-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
১২
বাস থেকে নেমে
একটা রিক্সা নিল শীলা
আর মামুন। প্রচুর
রিক্সা। ওরা বলাবলি
করছে, "আজ চৌধুরী
বাড়িতে বহুত মেহমান যাইব।"
হেমন্তের বাতাসে
একটু শীত শীত ভাব থাকলেও
তারা সবাই চায়ের দোকানে,
এখানে ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। রিক্সাওলাই বললো,
"স্যারেরা স্বঅনগেরাম যাইবেন নাকি?"
"হ্যাঁ"। সুবর্ণগ্রামকে এলাকায়
কেমন যেন টেনে স্বঅনগ্রাম
বলে। আশ্চর্য লাগল
গ্রামের রিক্সাওয়ালারাও এখন আরোহীকে
স্যার বলে। যুগের
সাথে ভাষার পরিবর্তন কি এভাবেই
ঘটে? আগে বলত মিয়াভাই,
ভাইসাব, এখন স্যার। ওরা একটা রিক্সা নিলো।
চারপাশে চাঁদের
আলো। রাস্তাটা পাকা। প্রায় দশ বারো বছর পর এল। আগে রাস্তা ছিল কাঁচা। যেতে অনেক সময় লাগত। আড়াই তিন মাইলের মত পথ। চাঁদের আলোয় চারপাশটা দেখা
যাচ্ছে। কিন্তু আগে যেমন
ছিল খোলা প্রান্তর এখন তেমন
নেই। প্রচুর বাড়িঘর
রাস্তার দুপাশেই উঠেছে।
অনেকগুলোকে মনে হচ্ছে
রাস্তার দু'পাশে
চড়াও হচ্ছে।
হাসি পেল শীলার। কথায় বলে আজ মরলে
কাল দুদিন। অথচ এক কি দু'হাত জায়গার জন্য
মানুষের কি প্রাণপণ লড়াই।
জীবন দিতে বা নিতেও
দ্বিধা করে না। এই যে আমার
খালাম্মা নব্বই বছরের বেশি
বেঁচে ছিলেন, যার দশবছর
কাটল বিছানায় তাঁর কাছে
একটা তিনলাখ টাকার চেক আজও পাওনা
রয়ে গেছে।
শীলাদের
শহরে বাবা-জেঠার একটা যৌথ সম্পত্তি ছিল।
যেটা বাবা জহির ভাইদের কিনে নিতে বলেছিলেন আর বলে দিয়েছিলেন টাকাটা শীলাকে দিতে।
মামুন তখন ঢাকায়।
খালাম্মা চেকটা মামুনকে দিতে চেয়েছিলেন।
মামুন নেয়নি। বলেছিল, "শীলারটা
ওকেই দিবেন।" তারপর বাবার মৃত্যু, অনেক ঘটনা। কিন্তু আর একবারও সেই চেকের কথা কেউ বলেনি।
অথচ এই খালাম্মাই
কি কম আদর করতেন। মাতৃহীন বোনের মেয়েটিকে
অন্য খালাদের মত তৌহিদাখালাও
কম আদর করেননি। শুধু
একটা বিষয়ে ওনার আপত্তি
ছিল সম্পত্তির বিষয়ে। কারণ
দেবরের এবং ছোটবোনের নিঃসন্তান
দাম্পত্য জীবনে শীলাকে তাদের সন্তান হিসেবে মেনে নিলেও তাঁর শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী স্বীকার করতে মোটেও রাজি ছিলেন না।
শীলার মনে পড়ে আম্মার
মৃত্যুর পর শীলাই ছিল বাবার
একমাত্র অবলম্বন। মহুল
আর মনিকাতো তাঁর প্রাণ। প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে যেত দুটি
শিশুর প্রতি বাবার ভালবাসা
আর যত্ন দেখে।
সম্পত্তির কথা ওঠার
পর একদিন শীলা বলেছিল,
"আমাকে সম্পত্তি দিলে
আমার পর কেউ কি আপনার
কথা মনে রাখবে? তার চেয়ে
আমাদের এলাকায় একটা স্কুল
করে দেন না।"
বাবা রেগে গিয়েছিলেন, "ঘরে বাতি
না দিতে তুমি মসজিদে
বাতি জ্বালানোর কথা বলবে
না।"
শীলা চুপ করে গিয়েছিল।
বাবার রাগকে বড় ভয় পেত শীলা।
জীবনে শীলার গায়ে একটা টোকা দেয়া তো দূরের কথা জোরে ধমকও দেননি।
সেই বাবা ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড জেদি মানুষ।
শীলাকে সম্পত্তি দেয়ার ব্যাপারে মনকষাকষি হয়ে ভাইয়ের ছেলেদের কাছে যান না।
এখন যদি শীলার ওপর রাগ করে তার কাছেও না আসে তাহলে শীলার জীবনে আর রইল কী? তাই এ
বিষয়ে আর কোনদিন একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি শীলা।
একবার বাড়ী
থেকে তার হাতে উকিল
দিয়ে করানো একটা ওকালত
নামা দিয়েছিল শীলাকে।
দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ
করার দলিল। শীলার
হাসি পেয়েছিল। মুসলিম
আইনে দত্তক সন্তানের কোন নিয়ম
নেই। তাছাড়া সম্পত্তি
দিয়ে কী হবে?
পৃথিবীতে অপার্থিব সম্পত্তি স্নেহ-মায়া-মমতা
আর দুটো সন্তানই তার কাছে
সবচেয়ে মূল্যবান। আম্মা
যে শিক্ষা দিয়েছিলেন আর ক্যান্সারে
ভুগে অসহ্য যন্ত্রনার পরও যে কথাটি
বলে গিয়েছিলেন সেটাই তার জীবনের
বীজমন্ত্র।
বিয়ের পর দু’বছরের
মাথায় মহুল এসেছিল। আম্মা-বাবার
আনন্দের সীমা ছিল না। এই আনন্দের মাঝেই অকস্মাৎ
ছন্দপতন। আম্মার গলব্লাডারের
অপারেশন করাতে গিয়ে ক্যান্সার ধরা পড়লো। ডাক্তার
সময় বেঁধে দিলেন আয়ু আর দু'মাস। এক বছরের যে শিশুটি
মাতৃশোক বোঝেনি আটাশ বছরের
মেয়েটি সেই শোকে পাথর
হল।
তখন অনেকেই বলেছিল, "শীলার কী
হবে? শীলার জন্য কী
করে যাচ্ছেন?" শীলা
জানত আম্মা অনেকবার বাবাকে
এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছিল। কিন্তু
মৃত্যুশয্যায় শুভার্থী আত্মীয়দের দৃঢ়স্বরে
একটা কথাই বলেছিলেন,
"আমিতো ওকে লেখাপড়া
করিয়েছি। মানুষ করেছি। বাকিটা ওর
তকদিরে যা আছে তা হবে।"
সেইদিন শীলার
ভিতরে এক শক্ত চেতনার
উন্মেষ ঘটেছিল। প্রতিজ্ঞায়
কঠিন হয়েছিল, "আমার
শিক্ষা আছে। মায়ের
দেয়া এ শিক্ষা দিয়েই
আমি জীবন গড়ব।"
"এ্যাই, তখন থেকে কী ভেবেই
চলেছ। আমরাতো প্রায়
এসে গেছি। দেখছনা
লাইট দেখা যাচ্ছে। আরেকটু
সামনে গেলেই তো তোমাদের
শিমুলতলীর সেই বিখ্যাত পুল। নামতে হবে তো।"
হ্যাঁ এখানে
এসে নামতে হত। তারপর
খালি রিক্সা পুল পার হলে আবার
অন্য পাশে গিয়ে উঠতে
হত।
রিক্সাঅলা বলে উঠলো, "না স্যার। নামন
লাগব না। রাস্তা
সমান কইরা ফেলছে। অহনতো
বাস টেম্পো সব চলে। সব পাকা রাস্তা। চৌধুরী
বাড়ির সামনে দিয়া রাস্তা
একেবারে উপজেলার দিকে চইল্যা
গেছে। নদীর
উপর বিরিজ অইছে।"
"তাই অনেক উন্নতি হয়েছে তো!" মামুন বিস্ময় প্রকাশ করে।
রাস্তার
মোড়টা ঘুরতেই দেখা গেল বাঁশের
খুটিতে টানা তারে বিদ্যুৎ বাতি জ্বলছে। দিঘির
পাশ দিয়ে যেতে যেতে
সামনে তাকিয়ে দেখল বৈঠকখানার
সামনে অনেকগুলো গাড়ি। বুকটা
ধক করে উঠল শীলার। খালাম্মা, আম্মা-বাবা না অনেকদিন
পর আশৈশব পরিচিত বাড়িটা
দেখে কী জন্য কার জন্য এমন আকস্মিক ধাক্কা শীলা বুঝতে পারল না। উঠান-ঘর লোকে গিজগিজ
করছে। শীলা বাড়ির
ভেতর ঢুকে গেল। মামুন
বাইরে সামিয়ানার নিচে বসল।
****
১৩
গ্রামের
মানুষগুলো মসজিদের সামনে খোলা
জায়গাটায় বসে আছে। মসজিদে
কোরান তেলাওয়াত হচ্ছে। ইমাম
সাহেব আর হুজুরেরা জোরে
জোরে তেলাওয়াত করছেন। ধর্মে
যদিও বলা হয়েছে চুপ করে একমনে
তেলাওয়াত শোনা সওয়াবের কাজ, কিন্তু মানুষের স্বভাবই
এমন যে যত সাংঘাতিক
ব্যাপারই হোক তারা বেশিক্ষণ
চুপ করে থাকতে পারেনা। তাই একজন তার পাশের
জনের সঙ্গে যখন জনান্তিকে
গল্প জুড়ে দেয় অন্যজনও
তাকে অনুসরণ করে। এভাবে
ফিসফিসানি থেকে এমন একটা
মিলিত ধ্বনি ছাপিয়ে উঠে যা তেলাওয়াতের
শব্দকেও ছাপিয়ে যায়।
"আরজ আলী কাকা, এই যে চৌধুরানী
সাহেবা মানে বড়বিবি মারা
গেলেন আপনের কি মনে অয় এরপর
ভাইয়ে ভাইয়ে মিল অইব?"
"ক্যামনে
কমুরে ভাতিজা।
এ জীবনেতো কম দেখলাম না।
কিন্তু বিষয় আসয় এমন একটা বিষ যা মাইনষের নাড়ির টানও কাইটা দেয়। খালি
বড়চৌধুরীর কথা কস ক্যান? এই বাড়ির শরীকগো কারো লগে কারো মিল আছে? চৌধুরী সাবেরগো শরীকী ভাই এছাক মিয়ারে আর তার বৌ পোলারে কাজের মাইনষের মত খাটাইল বড়চৌধুরী। আর সম্পত্তি নিয়া যখন ভেজাল লাগল তহন তার পোলা দুইডারে হাজতে ঢুকাইল।
শেষে নাকে খত দিয়া বাড়ি ছাইড়া এছাকের পোলারা ঢাকা শহরে চইলা গেল। অহন
বলে গার্মেন্সে কাম করে।
বাড়ির ভিটায় ঘুঘু চরতাছে।"
"খালি এছাক
চাচা ক্যান? শাহআলম
মিয়ারগো বলে কবরস্থানও কিন্যা
লইছে বড় চৌধুরী।" আলাপে যোগ দিল আলীম
উদ্দীনের জোয়ান ব্যাটা তহর আলী।
"আরও কি জানেন শাহআলম মিয়া যখন মাটি ভরতে, বেড়া ঠিক করাইতে গেছে তখন ঐ হাইব্যা নাকি কইছে, শাহআলম কাকা এই জাগায় হাত দিয়েন না। কবরের এই অংশ আপনের চাচায় চৌধুরীসাহবেরে বেইচ্যা দিছে। শুইন্যা তো শাহআলম মিয়া খেইপা আগুন। কি কস হারামজাদা, কবরের জাগা এজমালি সম্পত্তি, এই জাগা কাকায় ক্যামনে বেচে?"
"এজমালি
সম্পত্তি হইছে তো কী? খবর নেন গিয়া দেখবেন
তেনার ঘরভিটার অংশও বেইচা দিছে।"
"হ, আমরাও
হুনছি। কিন্তু ঘটনা
কি আসলে ঠিক?"
"হ ঠিক। উপজেলায় গিয়া কাগজপত্র দেইখ্যা
চাচার কাছে চাটগাঁ গেছিলেন। শাহআলমের চাচা
নাকি কইছেন বাড়ির বাইরের
সম্পত্তি তাগোরে বেইচ্যা দিছেন। তাঁর ট্যাকার দরকার
অইছিল কিন্তু পরে কাগজপত্রে
দেখা গেলো সব একসাথে
রেজিস্ট্রি হইয়া গেছে। তো হেই চাচাতো
মইরাই গেলেন আর দ্যাশে
আইলেন না।"
"আইব কোন মুখে?" আরেকজন ফুট কাটল।
"আইচ্ছা কওতো মিয়া ভাই, আল্লা যাগোরে এত দিছে হে গো তিয়াস মিটে না ক্যান?" আরজ আলীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল জমির আলী।
"আরে বলদ,
যার যত আছে তার তত বেশি
লাগে। আমাগোরে দ্যাখ, চাইড্যা ডাইল ভাত আর দুইখান
লুঙ্গি গামছা অইলে দিন চইলা যায়। শীতে
একখান গরম কাপড় পাই না। পুতেরা সারাদিন
কামলা
খাইট্যা নাতি পুতিগো পেটভরা
ভাত দিতে পারে না। তয় হেরা মারামারি করে, না খাইতে পাইয়া
মেজাজের ঠেলায়।
আর ধনীরা মারামারি করে কারটা
কে কাইড়া খাইব হেই চিন্তায়।"
"আইচ্ছা কাকা,
দাদা চৌধুরীরা না দুই ভাই আছিলেন। একজনের আওলাদ ছিল না।" নজীর
উদ্দীন বলল।
"হ, আওলাদ
ছিল না।"
আরজ আলী
উজিয়ে উত্তর দিল "কিন্তুক দাদা চৌধুরীরা দুই ভাই বিয়া করছিল এক
বাপের দুই মাইয়ারে।"
"আমার
মায় কইছিল ছোট শরীকের
কোন আওলাদ না থাকায়
বৌয়ের বইন মইরা গেলে
হের মাইয়ারে পালক নিছিল। হেইডাই আছিল ওনাগো মাইয়া। ছোড় চৌধুরীর কইলজার টুকরা।"
আনু মিয়ার কথা শুনে
অল্পবয়সীরা কেউ কেউ অবাক
হয়ে গেল। মধ্যবয়সীরা
অনেকে 'হয় হয়' বলে সম্মতি জানাল।
"আমরাও দেখছি
শীলাবুবুরে।"
"এখন আইয়েনা
ক্যান?" একজন
জানতে চাইল।
"আমার মায়তো
চৌধুরী বাড়ীত কাম কইরত। মারে তেরা বেবাকে ফুউ কইয়া ডাইকত। ছোট চৌধুরীর
বিবি মারা যাওয়ার পরও শীলাবুবু
মাঝে মাঝে আইত। ছোট চৌধুরী
মানে তেনার বাপ মারা
গেলে চল্লিশা করি আর আসে নাই। দুই একবার মায়ের কবর দেখতে
আইলেও থাকে নাই।"
বয়সে কৈশোর উত্তীর্ণ
তরুণ আলী নওয়াজ বলল,
"আমরাতো জাইনতাম না। তয় উনি বাপের সয় সম্পত্তি
পান নাই।"
"আরে গাধা, বাপ না তো পালক
বাপ।"
"পালক অইলে
কী অইছে। মাইয়ারে
বাপের আদর দিছে না। কথায় কয় পালা পইখের
জ্বালা বেশি।"
"চুপ, চুপ।" আরজ আলী ভীতস্বরে
বলে উঠল। "এইসব কথা যে কইব চৌধুরীরা
হেগোরে বেইজ্জত কইরা ছাড়ব।"
আরজ আলীর ধমকে
জটলায় আচমকা নীরবতা নেমে
এল। দু একজন
হঠাৎ কলমা শাহাদাৎ পাঠ করতে
শুরু করল। আলী নওয়াজ
মোবাইলটা টিপে দেখতে চেষ্টা
করল কয়টা বাজে। এমন সময় মসজিদের
ঘড়িতে রাত দশটার সংকেত
বাজল।
"আর কতক্ষণ
বইসা থাকুম আব্বা?" কিশোর নেয়ামত জিজ্ঞেস
করল বাবাকে।
"কী জানি
বাপ। কইছিল দশটার
মইদ্যে জানাজা অইব। আরেকটু
দেখি। মুরুব্বী মানুষের জানাজায় শরীক অইলে
সওয়াব আছে।"
হঠাৎ মাইকে ইমাম
সাহেব ঘোষণা দিলেন, "লাশ পুলের গোড়ায় আইসা
গেছে। আপনেরা আর একটু
অপেক্ষা করেন।"
ঘোষণা
শুনেই সবার মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দিল।
বয়স্করা রাত-বিরেতে হোঁচট খাওয়ার ভয়ে উঠলেন না।
অন্যরা পুলের দিকে রওয়ানা দিল।
No comments:
Post a Comment