৩
রুটিন অনুযায়ী আমার
প্রথম দিনের ক্লাস ছিল অষ্টম শ্রেণীতে বাংলা ১ম পত্র। ক্লাসে ঢুকতেই একজন ছাত্র
হাঁক দিল “ক্লাস সিট
টু শান” মানে
এ্যাটেনশান। দুপাশে ভাগ করে বসা ছাত্র-ছাত্রীরা দুহাত মুঠো করে হাইবেঞ্চের ওপর
সোজা করে রেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আমি এই হাঁকে মনে মনে কিছুটা থমকে গেলেও
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে রোস্ট্রামে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর পাঠ-উপকরণ রেখে পুরো
ক্লাসটা এক চক্কর দিলাম।
-ম্যাডাম ‘সিট ইজি’ বলবেন না?
-ও আচ্ছা, ‘সিট ইজি’। বলার পর তারা স্বাভাবিক হয়ে বসল। বুঝতে পারলাম পরবর্তীতে
এটা বলতে হবে।
বোর্ডে
তাকিয়ে দেখলাম বিশাল বোর্ডের একপাশে দিন, তারিখ, বার, শ্রেণি শিক্ষক ও বিষয়
শিক্ষকের নাম, বোর্ডের মাঝখানে পাঠদানের বিষয় সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা। বোর্ডের
পাশে দেয়ালে সফট বোর্ডে ক্লাস রুটিন লেসন প্ল্যান আর শিক্ষার্থীদের আঁকা দু-তিনটি
ছবি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাচ্চাদের খাতা। বাড়ির কাজ-শ্রেণির কাজ প্রত্যেকটা খাতাই ঝকঝকে,
শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা মুক্তোর মত। তখন বাড়ির কাজ, শ্রেণি কাজের খাতা টার্ম
শেষে মূল্যায়ন করে যে নম্বর দেয়া হতো সেটি পরীক্ষার নম্বরের সাথে যোগ হত।
আবার কেজি থেকে ক্লাস টু পর্যন্ত যারা
ক্লাস নিতেন তাদের বলা হত ফরম টিচার। কারণ তারা এসব ক্লাসে একজনই সব বিষয় পড়াতেন।
এদের সবাই ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ এবং কারো কারো হাতের লেখা অপূর্ব সুন্দর। যেমন সৈয়দা
শামসুন নাহার। ওনার কাছে যারা ছোটবেলায় হাতের লেখা শিখেছে তাদের লেখা দেখেই বোঝা
যেত এরা নাহার ম্যাডামের হাতে গড়া।
অন্যদেরও ভাল ছিল। যেমন কাওসার
সুলতানা আর কলেজের ইংরেজির লেকচারার সংযুক্তা দাশ। সংযুক্তার ইংরেজি হাতের লেখা
আগে বোর্ডের সার্টিফিকেট যারা লিখত তাদের মত। সেও নাহার আপার কাছে বাংলা লেখা মকশো
করেছে। আমাদের ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভি আই পি দের আমন্ত্রণপত্র কলেজের
মনোগ্রাম ছাপানো বিশেষ কার্ডে সংযুক্তাকে লিখতে হত। ভাবতে কষ্ট হয়, এই সংযুক্তাকেও
কলেজ কর্তৃপক্ষ তার প্রাপ্য সম্মান-মর্যাদা সেভাবে দেয়নি যে কারণে চৌদ্দ বছর চাকরী
করে প্রায় শূন্য হাতে তাকে চলে যেতে হয়। পরবর্তীতে সে হালিশহরে অবস্থিত SOS স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল হয় এবং এখনো কর্মরত আছে।
তখন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা
কম ছিল। বেশির ভাগ রূপসা কলোনীর ছেলে-মেয়ে যাদের বাবা এয়ারফোর্সে
চাকরি করতেন। কিছু অফিসারের বাচ্চা এবং আশে পাশে অবস্থিত পদ্মা অয়েল (তখনো বার্মা
ইস্টার্ন), ইস্টার্ন রিফাইনারী, স্টিল মিল এবং কাটগড় ও পতেঙ্গার কিছু ছেলে-মেয়ে
এবং নেভীর ইশা খাঁ নৌ ঘাঁটির অফিসার ও নৌসেনাদের সন্তান। নেভীর বাচ্চারা বিশাল এক
বাস ভর্তি করে আসত। যদিও নেভী, রিফাইনারী এবং স্টিলমিলেরও স্কুল ছিল কিন্তু
সেখানকার অনেক অভিভাবকই বিশেষত উচ্চপদস্থরা তাদের বাচ্চাকে শাহীনে পড়াতে চাইত।
কারণ এতদঞ্চলের স্কুলসমূহের মধ্যে শাহীন শিক্ষণ পদ্ধতি, নিয়ম শৃঙ্খলা ইত্যাদি
বিষয়ে এক নম্বরে ছিল।
তৎকালীন অধ্যক্ষ গোলাম মহীউদ্দীন আদমজী
ক্যান্ট পাবলিকের অধ্যক্ষ পদ থেকে এখানে এসেছিলেন, শিক্ষার পাশাপাশি, শৃঙ্খলা ও
পরিবেশের পরিচ্ছনতার উপর তিনি খুব বেশি লক্ষ্য রাখতেন। আবার সিভিলিয়ান অধ্যক্ষ
হিসেবে তিনি বিমান বাহিনীর অফিসারদের বিষয়ে অত্যন্ত তটস্থ থাকতেন। সবচেয়ে অবাক
লাগত অফিসারদের স্ত্রীরা কলেজে এলে কন্যাসম অল্পবয়সী এসব ভদ্রমহিলাকে তিনি ভাবী
ডাকতেন এবং তারাও তাকে ভাই বলে সম্বোধন করত। ব্যাপারটা আমার কাছে বিসদৃশ ঠেকত কারণ
একজন অধ্যক্ষ যিনি বয়সে প্রবীণ এবং শিক্ষা ও পদমর্যাদায় অনেক ওপরে তাকে অফিসার
পত্নীরা কিভাবে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন।
অফিসিয়াল ডেকোরাম বলেও একটা কথা আছে। অবশ্য তখন একটা কথা প্রচার ছিল জানি না
কতটুকু সত্য, অফিসারদের চেয়ে তাদের স্ত্রীরা এক র্যাংক ওপরে, অর্থাৎ স্বামী
স্কোয়াড্রন লিডার হলে স্ত্রী উইংকমান্ডার পদমর্যাদার অধিকারী। তবে এটা ঠিক এসব
স্ত্রীরা স্বামীর পদ ও পদবীর ভারে একটু গরবিনীই হতেন। অবশ্য ব্যতিক্রমও ছিল। তাদের
কথা পরে হবে।
ক্লাস নিচ্ছি হঠাৎ মনিটর দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাডাম, ‘পপটেস্ট’ নেবেন না? মেয়াদী
পরীক্ষাতো এসে যাচ্ছে”।
পেটটা
গুড়গুড় করে উঠল। বুকে পেটে বেশ চাপ তৈরি হল। তবু চাপ সামলে বললাম- সেটা কেমন?
মনিটর জানাল- ক্লাসে যে পড়া দেয়া হয় তার
ওপর ভিত্তি করে শিক্ষক যে কোনদিন ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক ১০ নম্বরের পরীক্ষা নেন।
পরীক্ষার নম্বর সাময়িক পরীক্ষার সাথে যোগ হবে। এরপর আছে ক্লাসটেস্ট যেটা ঘোষণা
দিয়ে হয়। ফলে তখন সাময়িক পরীক্ষা হতো সম্ভবত ৭০ নম্বরের। পপটেস্টের উপকারিতা পরে
উপলব্ধি করেছিলাম। এর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল কখন কোন স্যার-ম্যাডাম পরীক্ষা নেয়
সেই ভয়ে শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি থাকত প্রায় শতভাগ। এবং লেখাপড়ায়ও নিয়মিত
থাকতে চেষ্টা করত।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পরপরই ভর্তি
প্রক্রিয়ার শুরু হল। বিজ্ঞান শাখায় ২টি এবং মানবিকে একটি সেকশান হবে এটাই ছিল
সিদ্ধান্ত। ভর্তির আগে তৎকালীন ঘাঁটি অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আজহারুল হক, যিনি
পদাধিকার বলে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিও ছিলেন, ঘাঁটির অভিভাবকদের নিয়ে সভা ডাকলেন। ঘাঁটির যা কিছু
কর্মকান্ড বি.আর.ও তে দেয়া হত এবং এর ফলে সবাই ঘাঁটির প্রশাসনিক কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত থাকত। নির্দিষ্ট দিনে
RTS (রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুল) অডিটোরিয়ামে সবাই উপস্থিত। মঞ্চে উপবিষ্ট
হলেন সভাপতি, পর্ষদ সচিব, অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ।
বিশাল হলের একপাশে মহিলা শিক্ষকবৃন্দ, অন্যপাশে অভিভাবক
ও পুরুষ শিক্ষকবৃন্দ। অডিটোরিয়াম দেখেতো চক্ষুচড়কগাছ! কারণ ইতোপূর্বে এত বিশাল
মঞ্চ, আসন সংখ্যা, এবং সুসজ্জিত অডিটোরিয়াম আমি ঢাকা-চট্টগ্রাম কোথাও দেখিনি।
বেইলি রোডে মহিলা সমিতি মঞ্চ, চট্টগ্রামের মুসলিম ইনিস্টিটিউট আর জামালখানের
সেন্টমেরিস স্কুলের অডিটোরিয়ামের এগুলো ছিল খুবই সাধারণ এবং মুসলিম ইনিস্টিটিউট
ছিল একেবারে ‘ধ্যাদ্ধাড়ে
গোবিন্দপুর’।
আজহার স্যার অভিভাবকদের অনুরোধ করলেন
তাঁরা যেন নিজ নিজ সন্তানকে শাহীন কলেজেই ভর্তি করান। তিনি নিজে শহরে যাতায়াতের
সমস্ত সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও তাঁর মেয়েকে এই কলেজেই ভর্তি করাবেন। কলেজের জন্য যথেষ্ট
ভাল শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিমানবাহিনীর সদস্যরা যদি তাদের সন্তানকে এখানে
ভর্তি না করান তাহলে বাইরের এলাকা থেকে ছাত্র-ছাত্রী আসতে উৎসাহিত বোধ করবে না।
অভিভাবকরা একবাক্যে মেনে নিলেন। কারণ
অধিনায়কের কথা অমান্য করার বিধান সামরিক বাহিনীতে নেই। কিন্তু আমার মনে আছে, তিনি
অনুরোধ করেছিলেন, যুক্তি দিয়েছিলেন কিন্তু আদেশ করেননি। তবুও তাদের কাছে এটাই আদেশ। আর এখনকার
মত শহরে যাতায়াতের ব্যবস্থা এত সহজ ও সুলভ ছিল না। শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে
বঙ্গোপসাগরের তীরে বামপাশে কর্ণফুলি নদী ঘেঁষে পতেঙ্গা অপর পাশে সমুদ্র ঘেঁষে
কাটগড়। মুড়িরটিন মার্কা কিছু লক্কড় ঝক্কড় বাসই তখন এই রুটে চলত।
তখন হালিশহর এবং শহর থেকে (পাঁচলাইশ)
বিমানবাহিনীর দুটি বড় বাস যারা বাইরে থাকত তাদের আনা-নেয়া করত। পাঁচলাইশে
বিমানবাহিনীর একটি ছোট অফিসও ছিল। শিক্ষক-শিক্ষিকা যারা শহরে থাকতেন তারা এই বাসে
আসা যাওয়া করতেন। এই বাস ঘাঁটিতে প্রবেশের সময় ছিল আনুমানিক সাড়ে সাতটা আর দিনের
কাজ শুরুর ভোঁ সাইরেন বাজত আটটায়। ছুটি হত
দুটোয়। তারপর গাড়ি বিভিন্ন অফিস থেকে বিমান সেনা ও সিভিলিয়ান কর্মচারীদের পিক করে
কলেজ গেটে আসতে আসতে তিনটা বেজে যেত। এর মাঝে হঠাৎ করে পপটেস্টের মত কোন কোন দিন
ঘোষণা দিত আজ প্যাক আপের গাড়ি যাবে না। তখন আমাদের মাথায় বাড়ি পড়ত। কলেজের স্থানিক
অবস্থানের কারণে কাটগড় গেট (মেইন গার্ডরুম) কাছে হলেও সেখানে কোন যানবাহন পাওয়া
যেত না। তখনো প্রায় গ্রাম কাটগড়ের সরুরাস্তা দিয়ে রিক্সা বা ট্যাক্সি ছাড়া আর কিছু
চলত না। যাত্রী কম থাকার কারণে রিক্সাও পাওয়া যেত না। অন্যদিকে কলেজ থেকে
এমবারকেশন গার্ডরুমের দূরত্বও দেড় কিলোমিটারের কম ছিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
স্কুল-কলেজ মিলিয়ে কমপক্ষে পাঁচটা এবং কখনো কখনো ছটা ক্লাস নেয়ার পর মানসিক বা
শারীরিক শক্তি থাকত না অতদূর হাঁটার। তবুও দলবলে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ হাঁটতে হত। তারপর
গেটের বাইরে শিরিষগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা- বাস ‘কখন আসে, কখন আসে’। নিদেনপক্ষে একটা অটোরিক্সা (ট্যাক্সি) যাতে ম্যাডামরা
চাপাচাপি করে পারলে একজন আরেকজনের কোলে বসে বাসায় ফেরা যায়।
আমার বাসা ছিল তখন আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায়;
যাকে সংক্ষেপে সি ডি এ বলা হত। আমার বড় মেয়ে রাকা তখন সি ডি এ-র ‘হাতেখড়ি কিন্ডার
গার্টেনে’ ক্লাশ টু
তে পড়ত। ছোটজন তখনও আড়াই বছরের। সাথে থাকতেন শাশুড়ি, আমার বাবা আর ছোটবোন মলি।
আবাসিক এলাকার স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে সে মা এবং ভাইয়ের কাছে ঢাকা চলে গিয়েছিল
কলেজে পড়ার জন্য। আমি চাকরি পাওয়ার পর তাকে আবার নিয়ে এলাম এখানেই কলেজে পড়ার
জন্য।
এদিকে কলেজ শুরু করার পর ঐ লাল দালানে
স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। তাই কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল শিফট করার। সম্ভবত অষ্টম
শ্রেণি পর্যন্ত সকালের শিফট। তারপর সাড়ে এগারোটা থেকে নবম থেকে একাদশ শ্রেণি।
আমরা যারা কলেজে ক্লাস নিতাম তাদেরকে
নিচের দিকেও বিভিন্ন ক্লাস নিতে হত। বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক হওয়ার কারণে
অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাসগুলো কলেজ শিক্ষকরাই বেশি নিতেন। আমি তখন ক্লাস এইট
থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিতাম। এরপর থাকত Adjustment বা সমন্বয় ক্লাস। অর্থাৎ কোন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তার ক্লাসটি করা। এর
ফলে অনেক সময় দিনের রুটিনের সাতঘন্টায় ৭টা ক্লাসই করতে হত। এসব ক্লাস আবার পুরোটাই
দাঁড়িয়ে নিতে হত। ফরম টিচার ছাড়া আর কারো বসার জন্য চেয়ার-টেবিল থাকত না। অবশ্য
পড়াতে গেলে বসা যায় না।
এডজাস্টমেন্ট ক্লাসের নিয়ম ছিল কলেজের
শিক্ষক হলেও তাকে কেজি ক্লাসের এডজাস্টমেন্ট ক্লাসও নিতে হবে। অনেকের হয়তো এতে অহং-এ আঘাত
লাগত। কিন্তু আমার মনে হয় এর সবচেয়ে ভাল দিক ছিল স্কুল-কলেজ বলে শিক্ষকদের মাঝে কোন পার্থক্য ছিল না। সমযোগ্যতার অধিকারী
অর্থাৎ (বিএ, এমএ অথবা অনার্স) শিক্ষকরাই স্কুলে পড়াতেন। তাই ইনফিরিয়রিটি অথবা
সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স ছিল না। আমরা সবাই ছিলাম একটা পরিবারের মত। আর শিশুদের
ক্লাসে যাওয়া আমার কাছে আনন্দময় বিষয় ছিল।
তো দুই শিফট ক্লাস শুরু হওয়ার পর আমরা
যারা কলেজের এবং শহর থেকে আসা-যাওয়া করতাম তাদের জন্য দেওয়া হত সিক্সটনার।
শিক্ষিকাদের মধ্যে ছিলাম আমি এবং রওশন আকতার। আবার বিকেলে সেই সিক্সটনে ফেরা। এই
গাড়ি আসলে গুদাম থেকে বিমানবাহিনীর সদস্যদের জন্য রেশন আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হত।
মাঝখানে মালের জায়গা খালি রেখে দুপাশে টানা বেঞ্চি বসার জন্য। সমস্যা ছিল রাস্তা
থেকে সিক্সটনে ওঠা-নামা করা। পিছনের ঢাকনা খুলে দিলে কোন রকমে কারো হাত ধরে বা
গাড়ির রড ধরে উঠতে হত। আর নামার সময়? লাফ। এই লাফ দিয়ে নামা খুব হাস্যকর ছিল,
লজ্জারও ছিল। কেননা বিমান বাহিনীর কলেজে চাকরি নিয়ে এভাবে ওঠা-নামার সময় বিব্রত
বোধ করতাম। কারণ আশেপাশে পরিচিত কারো চোখে পড়লে প্রেস্টিজ পাংচার!
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার বাবা
বললেন, এভাবে তো সম্ভব নয়। তোমার মেয়ে যায় সকালে স্কুলে। তুমি যাও দশটায়। তারপর
আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
এর আগেই শুনেছিলাম বিমানবাহিনী অফিসার্স
কোয়ার্টারের পাশে ১২ কোয়ার্টার নামে ১২টি কোয়ার্টার আছে। আগে এগুলোতে অফিসাররা
থাকতেন। পরে অফিসারদের জন্য কোয়ার্টার হয়ে গেলে তারা এগুলো ছেড়ে দেন এবং
কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
এই কোয়ার্টারগুলো অনেক পুরনো। মনে হয়
বিমানবাহিনী ঘাঁটি বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হওয়ার আগে যখন এটি এ্যারোড্রাম ছিল।
তখন সম্ভবত এগুলো তৈরি হয়েছিল। সুতরাং বৃটিশ না পাকিস্তান কোন আমলে এই
কোয়ার্টারগুলো হয়েছিল তার খোঁজ কাউকে জ্ঞিজ্ঞেস করেও পাইনি। একটা সীমানার মাঝে
দক্ষিণ পার্শ্বে পুবে-পশ্চিমে ছটি এবং উত্তর পার্শ্বেও একই সারিতে ছটি কোয়ার্টার।
এজন্য নাম ছিল বারো কোয়ার্টার। সীমানার বাইরে দক্ষিণ পাশে আরেকটি কোয়ার্টার ছিল। ঠিক
তার উল্টোদিকে গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারের দেয়ালঘেরা সুন্দর সুপরিসর বাংলো। গ্যারিসন
ইঞ্জিনিয়ার সাধারণত সিভিলিয়ান হতেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ হয়তো ভাবলেন একজন
সিভিলিয়ান এতবড়ো বাংলো দখল করে থাকবে! তাই তারা গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারকে অফিসার্স
কোয়ার্টারে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়ে উইং কমান্ডারদের এই বাংলো বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তখন
অফিসারের সংখ্যা এত বাড়েনি। ঘাঁটি অধিনায়কই থাকতেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এবং অন্যান্য
দপ্তরের অধিকর্তারা উইং কমান্ডার পর্যায়ের।
বার কোয়ার্টারে বাসা নেয়ার জন্য এর আগেই
সামসুন নাহার ও হোসনে আরা ম্যাডাম আমাকে উৎসাহ এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার
মনে হচ্ছিল আগে স্বচক্ষে দেখতে হবে বাসাগুলো কেমন। একদিন বিকেলে ট্যাক্সিতে চেপে
বাচ্চাদের নিয়ে আমরা গেলাম কোয়ার্টার দেখতে।
এক নম্বর কোয়ার্টারে থাকতেন হোসনে আরা
ম্যাডাম। ওনার বাসাতেই গেলাম। আপা-দুলাভাই প্রথম দিনেই আপন করে নিলেন। সব দেখলাম
পুরনো দিনের অনেকটা রেলওয়ের কোয়ার্টারের মত। উঁচু সিলিং, পাশাপাশি দুটো রুম, একটা
বেশ প্রশস্ত, অন্যটাও একেবারে ছোট নয়। ১নং কোয়ার্টারে হুসনা আপারই একটা রুম বেশি
ছিল। সামনে পিছনে নেট দেয়া টানা বারান্দা যেগুলো দুটো রুমের সমান। পিছনে বাইরে
টিনঢাকা টানা বারান্দা। তার একপাশে রান্নাঘর, তারপর বাথরুম, শেষে টয়লেট। রান্নাঘর পিছনের
বারান্দার দিকে দরজা দিয়ে সংযুক্ত। গ্যাস আসার আগে কাঠের চুলোয় রান্না হত বলে
রান্নাঘরের ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য চিমনি ছিল। সামনে দেয়ালঘেরা উঠান। পেছনের দরজা
দিয়ে বের হলে পাকা ড্রেন পানি নিঃসরণের জন্য। তারপর দূরের ড্রাইডকের আগে পর্যন্ত
যতদূর দৃষ্টি যায় নিচে সবুজ ঘাস আর
আগাছিলেতে ঢাকা মাঠ, তারপর ধানক্ষেত আর ওপারে অপার আকাশ।
বাসাভাড়া সর্বসাকুল্যে ২৩০ টাকা, গ্যাস,
পানি, ইলেকট্রিসিটি Including all। শহরে তখন আমরা বাসাভাড়া দিতাম ১৪০০ টাকা, সিলিন্ডার গ্যাস, বিদ্যুৎবিল সব
আলাদা। পানিসংকট ছিল প্রকট।
বাবাকে এসে বললাম। সব শুনে বললেন, গেলে ব্যবস্থা
হবে। তোমরা বাসার
জন্য দরখাস্ত কর। আমাদের দুজনের দ্বিধা তবু যায় না। আম্মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ী
আছেন। আমার বিয়ের পর থেকে উনি স্থায়ীভাবে আমাদের সাথে থাকেন। মাঝে মাঝে গ্রামের
বাড়িতে বা অন্য ছেলে মেয়েদের বাসায় যান, সেটা বেড়াতে।
বাসা বরাদ্দ হওয়ার পর বাবাকে নিয়ে
গেলাম। একটু বেলাবেলি। যাতে সবকিছু ভাল করে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। দেখে বাবার
পছন্দ হল। সেদিন গেলাম প্রতিবেশী দিলরুবার বাসায়। তাঁর স্বামী মকসুদ সাহেব বিমান
বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। গণিতশাস্ত্রে অনার্স-মাস্টার্স। দিলরুবা উদ্ভিদবিজ্ঞানের
শিক্ষক। আলাপচারিতায় জানা গেল দিলরুবার মেজবোন সাজেদা রুবী (চট্টগ্রাম ইস্পাহানী
স্কুলের বাংলার শিক্ষক) আমার কুমিল্লা মহিলা কলেজ এবং হোস্টেলের বন্ধু। আর কি,
দিলরুবা আমার ছোটবোন হয়ে গেল। নবদম্পতি আন্তরিকভাবে আমাদের আপ্যায়িত করল।
বাসায় এসেও আমরা দুজন ভাবছিলাম- আমরা
এতজন মানুষ, সংসারের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে এই দুই রুমে জায়গা হবে
কিভাবে। বাবাই সিদ্ধান্ত দিলেন, সামনে পেছনে টানা বারান্দা দুটো নেট দেওয়া।
এগুলোকে এদিক ওদিক করে রুম হিসেবে চালিয়ে নেয়া যাবে। আগে বাসা নাও।
অতএব সিদ্ধান্ত হলো বাসা নেব। তখন আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, সহপাঠী এবং বন্ধু একের ভিতর তিন এই ত্রয়ী ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আমজাদের জহুর ঘাঁটিতে পোস্টিং। সে বিমানবাহিনীর একটা বিশাল ট্রাক নিয়ে দিল। সেটাতে সংসারের সব এঁটে গেলে আমরা দুটো ট্যাক্সি নিয়ে পতেঙ্গা রওনা দিলাম (৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫) দুপুরের পর। শুরু হল আমাদের বিমানবাহিনী ঘাঁটির জীবন।
*****
No comments:
Post a Comment