Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৮

  -----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

মোবাইলটা বাজতে হাতে তুলে নিল শীলা তপন ফোন করেছে তার মানে খারাপ খবর খালাম্মা কি তাহলে নেই? ধুর ছাই! কি আজেবাজে ভাবছি তাড়াতাড়ি রিসিভ বাটন টিপে হ্যালো বলতে ওপাশ থেকে তপনের গলা শোনা গেল। "আপা, আপনি কোথায়?"

          "কলেজে"

          "খালাম্মা মারা গেছেন"

          "কখন?"

          "সাড়ে নয়টার দিকে"

          "এখন?"

          "এখন বাড়িতে নিয়ে যাবে রাতেই দাফন হয়ে যাবে"

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপন প্রশ্ন করল, "আপনি কি আসবেন আপা?"

          "দেখি আগে তোর দুলাভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি তারপর তোকে জানাবো তুই যাচ্ছিস তো?"

          "আমি তো দুইদিন আগে থেকেই সুবর্ণগ্রামে আছি জহিরভাই সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য আমাকে পাঠালেন"

          "আচ্ছা ঠিক আছে তুই তোর কাজ কর আমি আসতে চেষ্টা করব কিন্তু ওদের কাউকে কিছু বলিস না, কেমন?"

          "আচ্ছা"

          "রাখি খোদা হাফেজ"

          এবার মামুনকে ফোন করলো মামুন শুনেই ইন্নালিল্লাহ্‌ পড়ল এতক্ষণে শীলার মনে হল আসলে তারওতো পড়া উচিত ছিল আশ্চর্য! প্রত্যাশিত খবরটা শুনে শীলা কেমন হতচকিত হয়ে পড়েছিল একঝাঁক তীরের মত অনেকগুলো স্মৃতি মুহূর্তে ছুটে এসে মাথাটা কেমন এলোমেলো করে দিল

          "কী চুপ করে আছো যে? এখন কী করবে? যাবে?"

আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে শীলা জবাব দিল, "হ্যাঁ, যাবো"

          "ঠিক আছে আমিও বাসায় আসছি তুমিও গিয়ে রেডি হও আজকেতো নির্ঘাত থাকতে হবে ফিরে আসাতো যাবে না"

          কলেজের ক্লাসটা নেয়ার দায়িত্ব জুনিয়র একজনকে দিয়ে অধ্যক্ষের কা থেকে ছুটি মঞ্জুর করে কলেজ কম্পাউন্ডের বাইরে এসে একটা রিক্সা নিল শীলা

          বাসায় এসে দেখল এরই মধ্যে মামুন এসে গেছে মহুল আর মনিকা বাসাতেই ছিল সামনে ওদের পরীক্ষা থাকায় ক্লাস সাসপেন্ড

          গোসল সেরে একটা জর্জেট শাড়ী পরে নিল শীলা কাঁধের ব্যাগটাতেই একটা ফেস টাওয়েল, ব্রাশ এরকম খুব দরকারি দুয়েকটা টুকিটাকি নিল মামুন এক কাপড়েই তৈরি বুয়াকে আর ছেলে-মেয়েকে বার বার সাবধান করে বাসা থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ডে এল ওরা টিকেট করে কাউন্টারে বসে এতক্ষণে দু'জনে কথা বলার সময় পেল

          "কতদিন পর বাড়ি যাচ্ছি বলো তো?"

          "তা প্রায় একযুগেরও বেশি হল" মামুন জবাব দিল

          "হ্যাঁ, দু'হাজার সালে বাবার মৃত্যুর পর আর যাওয়া হয়নি" বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে এল শীলার মন "খালাম্মা, আমার খালাম্মা কত আদর করেছেন অথচ কতদিন আমি তাঁকে দেখিনি, দেখতে যাইনি" বলতে বলতে শীলার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।

          শীলার মায়েরা পাঁচবোন ছিলেন মামা ছ'জন মেজখালা তৌহিদা আর মায়ের পিঠোপিঠি বড় বোফরিদা ছিলেন জা শীলার জন্মের পর    যখন মা ফাহমিদার মৃত্যু হয় তখন নিঃসন্তান ফরিদা তাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন বোধ হওয়ার পর থেকে শীলা তাকে মা বলেই জেনেছে

          পৃথিবীতে আম্মা ফরিদা ছাড়া তার আরও একজন মা ছিল যিনি তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ব্যাপারটা ভাবতে কষ্ট হলেও আজও আম্মা ছাড়া আর কাউকে মা বলে ভাবতে পারে না সে বিয়ের আগে মনে হতো হয়তো সন্তান হলে নিজের মায়ের জন্য কষ্টের অনুভূতিটা ফিরে পাবে কিন্তু সত্যি বলতে কি, যে মা তাকে অনেক বেশি স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে লালন করেছেন প্রথম সন্তান মহুলকে দেখে সে মা এবং বাবার আনন্দ উচ্ছাসে অন্য কারো কথা মনে আসার সুযোগই হয়নি

          বাবা! মনে মনে ভাবতেই অজান্তে একটুখানি বিষন্ন হাসি ফুটে উঠল শীলার মুখে আর সেটা লক্ষ্য করে মামুন জানতে চাইল, "কী এত ভাবছ সেই তখন থেকে?"

          "ভাবব আর কী, জীবনে ভাবার কি শেষ আছে ভাবছিলাম তুমি না থাকলে জীবনে বাবাকে আমিকাকাবলেই কাটিয়ে দিতাম" বলে আবেগে মামুনের ডানহাতটা নিজের বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল মামুনও হাতটা ধরে মৃদু কোমল চাপ দিল

          বাসে উঠে বসতেই বেশি দেরি করল না বাসটা চট্টগ্রাম শহর ছাড়তেই মোটামুটি গতি পেল শনিবার হওয়াতে যানজটও কম পড়ন্ত বিকেলে হেমন্তের রোদ্দুর কমলা রঙ ধরেছে প্রকৃতিতে কেমন একটা বিষন্ন সৌন্দর্য শীলা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসল

          সুবর্ণগ্রামের শৈশব যেন তার চোখের সামনে সিনেমার রিলের মত ছুটে চলেছে কোনটা আগে কোনটা পরে অনেক সময় মনে করতে পারছে না আম্মা, খালাম্মা, কাকা, দাদী, জেঠু আরও পাঁচপাঁচটি ভাইবোন নিয়ে তাদের যৌথ পরিবার অনেক জমিজমা থাকায় অভাব অনটন ছিল না খালাত ভাইবোনদের সাথেই বাবাকে কাকা ডাকতে শিখেছিল এই একটা শব্দ পৃথিবীতে শীলার কাছে তখন সবচেয়ে প্রিয় হয়তো বাহির বাড়িতে কাকা বসে আছেন শীলা ডাকতে গেল তাকে ফেরার সময় কাকার কাঁধে অথবা কোলে চড়ে ফিরত অনেক বড় হলেও শীলার অভ্যাস ছিল

          একবার বাড়ির অন্য শরীকের এক চাচীর বাচ্চা দেওয়া ঠোকরানো মুরগিতে শীলাকে ঠুকরে দিয়েছিল বলে মুরগিটাকে ধরে আছড়ে মেরে ফেলেছিলেন বাবা খুব রাশভারী আর গোঁয়ার ছিলেন তাই জেঠুর চেয়ে গ্রামের মানুষ তাকে ভয় পেত বেশি অথচ এরকম মানুষটিই একটি শিশুর জন্য কী না করতে পারতেন

          আম্মা মাঝে মাঝে রেগে যেতেন, "মেয়েকে এত বেশি আশকারা দিয়ে শেষে সামলাতে পারবেন তো? বিয়েশাদী দিতে হবে তো?"

          "এখন বিয়েশাদীর কথা উঠছে কেন? আগে লেখাপড়া শিখুক তারপর দেখা যাবে।" এই ছিল কাকার নির্বিকার উত্তর

          আশ্চর্য! হঠাৎ একদিন শীলা এবং তার ভাইবোনরা দেখল তাদের ঘরটা ভাগ হয়ে গেছে আলাদা রান্নাঘর উঠছে বাবা-জেঠু আলাদা হয়ে গেলেন এদিকে শীলা আর ওদিকে শেলী আপা- জহির ভাইয়েরা পাঁচজন আম্মা-খালাম্মা দুজনেই মাঝে মাঝে ঝগড়া করতেন ওরা ছোটরা অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না

          তারপর হঠাৎ একদিন শীলার কাছে একটা সম্পূর্ণ অচেনা জগত উন্মোচিত হল তখন বয়স কত? ছয়-সাতের মাঝামাঝি বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে বটপাকুড়ের গাছটার নিচে একা একাই খেলা করছিল কাপড়ের বানানো পুতুল নিয়ে হঠাৎ চোখ তুলে তাকাতেই দেখল প্রতিবেশী এক জেঠি তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত ইশারায় তাকে ডাকছে শীলা অবাক হয়ে তার কাছে যাওয়ার পর তিনি বললেন, "তোমারে একখান কথা কইমু মাইয়্যা, কিন্তুক তুমি কিরা কাড় আর কাউরে কইবা না"

          "কিরা কি জেঠিমা?"

          " যে কসম খায় না একজন তোমারে কিছু কইয়া আর কাউরে কইতে মানা করলে তুমি হেই কথাখান আর কাউরে কইবা না এমনকি তোমার আম্মারেও না"

          "আচ্ছা কমুনা"

              "এই যে তুমি ওনাগোরে সঠিক আম্মা আর কাকা বইল্যা জান, তারা তো তোমার আসল বাপ-মা না না অইলে বাপেরে কি কেউ কাকা ডাকে?"

          শীলা অবাক হয়ে শোনে আর ভাবতে শুরু করে বাবা আর কাকার মধ্যে পার্থক্য কী? আসলেই তো সবাই আব্বা বা বাবা ডাকে সে কেন কাকা ডাকে? অবশ্য আরেকজনকে সে বাবা হিসেবে চিনে খুব সুন্দর একজন মানুষ মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন আম্মা একবার বলেছিলেন, "উনি তোমার বাবা"

          শীলা বুঝতে পারে না কাকা তো কাকাই বাবা যেই হোক তার কিছু আসে যায় না তার ছোট মাথায় সামাজিক সম্পর্কের রীতিনীতি আর জটিলতা তখনও ঢোকেনি জেঠিমা আবার সাবধান করেন,  "মনে থাকব তো? কথাটা কিন্তুক কারে কইও না আমার মাথা খাও"

          "মাথা খামু ক্যান জেঠিমা? মাইনষে কি মাইনষের মাথা খাইতে পারে? আর আমিতো আপনের থেকে কত ছোট"

          "না না মা হেই কথা না যে কিরা দিলাম তুমি এই কথা কাউরে কইলে আমার ক্ষতি হইতে পারে"

          "তাইলে জেঠিমা আমার আম্মারেও কমু না?"

          "না না উনিতো তোমার আম্মা না খালা তোমার আম্মা তোমার জন্মের পর মইরা গেছে তখন তোমার এই খালা তোমারে পালছে"

          এবার সত্যি সত্যি জট লেগে যায় শীলার ছোট্ট মাথায় আম্মা সত্যি সত্যি আম্মা নয়? তাহলে আম্মা কে? শীলা কে?

          সেই যে শীলার মাথায় চিন্তার জট পাকাল আর অদ্ভুত একটা ভয় আর ভাবনা ঢুকল আজও সে জট খোলেনি যে কোন কিছুতে আকাশ পাতাল ভাবনা তার মাথায় এসেই যায়

          ছোট্ট শীলা তারপর 'দিন ভীষণ এক অস্থিরতার মধ্যে কাটাল কাউকে বলতে গেলে জেঠিমার কসম খাওয়া মনে পড়ে তারপর একদিন দুপুরে ভাত খেয়ে আম্মার পাশে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে শীলা উসখুস করে ডাকল, "আম্মা"

          "কীরে?"

          "না, কিছু না"

          "কিছু কইতে চাস?"

          "নাহ, এমনি"

আম্মা আবার গল্প শুরু করেন এবং যখন গল্প বলেন তখন পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করেন কিন্তু গল্পে মন নেই শীলার আবার ডাক দেয়, "আম্মা"

          "কি রে কিছু কইবি? কী জানতে চাস?"

          "আপনি নাকি আমার খালাম্মা?"

শোয়া থেকে এক ঝটকায় উঠে বসলেন আম্মা "কে কইল তোরে কথা?"

শীলা চুপ করে থাকে

          "বল না মা কে কইল?"

তবুও চোখ নিচু করে ঠোঁট দুটোকে চেপে বসে থাকে ছোট্ট শীলা আর তার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে

          "হ্যাঁ, আমি তোর আম্মা না"

          "তাইলে কে আমার আম্মা? আম্মা, আম্মা, আম্মা" বলে আম্মাকে ড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে মুখ গুঁজ়ে দেয় শীলা আম্মা পাখির বাচ্চার মত ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে মুখটা তুলে চুমু খেতে থাকে শীলার মুখে-চোখে

          "তুই আমার মানিক সোনা রতন, কিন্তু আমি সত্যি সত্যি তোর আম্মা না, খালাম্মা বাচ্চাদের যেমন মায়ের পেটে জন্ম হয় তেমনি তোর জন্ম হইছিল আমার ছোট্ট আদরের বোনের পেটে কিন্তু তোর জন্ম দিয়াই সে মরে গেল আর তুই আমার বাচ্চা হয়ে গেলি এখন বলতো মা, তোরে আমার চাইতে কেউ বেশি আদর করে, ভালবাসে আর তুই আমারে ছাড়া আর কারোরে বেশি আপন ভাবতে পারস, তোর কাকারে ছাড়া?"

          "না, না, না আম্মা" ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শীলা মায়ের প্রশ্নে ওর ছোট্ট বুকটা ভেঙে যেতে চায় ছোট্ট দুটি হাতে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায়

          বারতাকিয়া এসে গাড়িটা হঠাৎ বিকট শব্দ করে থেমে গেল চাকা পাংচার সন্ধ্যা প্রায় শেষ রাত ঘনাচ্ছে যাত্রীরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে বিরক্তি জানাল মামুন এতক্ষণ চুপ করে ছিল শীলার ঘোর কাটতে জ্ঞিজ্ঞেস করল, "কী এত ভাবছিলে? দেখে মনে হচ্ছিল তুমি জগতে নেই"

          "হ্যাঁ, কত কী যে ভাবছিলাম জীবনটাতো আমার আবোল তাবোল ভাবনাতেই কেটে গেল" তারপর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ছেলেকে ফোন করল

          "হ্যালো মা" ওপার থেকে মহুলের কন্ঠ ভেসে এল

          "কী করছিস তোরা?"

          "এই তো একটু আগে চা খেয়ে পড়তে বসেছি মনিকা ওর রুমে পড়ছে কথা বলবে? ডেকে দেব?"

          "হ্যাঁ"

          চাকা বদলানো শেষ হলে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল শুক্লপক্ষের রাত। পূর্ণিমা বা পূর্ণিমার কাছাকাছি। হাট-বাজারগুলো ছাড়া খোলা মাঠ আর বাঁদিকের পাহাড়গুলো চাঁদের আলোয় কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। কিছুক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে মামুনের দিকে মুখ ফিরালো শীলা।

            "তোমার মনে আছে মামুন, আমার আম্মা যখন মারা যান তখন তাঁর অ্যাম্বুলেন্সে তুমি প্রায় সারাক্ষণ তেলাওয়াত করছিলে। আমার বড়খালা মেজখালাও ছিলেন। তখন মেজখালা তোমাকে বলেছিলেন, জামাই, আমরা মরলেও এরকম করে দোয়া করতে হবে মনে থাকে যেন। অথচ আজ কোথায় আমরা, কোথায় আমার খালাম্মা। স্বার্থ, সম্পদ আর আমার অভিমান আমাদের মাঝখানে কত দুস্তর ব্যবধান তৈরি করেছে। কত বছর থেকে অসুস্থ, অথচ আমি একটু দেখতেও যাইনি। ইচ্ছে করলেও মনকে ফিরিয়ে নিয়েছি।"

          "আমিতো তোমাকে অনেক বার বলেছি। কিন্তু তুমি শোননি। যাক এখন ওসব ভেবে কষ্ট পেয়ে লাভ কী? তার চেয়ে ওনার জন্য দোয়া করো।"

          গাড়ি চলতে থাকে। অন্ধকারে ওরা বুঝতে পারে না কতটুকু এলো। মোবাইলের বাটনে চাপ দিয়ে মামুন দেখল পৌনে সাতটার মত বাজে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts