১১
বইপড়া প্রকল্প
২০০০ সালের দিকে আমার
মাথায় একটা চিন্তা এলো- কিভাবে বাচ্চাদের বই পড়ায় মনোযোগী করা যায়। কারণ শুধু
পাঠ্যবই পড়ে একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে যত ভালোই করুক এমনকি ফার্স্ট হোক তবুও তার
জ্ঞানের ঘাটতি থেকে যায় এবং উচ্চতর পর্যায়ে তাকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়তে হয়।
তাছাড়া বই না পড়লে তার সুষ্ঠু মানসিক ও চারিত্রিক বিকাশ সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ
যেমন বলেছেন- ভাত খেতে গেলে বাতাসের দরকার নেই, কিন্তু ভাত হজম করতে গেলে বাতাস বা
অক্সিজেন প্রয়োজন। তেমনি পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পাঠ্যবহির্ভূত বই না পড়লে
শিক্ষার্থীর প্রকৃত মন ও মেধার বিকাশ ঘটে না। (স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত, মোটামুটি
সারমর্ম এই)।
আনিসুজ্জামান স্যার তাঁর ‘একাত্তর’ বইতে লিখেছিলেন,
মুক্তিযোদ্ধাদের যদি শুধু রাইফেল চালাতে শেখানো হয় তাহলে তো ওরা দানব হয়ে উঠবে।
তাই সৈনিকের প্রশিক্ষণের সাথে সাথে ওদের মানবিক বিষয়ে শিক্ষাদান অপরিহার্য।
একাত্তরে সেটা করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা বিশেষত
বাবারা ঈদে বা কোন অনুষ্ঠানে দামী জামা জুতো কিনে দেন, কেক কেটে জন্মদিন পালন
করেন, পুত্রের খৎনায় মেজবান খাওয়ান। কিন্তু একটা বই- নৈব নৈব চ। টাকা খরচ করে বই
কিনতে রাজি না!
আমি তৎকালীন উপাধ্যক্ষ শিরিন সুলতানা
ম্যাডামের কাছে গেলাম, বললাম আপা আমি এরকম একটা কাজ করতে চাই। বাচ্চারা সপ্তায়
পাঁচ টাকা করে দেবে (যারা ইচ্ছুক এবং অভিভাবকের সম্মতিক্রমে) তারপর বই কিনে ওদের
পড়তে দেব। শিরিন আপা সম্মতি দিলেন। তখন সম্ভবত উনি অধ্যক্ষের চলমান দায়িত্বে
ছিলেন।
ছেলে-মেয়েদের বলতেই ৯৯ বা ২০০০ সালের
নবম শ্রেণির অনেক ছেলেমেয়েই রাজী হয়ে গেল। আমি শর্ত দিলাম- বই পড়ো, কিন্তু একটা
কথা মনে রাখবে এবং কড়াভাবে মেনে চলবে “ক্লাস চলাকালীন সময়ে বই পড়বে না”।
কিন্তু একবার গল্পের মজা পেয়ে গেলে সব
ছেলে মেয়ে এই শপথ মনে রাখতে পারে! সুতরাং প্রায়ই আমার সহকর্মী শিক্ষকরা কমনরুমে
এসে বিরক্তি প্রকাশ করতেন- ছেলে-মেয়েরা পাঠ্যবই রেখে গল্প বই পড়ে- এসব কি! আমি
চুপচাপ শুনে যেতাম। কারণ জানতাম ওরা নয় আসামীতো আমি।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘আলোকিত মানুষ' গড়ার
স্বপ্ন আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাই ভেবেছিলাম সাধ থাকলেও আমার সাধ্য
কম। তবু এই সীমাবদ্ধতার মাঝেও যদি শিশুদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি।
কয়েকজন উৎসাহে টাকা
তোলা, বইয়ের তালিকা করা এগুলো করার কাজে আমাকে নিজে থেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে এল।
এদের মাঝে অন্যতম ছিল আল-আমিন (মাসুম)। এছাড়া শারমিন শারফুদ্দীন, ফারজানা ববি আরো
অনেকে ছিল যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না বলে দুঃখিত।
ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ ছিল যাদের
বাসায় একটা গল্পের বইও ছিল না। অনেক অভিভাবক আবার পাঁচ টাকা চাঁদা দিতে চাইতেন না।
আমি বলতাম, তোমরা মা-বাবাকে বলবে আমরা সপ্তায় একটা ডিম খাব না। তাহলেইতো টাকাটা
যোগাড় করা সহজ হচ্ছে। অবশ্য সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের অনেক মেধাবী ছাত্রও আমার এই
কাজের বিরোধী ছিল।
যাই হোক শহর থেকে প্রতি সপ্তায় অনেকগুলো
বই কিনে আনি। পলিথিনের ব্যাগ দুহাতে সামলে কষ্ট হয় আবার যে আনন্দ হয় তা তুলনাহীন।
এক ছাত্রী কলেজ ম্যাগাজিনে লিখেছিল সে এই বইপড়া প্রকল্প থেকে ৭৫টি বই পড়ার সুযোগ
পেয়েছিল যা এর আগে সে কোনদিন ভাবতে পারেনি।
বই বাড়তে থাকলে রাখারও সমস্যা দেখা দিল।
আবার উৎসাহী গ্রুপ পাশ করে চলে গেলে আমিও হাল ছেড়ে দিলাম। কারণ বই পড়তে গিয়ে অনেকে
পড়ার চেয়ে সেটা মেরে দেয়াকেই সৎকর্ম মনে করত।
ম্যাডামদের নিয়েও এরকম একটা শুরু
করেছিলাম সেটাও বেশিদিন চালাতে পারিনি। একটা হচ্ছে অনভ্যাস আরেকটা কাজের চাপ।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হবার
পর ছাত্র-ছাত্রীদের বই পড়ার আর সমস্যা থাকল না। তাহসিনা আপা স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব
কাঁধে তুলে নিলেন। যেদিন এই পাঠচক্রের উদ্বোধন হয়েছিল সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলাম!
এর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ির
সাথে এবং পরিচালক দীপংকরের সাথে আমি অনেকবার যোগাযোগ করে গাড়িটি সপ্তাহে একদিন
ঘাঁটিতে আনার আবেদন জানিয়েছিলাম। অধ্যক্ষ নাসির ভাই সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু
ঘাঁটি উর্ধতনদের পক্ষ থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। এখন যখন শুনি আমাদের শত শত ছাত্র
বই পড়ে সেই বইয়ের ওপর পর্যালোচনা করে পুরস্কার জিতে নিচ্ছে তখন আমার আনন্দের সীমা
থাকে না। বছর দুয়েক আগে সম্ভবত নয়শ জন বই পড়ে ছাত্র পুরস্কৃত হয়েছিল। শুনেছি
ত্রিশটি বাস ভাড়া করে তারা পুরস্কার আনতে গিয়েছিল তখন যে অপার্থিব আনন্দ অনুভব
করেছি তা বলে বোঝাতে পারব না। জানি না আজো শাহীন কলেজ চট্টগ্রামকে কেন এত ভালবাসি।
অভিনন্দন তাহসিনা আপা, অভিনন্দন নাসির ভাই।
১২
আমাদের চাঁদা তহবিল
আমাদের আয়া-পিয়নদের
বেতন তখন নব্বইয়ের দশকের আগে কিংবা শুরুতে যা ছিল তাতে তাদের চলতে কষ্ট হত। বিশেষত
অসুখে-বিসুখে বা বছরের শুরুতে বই-খাতা কিনতে টানাটানি হত। আমি প্রস্তাব দিলাম আমরা
যদি মাসে দশ টাকা করেও দিই তাহলে একটা ফান্ড দাঁড়াবে। এতে বেশি না হোক কিছুতো হবে।
আর ব্যক্তিগতভাবে বিপদে আপদে ম্যাডামদের কেউ কেউ সাহায্য করতেন। সবাই রাজি।
রেজিস্টার বানানো হল। তাহসিনা আপা টাকা তোলা ও হিসাব রাখার দায়িত্বে। কত পেলেন এবং
কাকে কত দিলেন নিঁখুত হিসাব রাখতেন।
এ বিষয়টা কর্তৃপক্ষ জানার পর সিদ্ধান্ত
নিলেন স্কুল শিক্ষকই অর্থাৎ স্যার-ম্যাডামরা সবাই দশটাকা করে চাঁদা দেবেন। সেটা
বিশেষ তহবিল হিসেবে জমা থাকবে। তারপর যখন দরকার তখন অসুস্থ বা বিপদগ্রস্থকে দেয়া
হবে। এর মাঝে কেউ কেউ আপত্তি জানালেন, এটা দিয়ে আমার লাভ কী? আরে! সবকিছু শুধু লাভ
দেখলে হয়। আমার না হোক কারো না কারো বিপদে লাগলেই হয়। আমার যেন না লাগে সেটাইতো
চাওয়া। অবশেষে প্রতিমাসে ১০ টাকা করে চাঁদা হিসেবে কাটা হতে লাগল। এতজন শিক্ষক,
তিলতিল করে জমলেও অনেক টাকা। কিন্তু যেহেতু আমরা দিচ্ছি আমাদের কাছে জবাবদিহিতা বা
স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিল।
বেশ অনেক বছর পর যখন আমাদের অফিসের নূর
মোহাম্মদ ভাই অসুস্থ হলেন, তখন আমি কয়েকবার আবেদন করেছিলাম এ টাকা থেকে তাঁকে কিছু
দেয়া হোক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করল না। এরপরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের
অসুবিধায় আবেদন জানালেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এবার কলেজের চল্লিশ বছর পূর্তিতে গিয়ে
শুনলাম পরিচ্ছন্নতাকর্মী লায়লা বেগমকে (অঞ্জনা) নাকি কিছু টাকা দেয়া হয়েছে। কত টাকা
জানি না, তবু খুশি হলাম। মনে পড়ল সেই কৃপণের গল্প, যার বাড়িতে ভিক্ষুক গেলে কখনো
ভিক্ষা দিত না। একদিন এক নাছোড়বান্দা ভিক্ষুক কিছুতেই যায় না দেখে সেই লোক উঠোনের
ধুলো মুঠি করে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে বলল,- যা দিলাম।
ভিক্ষুক বলল, যাক ধুলো হলেও তোমার হাতে
তো কিছু উঠেছে। এভাবে আগাও।
১৩
শাহীন কলেজের অফিস
লালদালানে অর্থাৎ পুরনো
শাহীন ভবনে অফিস রুমটি ছিল অত্যন্ত ছোট। একটি জানালা-দরজাসম্বলিত
এই কক্ষে দুটো টেবিল দুটো স্টিলের আলমারী প্রচুর ফাইলপত্র ছিল। এরই মাঝে জানালার
পাশের টেবিলে বসতেন মনোয়ার হোসেন ভূঞা (কলেজ সুপারেনটেনডেন্ট) এবং অন্য টেবিলে
গাউচ হোসেন। তার দায়িত্ব ছিল টাইপ করা এবং প্রয়োজনীয় ফাইল দেখভাল করা। মনোয়ার ভাই
প্রথমে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এমন কথা শুনেছি। পরে কলেজের বিভিন্ন অফিসিয়াল
কাজ, ডিডিপি আই অফিস, কুমিল্লা বোর্ড ও ঢাকায় ব্যানবেইসে শিক্ষকদের কাগজপত্র জমা
দিয়ে এমপিও ভুক্ত করা ইত্যাদি সব কাজই তিনি করতেন। এজন্যে তাকে সবসময় দৌড়ের উপর
থাকতে হত। তখন নূর মোহাম্মদ ভাইকে নেয়া হল অফিসের কাজ দেখাশোনার জন্য।
গাউচ ভাই টাইপিং-এর কাজ, (আয়া, পিয়ন
অর্থাৎ) চতুর্থশ্রেণির সহকর্মীদের ডিউটির তদারকি করতেন। আমাদের নবম-দশম শ্রেণীতে ‘কথা বিচিত্রা’ নামের একটি অত্যন্ত
সমৃদ্ধ ছোটগল্প সংকলন পাঠ্য ছিল। এই সহপাঠ থেকে কোন প্রশ্ন হত না। কিন্তু এই বইটি
পড়ে সে সময়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সাহিত্য পাঠে আগ্রহী হত। চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের এই
গল্পগুলোর কিছু কিছু এখনও স্মৃতিতে অমলিন। সম্ভবত এই বইয়ে একটি গল্প ছিল “নসর পেয়াদা”। জমিদারের এই পেয়াদাটি বিক্রেতাকে
হাঁস-মুরগির দাম দিত নামেমাত্র এবং জেলেদের মাছের দাম দিত না। কারণ তার যুক্তি
ছিল, মাছতো জলের জিনিস। জেলে তো তাকে পেলে-পুষে বড়ো করেনি। জমিদারের পেয়াদা,
সুতরাং তাদের সাধ্য ছিল না প্রতিবাদ করে বা জোর করে দাম উশুল করে।
আমাদের এই চতুর্থশ্রেণির সহকর্মীদের
গাউচ ভাইয়ের প্রতি মনোভাব দেখলে আমার নসর পেয়াদার কথা মনে পড়ত। উনি যত ওদের পেছনে
টিকটিক করতেন তারাও আড়ালে তাকে তত অবজ্ঞা করত। আসলে তার চাকরিটাই ছিল এমন। তবে
এটাও সত্যি আমরা কিছু সিনিয়র স্যার-ম্যাডাম যারা দাপট নিয়ে চলতাম তাদের কয়েকজন
ছাড়া অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও নতুন শিক্ষকদের কাগজপত্র নিয়ে তিনি তাদের যথেষ্ট
হয়রানি করতেন। এ কারণে বিশেষত শিক্ষিকাদের অনেকে তার উপর বিরক্ত ছিল। অনেক সময়
হুসনা আপা, আমি এসব শিক্ষকদের হয়ে তার সাথে দেনদরবার করতাম। ১৯৯১ এর জলোচ্ছ্বাসের
পর মনোয়ার ভাই চলে গেলে অফিস একাউন্টটেন্ট হিসেবে কাদের সাহেবকে নিয়োগ দেয়া হয়।
ততদিনে কলেজের পরিধিও বাড়ছে।
পুরাতন ভবনে শ্রেণিকক্ষের টানাটানি দেখা
দিলে ভবনের পুবদিকের দেয়াল ভেঙে দোতলা এক্সেটেনশান (বর্ধিত ভবন) করা হল। এখানে
প্রথমে কলেজের ক্লাস হলেও পরে এখানে কেজি ক্লাস হত।
আমাদের ম্যাডামদের জন্যেও পিছনে ভবনের
দেয়ালের সাথে লাগিয়ে টিনশেড একটা রুম করা হল। কিন্তু তার আয়তন এত কম ছিল যে আমরা
ম্যাডামরা অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মত বসতাম। তবে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় ছিল মাটির
সমতলে হওয়াতে ঝুম বৃষ্টি হলেই রুমে পানি জমে যেত এবং আমাদের শাড়ি স্যান্ডেল সামলে
সাবধানে চলতে হত। এ নিয়ে অনেক কমপ্লেনের পর তৎকালীন ঘাঁটি অধিনায়ক মিটিং-এ এলে আমি
তাঁকে অনুরোধ জানালাম, ‘স্যার, আপনি
এসে সরেজমিনে তদন্ত করুন’। অনুরোধে সাড়া দিয়ে
তিনি আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কি রকম পানি জমে তা দেখাতে গিয়ে আমি রুমের কোণায় রাখা
মাটির কলসীর পানিটা উপুড় করে ঢেলে দিলাম। কারণ তখন বৃষ্টি নেই উনি কিভাবে
বুঝবেন কিরকম পানি জমে! কিন্তু কলসির পানিতে তো আর বন্যা হবে না। পানি গড়িয়ে রুমের
মাঝখানে এসে জমে থাকল। চারপাশ শুকনা। ওনারা এসে দেখলেন এবং আমাদের কান্ড দেখে হয়তো
মনে মনে হাসলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভোগের ব্যাপারটা অনুধাবনই করতে পারলেন না।
এরই মাঝে একদিন অফিসরুমের ছাদের একটা টুকরো
খুলে পড়ল। অল্পের জন্য মনোয়ার ভাইয়ের মাথায় পড়েনি। বেঁচে গেলেন। এরপর হঠাৎ হঠাৎ
বিভিন্ন ক্লাসরুমে ওপর থেকে পলেস্তারা, সিমেন্টের চাঁই খসে পড়তে থাকল। দু-একবার
দু-একজন অল্পস্বল্প ব্যাথাও পেয়েছিল। সবচেয়ে ভয় লাগত বাচ্চাদের কার কখন কি
দুর্ঘটনা হয়।
বাংলাদেশে যথারীতি যা
হয়-তদন্ত কমিশন, এখানেও তাই। ভবনটির বয়স বেশি নয়। সম্ভবত ৭৭/৭৮ সালের দিকে করা।
কিন্তু সর্বত্রই “ব্জ্র
আঁটুনি ফস্কা গেরো”! সামরিক
শাসনের সেই সময়ে অফিসাররা যত আত্ম-অহমিকায় ভুগতেন তেমনি তাদের বোকা বানাত এমইএস।
কারণ ভবন নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি সবকিছুর দায়িত্বে থাকে এমইএস
(মিলিটারি ইকুইপমেন্ট সার্ভিস) এই ডিপার্টমেন্ট গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারের
তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করতেন আর ছিলেন ঠিকাদার বা
কন্ট্রাক্টররা।
দেখতে অত্যন্ত মজবুত এই ভবনটি দশ বছরে
মধ্যেই ছাদ ধ্বসবে এটা অস্বাভাবিকই বটে। তারপরও তাই ঘটেছিল। কারণ সামরিক শাসনের
রন্ধ্রে রন্ধ্রেও যতই ছিপি আঁটা হোক,
দুর্নীতি বন্ধ ছিল না। তবে মেরামত করে ভবনটিতে দু-চার বছর আগে পর্যন্ত ক্লাস হত। আমি
অবশ্য ততদিনে বিদায় নিয়েছি। এখন নতুন ভবন ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারণ হয়েই যাচ্ছে।
প্রয়োজনও বাড়ছে। কলেজের আলাদা গেট হয়েছে। আরটিএস অর্থাৎ রিক্রুটসদের ট্রেনিং
সেন্টার সিলেটের শমসের নগরে স্থানান্তরিত করায় ট্রেনিং ভবনের কিছু অংশ এবং বিশাল
প্যারেড গ্রাউন্ডটি এখন শাহীন কলেজই ব্যবহার করে, বিশাল কলেজ ভবন, কমন রুম এবার
কলেজের চল্লিশ বছর পূর্তিতে দেখে এলাম। অথচ একসময় দাবার গুঁটির মত আমরা স্থানাভাবে
একরুম থেকে আরেকরুমে কমনরুম পরিবর্তন করতাম।
একদিন হয়তো আরো বড় হবে শাহীন কলেজ।
কিন্তু কলেজের যে নীতি বচন- শিক্ষা, সংযম, শৃঙ্খলা তাকে পাথেয় করে আমাদের
শিক্ষার্থীরা যেন সত্যিকারের মানুষ হয়।
১৪
গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র
আমরা যখন চাকরিতে যোগদান
করেছি তখন লে. জে. হো. মো. এরশাদ ক্ষমতায়। একনায়কতন্ত্রের
চূড়ান্ত। বিশ্ববেহায়া এই লোকটি আজও চক্ষুচর্মহীন মানুষের মত রাজনীতি করে এটা ভাবলে রাজনীতির
প্রতিই ঘৃণা জন্মে। এদিকে গর্বাচভের পেরেস্ত্রেইকা এবং গ্লাসনস্তের রাশিয়ার সমাজতন্ত্র
ভেঙে পড়ে সোভিয়েত রাশিয়া টুকরো টুকরো। ধনতন্ত্র তথা গণতন্ত্র এবং
সমাজতন্ত্রের স্নায়ুযুদ্ধের যবনিকা পতন হচ্ছে। রোমানিয়া এবং
ইউরোপের ইস্টব্লকের দেশগুলো সমাজতন্ত্র নামক কঠোর একনায়কতন্ত্রের খোলস ভেঙে বেরিয়ে
আসছে। মানুষ দেখছে সমাজতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও টুটিচাপা জীবন। অন্যদিকে সামরিক
একনায়কদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ফিলিপাইনে মার্কোসের পতন। ইমেলদা
মার্কোসের বিলাসবহুল জীবন ও তিনশ জোড়া জুতার সংবাদ।
বাংলাদেশের
মানুষও উত্তাল। চরিত্রহীন, লম্পট এরশাদ নিজেকে কবি, ধার্মিক অনেককিছু হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন দাবিয়ে রাখতে পারল না
অবশেষে নব্বইয়ের ডিসেম্বরে তার পতন।
এ ঘটনাগুলো উল্লেখ
করলাম এ কারণে যে যত দোষই থাক গণতন্ত্রের সূচনা সামরিক বাহিনীর মাঝেও একটা মানসিক
পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি, “বাংলার মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না” তারা তখন কিছুটা
অনুধাবন করেছিল। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি- কারণ নব্বইয়ের পর সামরিক
অফিসারদের মনোভাব কিছুটা হলেও নমনীয় মনে হত। “ব্লাডি সিভিলিয়ানরাই” যে এদেশের প্রকৃত
মালিক এটা তারাও বুঝেছিলেন।
এখানে আমার নিজের একটা
অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। একদিন শহরে যাব বলে এয়ারপোর্ট গিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করতে
গিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ার কারণে আমার গৃহকর্তা ট্যাক্সিচালকের সাথে বাদানুবাদে
জড়িয়ে পড়লেন। তিনি তখনও সুপুরুষ তাই ট্যাক্সিওয়ালা তাঁকে বিমানবাহিনীর অফিসার ভেবে
কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, যান যান যাওন লাগব না। এখন আপনাগো ধমকের দিক শ্যাষ।
সেই চালকের কথা শুনে
আমার মনে হয়েছিল, মানুষ আসলেই আর খাকি পোশাককে ভয় পায় না। তাদের চেতনা শানিত
হচ্ছে।
১৯৮৮ সালে আমাদের
সার্ভিস রেগুলেশন তৈরি হল। পে-স্কেল সরকারের সাথে অর্থাৎ সরকারী কলেজের শিক্ষকরা
যেভাবে পায় আমরাও সেভাবে পাব। বাসাভাড়া বেতনের ৪৫%, কিন্তু
চিকিৎসা, যাতায়াত, বিনোদন আর কিছু নেই। আর দাবী জানালে বলে ফান্ড নেই। সরকারী এমপিও
বাদ দিয়ে কলেজ যতটুকু দেয় তাতেই কলেজের ফান্ডে কুলোয় না। সব শাহীনের এক নিয়ম হল।
কিন্তু বার বার বলা হচ্ছিল চট্টগ্রাম শাহীন সবসময় ঘাটতিতে আছে। সুতরাং শিক্ষকদের
বেতন দেওয়াই সমস্যা।
মাথায় ঢোকে না। ছাত্র-ছাত্রী বেড়েছে।
সিভিলিয়ান (বিশেষত) কলেজের ছাত্রদের টিউশন ফী অনেক বেশি। তবু কেন শুধু ঘাটতি আর
ঘাটতি।
অনেক ভেবে আমরা শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত
নিলাম ব্যাংকে বেতন দেয়া হলেও রশিদ বইয়ের একটা থাকে ব্যাংকে, একটা কলেজে পাঠানো হয়
(ব্যাংক থেকে) অন্যটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। আমরা প্রস্তাব দিলাম প্রত্যেক টার্ম
পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের বেতনবই চেক করে তারপর আমরা তাদের পরীক্ষার প্রবেশপত্র
দেব। এই প্রবেশপত্র ছাড়া কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে না। কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই শাহীন কলেজ লক্ষ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করতে শুরু
করল। তাহলে এতদিন? তার মানে কোন না কোনভাবে বছরের পর বছর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী বেতন
না দিয়েই লেখাপড়া করে গেছে! জানি না এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল।
১৫
শাহীন বোর্ড
বিমানবাহিনীর শিক্ষা
পরিচালকের দফতর থেকে সিদ্ধান্ত হল- যেহেতু বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিমানসেনারা
ঢাকা-কুর্মিটোলা, যশোর ও চট্টগ্রামে পোস্টিং হন সে কারণে প্রত্যেক শাহীনের আলাদা
সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই সিদ্ধান্ত হল, সব শাহীন একই সিলেবাস
ফলো করবে। সরকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সিলেবাসের সমন্বয়ে এই
পাঠ্যক্রম তৈরি হত। বছরে একবার সব প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরা সিলেবাস কমিটির মিটিং
করতেন। তারপর সেই সিলেবাস বা পাঠ্যসূচী সুন্দর ঝকঝকে মলাটে বাঁধাই হয়ে আসত। আমার
মনে হয় এত সুন্দর সিলেবাস খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুরাই পেয়ে থাকে। এছাড়া শিক্ষকরা
বিষয়ভিত্তিক ২ সেট করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পাঠাতেন। তার একটি হেডকোয়ার্টার থেকে
অনুমোদিত হয়ে আসত। তারপর কলেজে টাইপ করে (ততদিনে কম্পিউটার এসে গেছে)
সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপা হত। সাইক্লোস্টাইল মেশিন চালাতে জানত পিয়ন আবুল হোসেন।
পরবর্তীতে সম্ভবত ঢাকা থেকে প্রিন্ট হয়ে
প্রশ্ন আসত। তারও পরে চট্টগ্রামের কোন ছাপাখানায় প্রশ্ন ছাপা হত। বিমান বাহিনী
যথাসাধ্য চেষ্টা করত এসব বিষয়ে ফেয়ার থাকার জন্য এবং আমরা শিক্ষকরাও এতে সন্তুষ্ট
ছিলাম।
No comments:
Post a Comment