Friday, 28 February 2025

রিফাৎ আরার 'চট্টগ্রাম শাহীনের স্মৃতিময় দিনগুলি' - পর্ব ২২

 



২২

আমাদের পরিচালনা পর্ষদ

 

দ্বিতীয় উচ্চতর ধাপে আমাদের বস ছিলেন প্রথম দিকে ট্রেনিং উইংয়ের ওসি সাহেবগণ, এরা বেশিরভাগ উইং কমান্ডার পর্যায়ের হতেন। পরবর্তীতে এই ক্ষমতা শিক্ষাকর্মকর্তার পরিবর্তে ঘাঁটির প্রশাসনিক অধিনায়ক (প্রধান) অর্থাৎ ওসি (এডমিন)- এর কাছে চলে যায়।

          আমি যখন জয়েন করি তখন আমাদের পরিচালনা পর্ষদের সচিব ছিলেন শিহাব উদ্দীন ভূঞা। যতটুকু শুনেছি শাহীন চট্টগ্রাম মূলত তাঁর তত্ত্বাবধানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর ডান হাত হিসেবে অফিসিয়াল সব কাজ করতেন মনোয়ার ভাই। বোর্ডে, ব্যাংকে, ডিডিপি আই অফিস, এম পিওর টাকা তোলা এবং অফিস তত্ত্বাবধান ইত্যাদি সবই মনোয়ার ভাইকে করতে দেখতাম। শিহাব উদ্দীন ভূঁইয়ার আপন বড় ভাইয়ের মেয়ে ছিলেন স্কুল শাখার ইংরেজি শিক্ষক মোস্তফা কামাল স্যারের স্ত্রী। ইসলামের ইতিহাসের ডিগ্রী থাকলেও ইংরেজি গ্রামারে খুব ভাল হওয়ায় তিনি ইংরেজিই পড়াতেন। কামাল ভাই নিজের গন্ডীর বাইরে কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সংসারের সব সামলাতেন ভাবী।

          বারকোয়ার্টার শিক্ষকদের বাসস্থান হওয়ার কারণে অন্যরাতো আসতই, অফিসারদের বাচ্চারাও আসত। আমার মেয়ে রাকার বন্ধু ছিল গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইকবাল স্যারের মেয়ে সোনিয়া। সে প্রায়ই আসত রাকার সাথে খেলতে, রাকাও যেত অফিসার্স কোয়ার্টারে দোলনা, স্লিপার এগুলোতে চড়তে। অনেকে পড়তেও আসত। কিন্তু ভূঁঞা স্যারের পরিবারের কাউকে কখনো দেখিনি কামাল ভাইয়ের বাসায় আসতে। কামাল ভাইয়েরাও বোধহয় যেতেন না। পরে কামাল ভাই চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে যান।

          তখন ঘাঁটিতে এত অফিসার ছিল না। ট্রেনিং উইং-এর ওসি হলেও স্যার দিনে একবার হলেও কলেজ ঘুরে যেতেন। একদিন কলেজে যাওয়ার পর পরই নির্দেশ এল লালদালানের সামনে সকল শিক্ষককে দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে। তখন গ্রীষ্মকাল স্যাররা একপাশে আর আমরা ম্যাডামরা সূর্যের দিকে মুখ করে পশ্চিম দিকে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরই কলেজের খোলা গেট দিয়ে ঢুকলেন তিনি। ঢুকেই সামনে পিছনে পায়চারী করে শিক্ষকদের ধমকাতে শুরু করলেন।

     কি পড়ান আপনারা, কি করেন? এখন থেকে প্রয়োজনে বিকেলেও ক্লাস নিতে হবে, দরকার হলে রাতে প্র্যাকটিকেল করাবেন। এসব ফাঁকিবাজি চলবে না। আমি সবাইকে দেখে নেব।

          কালো, স্থূলদেহের মানুষটি আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে শিক্ষকদের যা নয় তাই বলে ইচ্ছেমত ধমকালেন। প্রয়োজনে ছুটি ক্যানসেল করবেন। শিক্ষকরা সবাই চুপ। কেউ বুঝতে পারছেনা কি কারণে এই সমবেত তিরস্কারের আয়োজন।

হুম হাম করে তর্জন গর্জন শেষে জুতো মচমচিয়ে তিনি চলে গেলেন। হঠাৎ মহীউদ্দীন স্যার কান্নায় ভেঙে পড়লেন- আল্লাহ তুমিই ভাল জান কেন এ অপমান, তুমি ইনসাফ করো, তুমি ন্যায় বিচারক।

          আমরা সবাই বিষণ্ণ। সবার ভিতরে আরো টেনশান- সামনেই রোজার ছুটি। এই মদমত্ত লোকটি কি আমাদের ছুটিও ক্যানসেল করে দেবে?

          না ছুটি ক্যানসেল হয়নি। ছুটি কাটিয়ে এসে শুনলাম আমাদের সেক্রেটারী আর সেক্রেটারী নেই। তার পোস্টিং হয়ে গেছে। আমাদের বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরটা নেমে গেল।

          এর মাঝে আরো অনেকে এসেছেন আবার চলে গেছেন। মহসীন স্যার, আক্কাস স্যার আরো কেউ কেউ যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। মহসিন স্যার ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। কলেজ প্রশাসনকে অকারণে ব্যতিব্যস্ত করতেন না।

          তবে যে দুজন সচিব কারণে অকারণে মিটিং করে অযথা হুমকি ধামকি দিয়ে শিক্ষকদের একরকম অপমানই করতেন এরা হচ্ছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম এবং আরেকজন তার চেয়েও কুখ্যাত গ্রুপ ক্যাপ্টেন হারুন-অর-রশিদ।

          রফিকুল ইসলাম কেবল স্ক্রু টাইট করতেন আর বলতেন, আমার বাবাও শিক্ষক ছিলেন তাই আমি শিক্ষকদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখি।

          যার কণ্ঠস্বরে সবসময় তিরস্কার ও কাঠিণ্যের সুর তিনি শিক্ষকদের সম্মান করেন? শুনে আমাদের- আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি অবস্থা।

          এরা চাইতেন RTS এর রিক্রুটরা যেমন ডিসিপ্লিনড এবং পাংকচুয়াল আমাদের ছেলে-মেয়েরা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরাও সেরকম হবে এদের উর্বর মস্তিষ্কে এটা কেন আসত না, ওরা করে চাকরির দায়ে আর ওপর কঠোর শাস্তির ভয়ে আর আমাদের বাচ্চারা কেজি থেকে দ্বাদশ ক্লাস কত ভিন্ন ভিন্ন বয়সের আড়াই-তিন হাজারের মত বিচিত্র শিশু তাদের কিভাবে ওদের মত ডিসিপ্লিনড করা যায়! তবু হীরকের রাজা ভগবান এই কথা মনে করে তার অমিয় বচন শ্রবণে গ্রহণ করতে হত। তবুও আমি প্রতিবাদ করতাম বা বোঝাতে চেষ্টা করতাম অনেক বিষয়ে, কিন্তু ঐ যে প্রবাদে আছে না- বিচার মানি তালগাছ আমার।

          তাই উনি মিটিং করতে আসবেন শুনলে বলতাম- মাস্টারের পুত আইতাছে। আরেকটা শব্দ চাকরি জীবনে এনাদের সবার কাছে এত শুনেছি যে কান পচে গেছে। সেটা হল dedication. কোন কিছু দাবি দাওয়া পেশ করলে বা সুযোগ সুবিধা চাইলেই ওনারা বলতেন আপনারা শিক্ষক আপনাদের dedication থাকতে হবে, sacrifice করতে হবে।

          কিন্তু এসব কি হাওয়া থেকে পাওয়া যায়? একজন শিক্ষক বা যে কোন মানুষই তার কাজের প্রতি ডেডিকেটেড হবে যখন প্রতিষ্ঠানও তাকে সেরকম সুযোগ সুবিধা দেবে। আপনারা রেশনের চাল-ডাল-তেল খাবেন, গাড়ি চড়বেন, আলীশান কোয়ার্টারে বাস করেও হাঁচি দেবার আগে ডাক্তার দেখাবেন, চাকরি থেকে অবসরের সময় বিশাল অঙ্কের টাকা এবং সারাজীবনের জন্য রেশন, মেডিকেল, সরকারের দামী প্লট তার ওপর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর পদে চাকরি সবই বগলদাবা করবেন- করবেন কারণ আপনাদের চাকরির শর্তও তাই। প্রয়োজনে আপনারা প্রাণ দেবেন। কিন্তু সেখানে সামনের লাইনে দাঁড়াবে কারা? মুক্তিযুদ্ধে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর মধ্যে পাঁচজনই তো সাধারণ সৈনিক। কিন্তু Boss is always right’ তাই এসব কথা বলা যায় না তবুও যখন মিটিং হত আমি কিছু না কিছু দাবী-দাওয়া তুলতাম, যুক্তি দিতাম কারণ একটা কথাই আমার মনে হত শিক্ষক আমরা,পেটে ভাত না থাকলেও মেরুদন্ডটা অবশ্যই খাড়া রাখতে হবে এরাও কোন না কোন শিক্ষকের কাছে হাতেখড়ি নিয়ে স্কুল কলেজ পেরিয়ে এখন অফিসার হয়ে অবিচার করছেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কারণ কজন পিতা-মাতা তখন এত ধনী ছিল? চাকরির নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধার জন্যই তারা এসেছে। এবং সত্যি কথা বললে সাধারণ সৈনিকরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ছেলেদের অফিসার বানাবার স্বপ্ন নিয়ে বড় করতেন। একনিষ্ঠ চাওয়ায় তারাও তাই হত। ক্লাসে জীবনের লক্ষ কি জানতে চাইলে রূপসা কোয়ার্টারের বেশিরভাগ ভাল ছাত্রের তখন উত্তর ছিল, সামরিক বাহিনীর অফিসার হবে।

          যাক জনাব রফিক এখন কোথায় আছেন জানি না তবে শাহীন কলেজের তৎকালীন শিক্ষকরা এখনও মনে হলে- মাস্টারের পুত বলেই সম্বোধন করে হাসাহাসি করে। অথচ অনেক তাবড় তাবড় অফিসার তাঁদের সৌজন্যের কারণে এখনও আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন। তাঁদের কথায় পরে আসব।

          আরেকজনতো মাশাল্লাহ তার ক্ষমতার দর্পে, অত্যাচারের নৃশংসতায় সবাইকে হারিয়ে দিলেন। তিনি কে? তিনি গ্রুপক্যাপ্টেন হারুন-উর-রশীদ। আমরা বলতাম আয়েশা আপার দুলাভাই। আমাদের প্রিয় মরহুমা আয়েশা আপার তিনি সম্পর্কে কেমন যেন দুলাভাই হতেন।

          তিনি এলেন, কিছু কথা বলার পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমত বললাম। কোন সুযোগ সুবিধা সেভাবে দেয়া ছাড়া কেবল ডেডিকেশান, ডেডিকেশানই বলেন। ডেডিকেশান আসবে কোত্থেকে। শিক্ষকরাতো পরিবার পরিজনবিহীন কৌপীনধারী সন্ন্যাসী নন। তাদেরও ক্ষুধা আছে, মৌলিক অধিকারের দাবি আছে। এখনও সরকার একশো টাকা দেয় চিকিৎসা ভাতা। আপনারা মাতৃত্বকালীন ছুটি দেন একমাস। একজন মা সুস্থ হতে কমপক্ষে চল্লিশ দিন সময় লাগে। শিক্ষকরা টিউশানী করতে পারবে না। একমাত্র বিজ্ঞান, ইংরেজি ও গণিত ছাড়া অন্য শিক্ষকদের টিউশানির কতটুকু সুযোগ আছে। আপনারা ঢাকা শাহীনের কথা বলেন অথচ যারা সেখান থেকে আসে সেসব ছাত্র-ছাত্রী সেখান থেকে আসে তারা বলে, চট্টগ্রাম শাহীনের শিক্ষকদের মত আন্তরিক ও স্নেহপরায়ণ শিক্ষক তারা সেখানে পায়নি। পাবে কোত্থেকে? ঢাকা শাহীনের লেবেল লাগলেইতো কোচিং বাণিজ্যে তাদের চাহিদা বেড়ে যায়। আর সত্যিই যদি ঢাকা শাহীনের শিক্ষকরা এত দক্ষ হন তাহলে আমাদেরকে দু-একজন করে ওখানে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন। মিটিং হলেই আমরা আমাদের দোষ ছাড়া গুণের কথা কখনো শুনিনি। এখানে সব স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। অথচ একজন ছাত্র ফেল করলে শিক্ষককে জবাবদিহি থেকে শোকজ করা হয়।

          এরকম অনেক কথা ঝটঝট করে এক নাগাড়ে বলে গেলাম। সমস্ত হল চুপ। হারুন সাহেবও নিশ্চুপ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রথম দিনেই এতটা ধাক্কা তিনি হয়তো আশা করেননি। মিটিং শেষ হলে, শিক্ষকরা ভীষণ খুশি। স্যারদেরও অনেকে এসে আমাকে বললেন, খুব ভাল করেছেন ম্যাডাম। আমি নিজেও একধরনের প্রশান্তি অনুভব করছি।

          কিছুদিন পর এক সকালে কলেজে গিয়ে শুনলাম গতরাতে তান্ডব ঘটে গেছে ঘাঁটিতে। কেন, কেন‌ কি হয়েছে? সবার এক জ্ঞিজ্ঞাসা। গ্রুপ ক্যাপ্টেন হারুন  তথা প্রশাসনিক অধিনায়কের হুকুমে রূপসা কোয়ার্টারের অনেকের সবজি ক্ষেত কেটে ফেলা হয়েছে। যারা মুরগি পুষত প্রভোস্টরা তাদের মুরগিগুলো খোপ থেকে বের করে গলা কেটে দিয়েছে।

          বারকোয়ার্টারের ম্যাডামরাও বললেন, আপা জানেন না, মনে হচ্ছিল ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মত ঘটনা ঘটছে। মধ্যরাতে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে আমাদের দু-একটা মোরগ ছিল সেগুলো জবাই করে ফেলে গেল। ঘুম ভেঙে এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। তারপর যা গাছ গাছালি ছিল বিশেষ করে লাউ-শিমের ডগানো লতা সব গোড়া ধরে কেটে দিল। প্রভোস্টরা বলল, ওসি এডমিনের নির্দেশ। ওসি এডমিন সেই হারুন-উর-রশীদ। বারকোয়ার্টারে দক্ষিণ পাশে একটা ঝিল মত ছিল। আমরা থাকতেই তেলাপিয়া চাষ করা হয়েছিল। এই তেলাপিয়া বেশ বড় হত এবং টাটকা তেলাপিয়া ভাজলে এত সুস্বাদু হত যে আমার মেয়েরা যে মাছ খেত না তারাও খেত। এখনও তেলাপিয়া মাছ খেলে আমরা সেই মাছের স্বাদের স্মৃতিচারণ করি।

          হায়, একসময় এটাও বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন! আমি আমাদের বাড়ি থেকে আনা একটা নারকেলে চারা এলে বাসার সামনে লাগিয়েছিলাম। সেটা পরে বড় হয়ে নারকেল ধরত। জানলাম সেই নারকেলও ওরা পেড়ে নিয়ে যায়। অথচ আগে আমরা যার যার সীমানার ফলদ গাছ-গাছালির ফল নিজেরাই খেতাম। সীমাবদ্ধ জায়গায় থাকলে মানুষের দৃষ্টি এবং মনও ক্ষুদ্র গন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে যায়। মনে হয়েছিল এনাদেরও সেই দশা।

          তো হারুন সাহেব একদিন আমার ক্লাস পরিদর্শনে এলেন। তার জন্য চেয়ার এল এবং একটু পর তিনি এলেন। সেদিন নবমশ্রেণির ক্লাসে আমি ব্যাকরণ পড়াব- ণত্ব ও ষত্ব বিধান পড়াব। মনে মনে বললাম বাংলায় প্রবাদই আছে ণত্ব ষত্ব জ্ঞানের অভাব অর্থাৎ কান্ডজ্ঞানের অভাব আসুন একটু শিখে যান।

          আমি বাচ্চাদের নৈর্ব্যক্তিকের জন্য ব্যাকরণটা বুঝিয়ে মুখে মুখেই শেখাতে চেষ্টা করতাম। ক্লাস থেকে গিয়ে মন্তব্য করলেন, ভাল পড়ায়। আলহামদুলিল্লাহ। আর কি বলব।

          এরপর একদিন উনি প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের সাথে মিটিং করলেন। ইচ্ছে মতো অপমান করলেন, ধমক, ঝাড়ি, হুমকি কিছুই বাদ গেল না। তার এই আচরণে সবাই ভীষণ ক্ষুব্ধ হল। কিন্তু কি করার আছে! এরকম হলে শিক্ষকের সম্মান কোথায় থাকে। আর এখানেতো কেউ চোর-চামার নয়। ভদ্র পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তান। আমাদের সন্তান, ছাত্র, আত্মীয়-স্বজনরাই অফিসার হয়। আগে না হয় পাকিসেনারা ছিল। তারা আমাদের ব্লাডি সিভিলিয়ান ভাবত। আর দোষ যদি কিছু করে তো অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন করেছে। দুর্নীতিও সে করেছে। তার সঙ্গী-সাথীসহ তাকে ধরলেই হয়।

          সপ্তাহ ঘুরে গেলে চাপা অশান্তি আর অপমানের জ্বালা যায় না। মনে হলেই মনকে পোড়ায়। হুমায়রা আপা একদিন বললেন, রিফাৎ আপা আমি চাকরি ছেড়ে দেব। এত অপমান সহ্য করে কেন এখানে চাকরি করব। এত ঠ্যাকা নেইআসলেই ওনার ঠ্যাকা নেই। ওনার পারিবারিক সামাজিক শিক্ষা মর্যাদা, স্বামী লোহানী সাহেবের পদবী কোনটাইতো কম নয়।

          তবু বললাম, না চাকরি ছাড়বেন কেন, এত দিনের চাকরি।

          কিন্তু উনি এত বিষণ্ণ হয়ে গেলেন যে রেজিগনেশন লেটার লিখে ফেললেন।

          আমি জানতে চাইলাম, কি কারণ দেখিয়ে চাকরি ছাড়বেন?

          -আমি আর করতে ইচ্ছুক নই লিখব

          -তাহলে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

          -কি বলেন।

          -আপনিতো চলে যাবেন, কিন্তু অন্যদের একটা উপকার করে যান।

          -কি সেটা? উনি জানতে চাইলেন।

          -দরখাস্তে সরাসরি উল্লেখ করুন অমুক তারিখের মিটিং এ হারুন সাহেবের অপমানজনক আচরণে আপনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তাই আপনি আর চাকরি করবেন না।

          কলিগ হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। ভেবে-চিন্তে উনি এটা লিখেই রেজিগনেশন লেটার সাবমিট করলেন।

          কর্তৃপক্ষের কানে গেল। এরকম অভিযোগ করলে হারুন সাহেবকেই দন্ড পেতে হবে। সেটা যেমনই হোক। কাউকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করা! এবার ফিল্ড ইউনিটের লোকজন হুমায়রা আপার বাসায় আসা-যাওয়া শুরু করল, ম্যাডাম রেজিগনেশন উইথড্র করুন।

          অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন ডাকেন, অনুরোধ করেন। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর বললাম, পাখিটির শিক্ষা এখন পূর্ণ হইয়াছেতখন আর কি। অনুরোধের সম্মান আছে আমরা আমরাতো তার ক্ষতি চাইনি। হুমায়রা আপা রেজিগনেশন উইথড্র করলেন। এরপর যতদিন ছিলেন আর পারতপক্ষে আমাদের সামনে আসেননি।

          উইং কমান্ডার আইয়ুব আলী এবং এরকম আরো অনেক অফিসারের কথা শুনতাম যারা বেশ কড়া ছিলেন। কিন্তু কখনও শিক্ষকদের সাথে এসব সিনিয়র অফিসার অসৌজন্যমূলক আচরণ করেননি। বরং কোন সমস্যা নিয়ে গেলে ত্বরিত সমাধান দিতে চেষ্টা করতেন।

          কলেজে মানবিক শাখায় সবসময় শিক্ষার্থী কম থাকত। কিন্তু শিক্ষক ছিল তার চেয়ে বেশিই বলা যায়। রওশন আখতার একসঙ্গে জয়েন করলেও অনেক ছোট বলে ওকে রওশনই ডাকতাম। সমাজতত্ত্বের লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছিল। আগেও বলেছি নাসির ভাই, রওশন আর আমি একই দিনে জয়েন করেছিলাম। কিন্তু মানবিক শাখায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সময়ই একটা গোপন কূটনীতি চলত। সমাজতত্ত্ব বাদ দিয়ে তাদেরকে অন্য বিষয় নিতে উৎসাহিত করা হত। অথচ সমাজতত্ত্ব বিষয় হিসেবে গবেষণা, চাকরি সব ক্ষেত্রেই চাহিদা সম্পন্ন বিষয়।

          রওশন জোরে কথা বলে না। বলতে পারে না। এর মাঝেই আমরা জানতে পারলাম পর পর তিন বছর যে বিষয়ে কোন ছাত্র থাকবে না সে বিষয়ের শিক্ষকের এমপিও বাতিল হয়ে যাবে। ক্লাসে ছেলে-মেয়েদের বলি, এটা ভাল সাবজেক্ট আর ম্যাডামও ভাল পড়ায় তোমরা এটা নাও। তারা বলে, এটা নিতে আমাদের মানা করা হয়। কে বা কারা মানা করে, এটা বললে ওরা চুপ করে থাকে। আমরাও বুঝি কারা মানা করে।

          ওর কান্নাকাটিতে একদিন মজিদ স্যারের কাছে গেলাম, তিনিও সমর্থন দিলেন, হ্যাঁ, এত ভাল সাবজেক্ট এবং টিচার থাকতে ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত হবে কেন? ওনাকে বললাম তাহলে আপনি অনুমতি দিলে ওসি এডমিন স্যারের কাছে যাই।

          ওসি এডমিন তখন উইং কমান্ডার আইয়ুব আলী। তিনি সাথে সাথে লিখে দিলেন, সাবজেক্টটা যেন শিক্ষার্থীদের নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। আর কোন বাধা রইল না।

          মানবিক শাখায় আরও একটি বিষয় নেয়া হল যুক্তিবিদ্যা। শিক্ষক নির্বাচিত হল তৃপ্তি বড়ুয়া।

          প্রশাসনে ইতিমধ্যে আরো একটি পদ তৈরি হল পরিচালনা পর্ষদের সাথে কলেজের যোগাযোগের জন্য। এরা হল লিয়াজোঁ অফিসার। সাধারণত ফ্লাইং অফিসার বা ফ্লাইট লেফটেন্যান্টরা এ দায়িত্ব পালন করত। কথায় আছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। অল্পবয়সী এসব তরুণেরা শিক্ষকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে খুব মজা পেত বলে অনুমান। বয়স্ক শিক্ষকদেরও সম্মান দেখানোর বালাই ছিল না। অধ্যক্ষের কক্ষে এসে চেয়ার দখল করে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকত। কারো কারো চেহারায়- মুই কি হনুরে- এই ভাবের আত্মম্ভরীতা ফুটে উঠত। আমি আসার আগেও একজনকে এরকম দেখে এসেছি। অন্য শাহীনগুলোতে এডজুটেন্ট ছিল ক্যাডেট কলেজ স্টাইলে। এখানে ছিল লিয়াজোঁ।

          স্থানীয় প্রশাসনের একেবারে উচ্চধাপে ছিলেন ঘাঁটি অধিনায়ক। তাঁর সাথে আমাদের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হত মিটিং বা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। এদের মাঝে আজহার স্যারের কথা আগেই বলেছি। তারপর যাদের পেয়েছি তাদের মাঝে শমসের আলী, শফিকুল ইসলাম, কুদ্দুস স্যার, সানাউল হক স্যার অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাক্ষাৎ হলে সৌজন্য প্রকাশ করতেন, কুশল জ্ঞিজ্ঞাসা করতেন।

          শিক্ষক প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগে মিটিং-এ কুদ্দুস স্যার ও সানাউল হক স্যার আন্তরিকতা প্রকাশ করতেন। সিনিয়র শিক্ষক হওয়ার কারণে অনেকসময় নতুন শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ওনাদের সাথে বসতে হত। সানাউল হক স্যার সাহিত্যের খোঁজখবর রাখতেন এবং আলোচনাও করতেন।

          একবার বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের শেষে আমি ওনার কাছে একদিন ছুটি চাইলাম সবার পক্ষ থেকে, তিনি আরো মজা করে বললেন- একদিন কেন, তিনদিন নয় কেন?

          আমি সাথে সাথে মাইকে বললাম, স্যার তিনদিন তিনদিন।

          উনি তিনদিন ছুটি ঘোষণা করলেন। মাঠে ছাত্র-শিক্ষকদের আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল।

          বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য শিক্ষকদের খুব খাটাখাটুনি যেত। কিন্তু অধ্যক্ষ বা ঘাঁটি অধিনায়কের হাতে ৩ দিন (বছরে) ছুটি প্রদানের ক্ষমতা থাকলেও তাঁরা সেটা দিতেন না। ফলে ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় শিক্ষকদের পরদিন এসেই ক্লাসে দৌড়াতে হত। তাই স্যারের সেই ছুটি প্রদান এবং পরবর্তী আনন্দ এখনো আমার কাছে একটি আনন্দময় স্মৃতি।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts