Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - বোবা



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - বোবা
__________________________________________

বোবা 

শ্বশুরবাড়িতে এসে অবধি লোকটাকে নিয়ে শান্তার অস্বস্তি ছিল। বিশাল শরীর মাথায় এক ঝাঁক কাঁচা-পাকা কোঁকড়া চুল, লুঙ্গিটা হাঁটু অবধি গোটানো কালো ঘেঁষা তামাটে শরীর আর চৌকো ধরনের মুখটা দেখলে কেমন যেন গ্রিক ভাস্কর্যের মত মনে হত। সবচেয়ে আশ্চর্য এত বিশাল শরীরের মানুষটার হাসিটা অনেকটা শিশুর মত।

          শান্তা অবাক হয়েছিল শ্বশুর বাড়ির সর্বত্র লোকটার অবাধ গতিবিধি দেখে। যখন তখন ঘরে ঢুকছে। এমন কি নতুন বৌয়ের ঘরের দরজার পাশে চৌকাঠ ধরে কৌতূহল নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত শান্তার দিকে। শান্তা লজ্জা পেত। এতবড় একটা ব্যাটাছেলে সারাক্ষণ চেয়ে আছে এটা দেখলেই অস্বস্তি হত।

          ক'দিন পর সাহেদকে বলেছিলও ব্যাপারটা। শুনে সাহেদ হেসে বলেছিল - "ও তো বোবা। কথা বলতে পারে না। তাই সবকিছু দু'চোখ পেড়ে দেখে। তোমাকে দেখতে হয়তো ভাল লাগে তাই দেখে। আফটার অল পুরুষ মানুষ তো। কিন্তু ওকে নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই। আজ বিশ বছর ও এখানে আছে। কিন্তু কারো কোন ক্ষতি করেছে এমন রেকর্ড নেই।"

          "ধুর, আমি কি তাই বলেছি নাকি? তবু যখন তখন এত বড় একটা মানুষ ঘরে ঢুকে যায় নিষ্পলক চেয়ে থাকে কেমন লাগে না!"

          "কী করবে বল। মা ওকে ভীষণ আদর করেন। ওর ইতিহাস শোননি?"

          "না তো"

          "তাহলে মায়ের কাছে শুনে নিও।"

          পরে শাশুড়ির কাছে শুনেছিল শান্তা। একানব্বইয়ের সাইক্লোনে ঘরহারা স্বজনহারা এই মধ্যবয়সী মানুষটির কথা।

          সেই প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে যখন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল মানুষ আর পশুর লাশ একই সঙ্গে পানিতে ভাসছিল তখন এই শহরটার শতবর্ষী অনেক গাছ শিকড় উপড়ে ভূমিতে উলটে পড়েছিল। চারদিকে কাকের কা-কা রবে কান পাতা দায় তখনই একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে এই লোকটিকে বারান্দায় দেখতে পান।

          বিশাল জোয়ান শরীরটা কুঁকড়ে বারান্দার এক কোণে শুয়ে আছে। একটা লুঙ্গির অর্ধেকটা নেই বাকিটুকু কোনমতে পরা। মাথার চুলে অজস্র বালি। সারা শরীরে বালি-কাদা মাখামাখি।

          মায়ের মনে হয়েছিল আল্লাহ বোধহয় তাকে পরীক্ষার জন্য একে পাঠিয়েছেন। বেলা দশটার পর সূর্যের তাপে বারান্দার মেঝে গরম হয়ে উঠলেও লোকটার কোন সাড় ছিল না। সে তেমনি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল।

          মা দু'একবার কাছে গিয়ে "অ্যাই অ্যাই ছেলে" বলে ডাক দিলেও সাড়া পাননি। দুপুর পড়ে এলে লোকটা জেগে উঠেছিল।

          মা জানতে চাইলেন, "তুমি কে? কোত্থেকে এসেছ?"

          লোকটা ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে চেয়েছিল। একবার দুবার তিনবার প্রশ্ন করলে তাকায় কিন্তু মুখে কোন কথা নেই। শেষে মায়ের মনে হল লোকটা কথা বলতে জানে না। সেই থেকে তার নামকরণ হল বোবা।

          এই শহরের সবাই তাকে ডাকে বোবা বলেখাইয়ে দাইয়ে তাকে সুস্থ করার পর থেকে আজ এত বছর সে সাহেদদের পরিবারেই আছে। মায়ের সাথে থেকেই ঘরের কাজকর্ম শিখেছে। বোবা বলে ডাকলেই তাকায় হাসে কিন্তু কথা তার ফোটেনি। ফোটেনি কারণ মায়ের সন্দেহ হয়তো সে কথা বলতে পারত। ঝড়ের প্রচন্ডতা, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া অথবা স্বজন হারানোর কষ্ট তাকে বোবা করে দিয়েছে।

          মা বোবাকে নিয়ে প্রথম ভয় পেয়েছিলেন প্রায় ছ'মাস পরে আবার ঝড় আসার পর। সেদিন মেঘের গর্জন আর বাতাসের মাতলামি যেন পাগল করে দিয়েছিলগোঁ গোঁ করে একটানা একটা জন্তুর মত শব্দ করে দেয়ালে মাথা কুটেছিল বোবা। এক সময় বিভ্রান্তের মত ছুটে গিয়েছিল বাইরে।           

            তারপর ঝড় থামলেও বোবাকে পাওয়া গেল না। আর এত অন্ধকারে ঝড়ের রাতে খুঁজলেই কি পাওয়া যায়! টর্চ নিয়ে মা আর সাহেদের বাবা এদিক ওদিক খুঁজে ফিরে এসেছিলেন। সেই রাতে সারা রাত মা ঘুমাতে পারেননি।

          ভোর বেলা দরজা খুলতে দেখেন বোবা বারান্দায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। মা কাছে গিয়ে কপালে হাত দিতেই তার দিকে তাকিয়ে সেই শিশুর হাসি।

          মা ইশারায় জানতে চেয়েছিলেন - "সারা রাত কোথায় ছিলি?"

          সে আঙুল তুলে উঠোনের জোড়া আমগাছটা দেখিয়ে দিয়েছিল।

          যে বয়সে সে এখানে এসেছিল তখন সে জোয়ান পুরুষ। মায়ের ধারণা হয়তো একদিন তার সবই ছিল- মা-বাবা বৌ-বাচ্চা। ঝড়ের তান্ডবে সব হারিয়ে আজ সে ভাষাহারা। না হলে কানে শোনে অথচ কথা বলতে পারে না কেন? আর কেন শিশুদের দেখলে সে এত বেশি অস্থির হয়ে পড়ে?           কিন্তু এত বছরেও জানা গেল না কোথায় তার ঘর, কোথায় তার বাড়ি। মা আরও বলেন মানুষের নির্মমতার কথা।

          এই অসহায় ভাষাহীন মানুষটাকে সুযোগ পেলেই ধরে নিয়ে যায় এই শহরের মানুষেরা। তিন-চারদিন রেখে পশুর মত খাটায়। তারপর সুযোগ বুঝে এই বাসার কাছাকাছি ছেড়ে দিয়ে যায়।

          প্রথমবার যখন এরকম ঘটেছিল মা ভেবেছিলেন সে হারিয়েই গেছে। তিনদিন পর যখন ফিরে এল তখন সে হাঁটতে পারছে না। ইশারায় যা বোঝাল তাতে এটুকু বোঝা গেল কেউ কেউ সম্ভবত তাকে মাটি কাটার কাজে লাগিয়েছিল। মজুরিতো দূরে থাক খাবারও ঠিকমত দেয়নি।

          শহরের লোকেরা এখন তাকে চিনে গেছে। জানোয়ারের মত খাটতে পারে নিশব্দে। তাই ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়। মা তাই চোখে চোখে রাখেন বোবাকে।

          শান্তারও এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু তারপরও অস্বস্তিটা মরে না। বোবার চাহনি সবসময় শান্তার চলাফেরাকে অনুসরণ করে যেন। কখনো কখনো পিছন থেকেও তার সতৃষ্ণ দৃষ্টি যেন শান্তাকে কাঁটার মত বিঁধে।

          তবে এটাও ঠিক বিয়ের পর দু'বছর এ বাড়িতে আছে শান্তা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোন কিছু করেনি বোবা। যখন থেকে শান্তার পেটে বাচ্চা এসেছে এবং শরীরে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন থেকে শান্তা লক্ষ্য করেছে বোবার দৃষ্টি যেন আরো খর হয়ে উঠেছে। মনে হয় লোকটার দৃষ্টি যেন ওর সমস্ত শরীরটা লেহন করছে।

          ক'দিন আগে অস্বস্তি লুকোতে না পেরে সাহেদকে আবারও বলেছিল "বোবার চাউনি আমার একদম ভাল লাগে না। কেমন করে যেন তাকায় আমার দিকে।"

          সাহেদ ঠাট্টা করে - "আরে ওর কি আর বয়স আছে? আসলে যেটা হয়েছে আমাদের ঘরে এর আগে মা ছাড়া আর কোন মেয়েছেলে ছিল না তো। তাই তোমাকে দেখে অবাক হয়। অথবা দেখতে ভাল লাগে। এসব নিয়ে এত ভেবো নাতো" বলে শান্তাকে কাছে টেনে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিল।           

        কিন্ত কালকে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা শান্তা কাউকে বলতে পারছে না। দুপুরে গোসল করে এসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ আয়নায় একটা বিশাল ছায়া পড়তে দেখে শিউরে উঠল শান্তা।

          আর তক্ষুনি মাথা নিচু করে ছায়াটা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঐ একটুখানি দেখায় শান্তা দেখেছে তার চোখ দুটোতে কেমন একটা লোভ ঝিকিয়ে উঠেছে।

          কেমন একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে যায় শান্তার। এমনিতে এখন শরীরে নানা অশান্তি। ভাল ঘুম হয় না। এখন মনে হচ্ছে মুখের ওপর একটা গরম বাতাস লাগছে। শান্তা চোখ মেলে তাকাতে দেখে একটা জান্তব মুখ তার মুখের ওপর।

          ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যায় সে। কিন্তু সাঁড়াশীর মত দুটো হাত তার মুখ নাক চেপে ধরে। শান্তার দম বন্ধ হয়ে আসে। ছটফট করতে করতে এক সময় তার শরীরটা নিথর হয়ে আসে।

          সারা বাড়িতে অসংখ্য লোকের সমাগম। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছেশান্তার মুখটা দু'হাতে ধরে লোকটা গোঁ গোঁ করছে। কিন্তু কেউ তার হাত দুটো ছাড়াতে পারছে না।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts