবি করলেও তারাওতো বিশাল জনসর্মথন নিয়ে ক্ষমতায় এসে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারল না। আসলে দুর্নীতি আর লোভের বিষে রাজনীতির শিকড় থেকে মাথা পর্যন্ত পচে গেছে। তবু আশা যদি দেশের তরুণরা জেগে উঠে হয়তো সবকিছু বদলাবে।

          মনে পড়ে আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে বিশ বছরে যুবক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রে পড়াশোনা করছিলেন। বাল্যবন্ধু আনোয়ার পড়ত ইতিহাসে। সেই উত্তাল সময়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে আন্দোলনে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। আহা কী আগুনঝরা সেই সময়। মিটিং মিটিং মার্চের তিন তারিখ তারপর সাত তারিখ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের কথা মনে হলে আজও শরীরের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। অথচ এই তুঙ্গস্পর্শী ভাষণটাকে বিটিভিতে যখন তখন বাজিয়ে এর মর্যাদাটাই খেলো করে ফেলল। অনেককেই দেখেন এই অভূতপূর্ব ভাষণটি শুরু হলে টেলিভিশনের চ্যানেল পালটে দেয়। ভাল জিনিসও খুব বেশি হলে সেটার স্বাদও তেতো হয়ে যায়।

          -কি গো কখন সন্ধ্যা হল তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমারতো ভয় ভয় করছিল।

          -কিসের ভয় মোহনপুরে কি বাঘ-ভাল্লুক আছে যে আমাকে তারা গিলে খাবে?

          -কথা বললেই যা খুশী তাই বলো। তুমি যে চোখে কম দেখ সেটা কী বিপদের কারণ হতে পারে না? তাছাড়া- স্ত্রী সুধারানী থেমে গেলেন।

          -তাছাড়া কী?

          -কী আবার- এবার মুখ ঝামটা দিলেন। চারদিকে লোকে কী বলাবলি করছে শুনতে পাও না? চোখে দেখনা কানেও শোন না নাকি?

          -শুনি খুব ভাল শুনতে পাই। এখন বল লোকে কী বলছে।

          -জানি না। যাও। ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে চা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। প্রতিদিন বিকেলের চা খেতে খেতে রাত গড়ায়।

         

রাতে খবর শুনতে গিয়ে খুব উত্তেজনা বোধ করলেন আনোয়ার। আগামিকাল সাইদীর রায়। একে আবার যাবজ্জীবন দেবে না তো? নিজেকে প্রশ্ন করলেন কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে। নাহ এটা দেশের ছেলে-মেয়েরা সহ্য করবে না। গনজাগরণ মঞ্চে যেভাবে ছেলে-মেয়েরা একসাথে প্রতিবাদ করছে তাতে তিনিও উদ্দীপ্ত হন। কিন্তু আবার কোথায় যেন হতাশা মনের ভিতর উঁকি দেয়। এই তরুণদেরই আরেক দল জামাত-শিবিরের পাল্লায় পড়ে জেহাদী জোশে মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটে। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আনোয়ারের হাঁপানি ধরা বুকের ভেতর থেকে। হায় কে জানত তাঁর নিজের ছেলেও এই ফাঁদে পা দেবে। অনেক রাতে একথা ভেবে ঘুম আসেনা তাঁর। কথাটা কানে আসার পর থেকে নিজের মনে একদন্ডের হলো শান্তি পাননি। আবার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মনুকেও বলি বলি করে বলতে পারেননি গলার কাছে এসে আটকে যায়। অথচ এই মনুই তাকে ইউনিভার্সিটিতে গণিত নিয়ে পড়তে তোড়জোড় করে পাঠিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে অঙ্কে মাথা ভাল বলে বন্ধুর এই পুত্রটিকে পুত্রবৎ ভালবাসত মনু। সেই মনুকে কিভাবে বলবেন, বলা যায় না।

          গেলবার বাড়ি আসার পর স্ত্রী সালেহার কাছে শুনে ছেলেকে অসম্ভব গালিগালাজ করেছিলেন। হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা তুই আর কাজ পাসনি রাজাকারের দলে যোগ দিয়েছিস। তুই জানিস না এদেশকে স্বাধীন করার জন্য তোর বাপ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের মাথার দাম ওরা দশ হাজার টাকা ঘোষণা দিয়েছিল। আমারই জন্য আমার বাড়ি, আমার বোনের বাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করেছে। আমার বোনটাকে বিধবা করেছে।

          -জানি, সব জানি। তুমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছ আর আমি ধর্মের জন্য জিহাদ করছি।

          -নিকুচি করছি তোর জিহাদের, এখনও সময় আছে সাব্বির এ রাস্তা থেকে ফিরে আয়। ফিরে আয় বাবা, আমি যে তোর জন্য মরমে মরে যাচ্ছি।

          -তোমাকে মরতে বলেছে কে? তুমি তোমার মত থাক, আমাকে আমার রাস্তায় যেতে দাও বলতে বলতে তাঁর সামনে থেকে চলে গিয়েছিল সেই থেকে বাড়ি এলেও তার সঙ্গে কথা বলেন না আনোয়ার।

          সাইদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একদল মিষ্টি বিতরণ শুরু করল আর অন্যদল শুরু করল ভাঙচুর। আনোয়ার আজ সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসাতেই টিভি দেখছেন। প্রচন্ড ভাঙচুর শুরু হয়েছে দেশের সর্বত্র। হরতাল ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন শিবির। একি তান্ডব। সরকার করছে কী? ওরা পুলিশকেও মারছে। যানবাহনে যেভাবে আগুন ধরাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বহ্নিৎসব চলছে।

          -আবার কি আমরা পিছনে হাঁটা শুরু করলাম মনু?

          -জানিনা রে ভাই তবে খুব ভয় লাগছে।

          -আমারও। দলিত শত্রু মাথাচাড়া দিলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। রাত হয়ে গেছে রামুকে বলনা আমাকে একটু এগিয়ে দিতে।

সে রাতে মনু-আনোয়ার কারো চোখেই ঘুম এলো না। আনোয়ার ভাবছেন দেশের ভবিষ্যৎ কী। কোনদিকে যাচ্ছি আমরা। আর মনু ভাবছেন তাদের নিরাপত্তার কথা। চৌদ্দ পুরুষের বাপ-দাদার ভিটায় তাঁরা আজ সংখ্যালঘু। পাকিস্তান হওয়ার পর ঠাকুরদা যাননি। তাঁর ভাইয়ের বংশধররা বেশিরভাগ এখন ভারতে। চৌষট্টির দাঙ্গার সময় মা চলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা যাননি। বলেছিলেন বাপ-ঠাকুরদার ভিটা ছেড়ে শেয়ালদা স্টেশনে রিফিউজি হব নাকি! দরকার হলে এখানে মরব এটা আমার দেশ। তারপর এল মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আধা গ্রাম আধা মফস্বলে থেকেই মানুষকে শিক্ষিত করার মানসে সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রথমশ্রেণী নিয়েও শহরে যাননি মনমোহন। তখন একটা আদর্শবোধ কাজ করেছিল। বাবার মৃত্যুতে আনোয়ারও তাদের পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। ঠাকুরদা নাকি নাম রাখার সময় বলেছিলেন আমার নাতি মোহনপুরের মনমোহন হবে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে মিথ্যে হয়নি। গণিতের শিক্ষক হিসেবে শুধু মোহনপুর নয় পুরো জাফরগঞ্জে তিনি বিখ্যাত। তাঁর ছাত্ররা দেশেবিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। আজও তারা ঈদ-পরবে বাড়ি এলে তাঁকে দেখে যায়। তাঁর নিজের এক ছেলে ডাক্তার, মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক। হতাশার পাশাপাশি মোহন মাস্টার তাই একধরনের আত্মতৃপ্তিও অনুভব করেন।

ভোর না হতেই এলাকায় মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে- মুসলমান ভাইয়েরা ঘরে বসে থাকবেন না। আল্লামা সাইদীর ফাঁসির ঘোষণা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আসেন সবাই মিলে নাস্তিক আর বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করি। শাহবাগের নাস্তিকদের শেষ করতে নওজোয়ানদের এগিয়ে যেতে হবে। আপনারা কি জানেন কালরাতে চাঁদে আল্লামা সাইদীর ছবি দেখা গেছে।

          যারা ফজরের নামাজ পড়তে গিয়েছিল তাদের অনেকেই বেকুব হয়ে ঘরে ফিরল। নিজেরা বলাবলি করতে লাগল সত্যিই সাইদী আল্লার এত বড় ওলী! যারা কোন খবর রাখেনা সেইসব শ্রমজীবী মানুষের প্রশ্ন এত বড় ওলি আল্লাকে সরকার ফাঁসি দিচ্ছে কেন?

          ভোরে নামাজ পড়তে উঠে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মনে হল কে যেন টুকটুক করে দরজায় আঘাত করছে।

          -শুনতে পাচ্ছ? সালেহা জানতে চাইলেন।

          -হ্যাঁ, কে দেখব?

          -তুমি একা যেও না আমিও আসি। দুজনে এসে দরজা খুলে প্রায় আর্ত কণ্ঠে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, সাব্বির তুই এত ভোরে কীভাবে এলি? সারাদেশে এভাবে আগুন জ্বলছে রাতের বেলা এভাবে আসতে তোর ভয় করল না?

          -না কিসের ভয়। আর আমি একা আসিনি। আমার বন্ধুরা এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব নাকি ঘরে ঢুকতে দেবে।

          এতক্ষণে আনোয়ার আর সালেহার মনে হল আসলেই তো ছেলেকে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে তারা দরজাতেই জেরা শুরু করেছেন। দরজা থেকে মা-বাবাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সাব্বির বলল- আমি ঘুমাতে যাচ্ছি আর শোন আমি যে এসেছি এটা লোকজনকে বলে বেড়িও না। তোমাদেরতো আবার মালাউনদের জন্য দরদ বেশি।

          -কী বলছিস তুই এসব হারামজাদা।

          -যা বলছি ঠিকই বলছি। চেঁচিও না। এত ভোরে চেঁচালে লোকে শুনতে পাবে।

          আর কোন কথা না বলে নিজের কামরায় ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। স্তব্ধ হয়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকলেন আনোয়ার। লাঠির ওপর ভর দেয়া তাঁর খোঁড়া পা-টা ঠকঠক করে কাঁপছে। একি কথা বললো সাব্বির! কেন বলল? যে পরিবেশ যে আদর্শে সে মানুষ হয়েছে সে আদর্শ সে কীভাবে ভুলে গেল। আবার বলল তার আসার কথা কাউকে না বলতে। এর মানে কী? কী উদ্দেশ্য তার এ গোপনীয়তা?

 

কাল সারারাত একফোঁটা ঘুম হয়নি মনমোহন পালিতের। টেলিভিশনে দেখা লেলিহান অগ্নিশিখা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন যেন বাংলাদেশটা একটা শ্মশানের চিতা। এ আগুন কী করে নিভবে? এর শেষ কোথায়?

          ভোরের আযান শুনে বিছানায় উঠে বসলেন। বাথরুম ঘুরে এসে কাপড় বদলে বিছানার ওপর পদ্মাসন হয়ে বসে হাত দুটো বুকের কাছে যুক্ত করে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলেন, শান্তি দাও, শান্তি দাও। প্রভু এ দুঃখিনী বাংলায় প্রতিটি ঘরে শান্তির আবাস হোক।

          যুক্তকরেই কিছুক্ষণ ধ্যান করে বিছানা থেকে নামলেন। প্রথাগত ধর্মীয় আচরণ তিনি তেমন একটা মানেন না। নিজের মত করে নিজেই প্রার্থনা করেন।

          ওঘরে স্ত্রী পূজার ঘন্টাধ্বনি বাজাচ্ছেন। এসময় বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। বাড়ির সামনে সীমানা দেয়া বিশাল আঙিনা। সেখানে পূর্বপুরুষদের লাগানো ঝাঁকড়া পুরনো গাছপালা। পাখ-পাখালির বাসা। পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতেই গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখেন। চুপিচুপি উচ্চারণ করেন, তোমরা ভাল আছ তো ভাই, ভাল থেকো। দেশটা কিন্তু ভাল নেই। সবার বিপদ। রাজাকার আর তাদের অনুসরীরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে।

          তারপর সূর্য উঠলে সূর্যপ্রণাম করে ঘরে ঢুকেন। ততক্ষণে স্ত্রী রামুকে নিয়ে চা-নাস্তা তৈরি করে টেবিলে দিয়েছে। তাকে একাই খেতে হবে। মা-দিদিমাদের সংস্কার সুধারানী এখনও বহন করে চলেছেন। স্বামীর সঙ্গে একসাথে খেতে বসেন না। তার এঁটো পাতে খান। এ নিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোও কম হাসাহাসি করেনি। আবার বুঝাতেও চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংস্কার এত সহজে যায় না।

          বিয়ের পর প্রথম প্রথম আপত্তি করে হাল ছেড়েছেন। তখন মা বেঁচেছিল তার সামনে বেশি জোরাজুরিও করা যেত না।

          খাওয়ার টেবিলে সুধারানী বসে আছেন। রামু একপাশে দাঁড়িয়ে। খাওয়ার মাঝখানে সুধারানী বললেন, রামু বাড়ি যেতে চায়।

          -হঠাৎ? এই কদিন আগে না বাড়ি ঘুরে এলি।

          -ভাল লাগছে না কাকাবাবু। দেশের পরিস্থিতি যেন কেমন। বৌ-বাচ্চারা কেমন আছে দেখে আসি।

          -হু, তুমিতো বলেই খালাস। আমি এতদিক সামলাব কী করে?

          -কেন সতীর মা আছে না?

          -হ্যাহ, সতীর মার তো দশটা হাত, মা দুর্গা আরকি।

          -আরে আমরাওতো দুজন। কোন রকমে চলে যাবে। ওকে ঘুরে আসতে দাও।

          -আর কি? যা যা এক্ষুনি যা। একেবারে চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।

          রামু হাসতে হাসতে বলে যায় - আমিতো বিকালে যাব কাকীমা।

          এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। মেয়ে ফোন করল- কেমন আছ বাবা, মা কেমন আছে বল।

          -আছে ভাল আছে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি যে খারাপ।

          -হ্যা, সাবধানে চলাফেরা করিস। কখনও কোথায় বোমা ফুটছে। কোথায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে তার ঠিক নেই।

          -তবুতো বাবা ঢাকা শহর অনেক নিরাপদ। কিন্তু মফস্বল এলাকা আর গ্রাম এলাকায় ওরা হিন্দু বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ করছে। মাকে নিয়ে চলে এসো না বাবা, প্লিজ।

          -পাগল হয়েছিস মা। এই হরতাল, জ্বালাও পোড়াওয়ে পথে বেরিয়ে বুড়ো মানুষেরা বিপদে পড়বে নাকি। আর এখানে আমার ক্ষতি করবে কে? মনমোহন মাষ্টারকে কে না চিনে। বরং আমি থাকলে পাড়ার মানুষ একটু ভরসা পাবে। আচ্ছা তোর মায়ের সাথে কথা বল।

          কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের ফোন এল। দেশের পরিস্থিতি ভাল নয় বাবা। সাবধানে থেকো।

          -এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? সরকার কি বসে থাকবে! দেখিস পুলিশ বিজিবি নামিয়ে সব ঠিক করে ফেলবে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা থাকনে না এটা কি হয়।

          -তবু সাবধানে থেকো। পাড়ার সবাইকে বলো একটু সাবধান থাকতে।

 

বিকেলে আনোয়ার এলে তাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলেন মনমোহন। মনে হল আনোয়ার আজ বড় বেশি চুপচাপ। এমনতো সে নয়।

          -তোমার কী হয়েছে বন্ধু? খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ?

          বুকটা ধক করে উঠল আনোয়ারের। অনেকদিন বলি বলি করেও যে কথাটা লজ্জায় ঘৃণায় বলতে পারেননি সে কথাটা কি বলবেন। বলবেন সাব্বির তার প্রিয় ছাত্র আজ ভোরে বাড়ি এসেছে।

          না এবারও হার হল। পারলেন না। শুধু মিনমিন করে বললেন, দেশের পরিস্থিতিতে মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে পড়েছে। সারাদিনতো টিভি দেখেই কাটালাম। একবার মনে করেছিলাম তোমার কাছে চলে আসি। কিন্তু রোদ এমন কড়া সাহস হল না। ঘামালেইতো হাঁপানি বাড়ে।

          হাঁটতে হাঁটতে দিঘির পাড়ের ঘাটে এসে বসলেন। এটাই তাদের গল্প করার জায়গা।

          মনমোহন বললেন, ছেলে-মেয়ে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে। এটাতো সরকার আর রাজাকারের সমস্যা। যাক এতদিন পরে তবু একটা বিচারে বুকটা কিছুটা হলেও জুড়ালো।

          আনোয়ার চুপ করে থাকেন। অন্যমনস্ক। গল্প জমে না। বিকেল শেষ হবার আগেই উঠে পড়েন দুজনে।

          আনোয়ার বললেন, তোমার ছেলেমেয়ে তো একেবারে মিথ্যে বলেনি। আঘাত কোনদিক থেকে আসে বলা যায় না। আর আমারতো ঘরের শত্রু বিভীষণ- শেষ কথাটা বিড়বিড় করে বললেন।

          -কী বললে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

          -নাহ সাবধানে থাকার কথাই বললাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরও তো হামলা হতে পারে।

          ফিরে চললেন দুজনে। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। এতদিনের বন্ধুকে যেন বুঝে উঠতে পারছেন না মনমোহন। মনে হচ্ছে অঙ্কের হিসাবে কোথাও গোলমাল আছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারলেন, আনোয়ার কোন কারণে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আছেন।

 

সন্ধ্যার পর থেকেই টেলিভিশনে খবর আসতে শুরু করেছে জামায়াতপন্থীরা সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর হামলা করছে। রাজশাহীতে, নোয়াখালীতে হিন্দুমন্দিরের মূর্তি ভাঙছে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত একটা মানসিক অস্থিরতা নিয়ে মনমোহন ও সুধারানী টিভির সামনে বসে আছেন। বাড়িতে রামুটাও নেই।

          হঠাৎ মানুষের কোলাহল কানে এল। মনমোহন জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন আগুনের শিখা আকাশের দিকে ধাবমান। মুহূর্তে বুঝতে পারলেন কী ঘটছে। দরজা খুলে বাইরে ছুটে গেলেন, পিছন থেকে সুধারানী চিৎকার করছেন- যেও না ওগো যেও না। মনমোহন ছুটে গেলেন মন্দিরের দিকে। সাহা পাড়া, মল্লিক পাড়া সবদিক থকেই হৈ চৈ ভেসে আসছে। সবাই মন্দিরের দিকে ছুটছে দেবতাকে বাঁচাতে হবে।

          ওরা নারায়ে তকবীর ধ্বনিতে ধারালো খড়গ হাতে ছুটে আসছে। কারো হাতে লাঠি। চিৎকার করছে, ভাঙ ভাঙ শালাদের যত দেব-দেবী। খড়ের মূর্তির পূজা করা দেখাচ্ছি। লাথি মারলেই ভগবান পালাবে।

          মনমোহন মন্দিরে ঢুকলেন। অন্যরাও এল। আজীবন মানবধর্মে বিশ্বাসী মনমোহন দুহাত ছড়িয়ে দেবীকে পিছন করে দাঁড়ালেন।

          ওরা মশাল নিয়ে আসছে। ধর ধর মার মার চিৎকারে মশালের আলোয় প্রথম যাকে দেখলেন মনমোহন সে সাব্বির।

          -সাব্বির!!

চিৎকার করে উঠলেন মনমোহন কিন্তু ততক্ষণে সাব্বিরের খাঁড়ার আঘাতে তার ডান হাতটা মাটিতে গড়াচ্ছে- যে হাতে তিনি প্রিয় শিষ্য অঙ্ক শিখিয়েছিলেন পুত্রস্নেহে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts