Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - একটি আত্মহত্যা এবং ...



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - একটি আত্মহত্যা এবং ...
__________________________________________

একটি আত্মহত্যা এবং .........

 

আজ সারাদিন লোকজনের আগমনে বাড়িটা কী এক অস্বস্তিতে যেন অস্থির। আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী, দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন আসছে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করছে কখন ঘটল, কীভাবে ঘটল। তাই যে যেভাবে শুনেছে তার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে বর্ণনা করছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। আরেকজন দৌড়ে এসে যতটুকু দেখেছে কিছুক্ষণ কেঁদে কিছুক্ষণ অবাক ভঙ্গিতে সকালের সেই মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছে।

            সারাদিন এভাবে বলতে বলতে তার স্বরভঙ্গ হয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে একটা শব্দ বেরোচ্ছে। কন্ঠস্বরকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে সবাই প্রশ্ন করছে - "কতক্ষণে এমন অইলরে?"

            "এই সকাল আটটা ন'টা হইব। আমি কি আর ঘড়ি চিনি যে সময় কইতে পারমু। তয় মুখে মুখে হুইনতে হুইনতে অনুমান করি আর কি। তয় অনুমান করি সকাল ন'টা সাড়ে ন'টা অইব"

            "কী অইছিল?"

            "আমি তো পাকের ঘরে ছিলাম। আত্‌কা হুইনলাম চাচায় সাজ্জাদ ভাইয়ারে বইকতে আছে - লাটসায়েবের পোলা। বেলা নয়টায় ঘুমের থেইকা উঠে। কলেজ আটটায় আর তানি ঘুমান দশটা পর্যন্ত। সাজ্জাদ ভাইয়া এর আগে চাচীর বকা হুইন্যা চুপ ছিল। এবার কইল - 'আব্বা আমি কি কলেজ কামাই করি? আত্‌কা দুই একদিন দেরি অয়। আপনি খালি সুযোগ পাইলেই গালিগালাজ করেন।' ভাইয়ার কথা হুইন্যা চাচা আরো চেইত্যা গেলেন- 'হারামজাদা আমি গালিগালাজ করি? গালি দিমুনা তো কি তোমারে সালাম করুম?'

            "সালাম করতে কে কয়? তাই বইল্যা সব সময় এইসব ভালা লাগে না।"

            "ভালা না লাগলে তোমার কোন বাপের হোটেল আছে সেইখানে যাও। দেখি কে তোমারে খাওয়ায়।"

            "আব্বা কী কইলেন আপনে - আমার আর কয়ডা বাপ আছে? আপনে কী কইলেন?" - এই কথা না কইয়া সাজ্জাদ ভাইয়া প্লেটের নাস্তা ঠেইল্যা থুইয়া চেয়ারখানরে লাত্থি মাইরা উইঠা গেল। চাচী আম্মা পিছন থেইক্যা কত ডাকল হুনল না। দৌড়াই বাইর অইয়া গেল। হেরপর কতক্ষণ অইব - পেরায় আধঘন্টা পর দৌড়াই আসি বারান্দায় এই এইখানে পইড়া যাইতে যাইতে চিল্লানি দিল - আম্মাগো আমি বিষ খাইছি। আম্মা, আম্মা আমারে বাঁচান।"

            আজকের দিনটা কার মুখ দেখে শুরু হয়েছিল মনে করতে পারেন না জামাল মিয়া। সুন্দর রোদ ওঠা একটা দিন যে এত অন্ধকার হয়ে যেতে পারে কেউ ভাবতে পারে! হাসপাতালের মর্গের সামনে ঘাসের ওপর বসে থাকতে থাকতে ভাবছিলেন জামাল মিয়া।

            এমনও হয়! মানুষের কপাল এমনও হয়। সকালে জ্বলজ্যান্ত ছেলে দুপুরের আগে লাশ হয়ে গেল। কী এমন বলেছিলেন! 'হারামজাদা' আর 'তোর কোন বাপ' এই কথা দুটোতে ছেলের এত লাগল! সতের বছরের তাগড়া জোয়ান ছেলে তুই লাফ দিয়ে মরতে গেলি। মরে বাপকে এখন থানা-পুলিশ লাশঘর দেখাচ্ছিস। আর কী কী দেখাবি, আর কত দেখতে হবে? শাস্তি কি পুরা হয়নি?

            না শাস্তি পূর্ণ হয়নি। আরো বাকি আছে। তখনো জামাল মিয়া জানেন না তার সামনে আরো ভয়ঙ্কর রাত মুখ হা করে আসছে।

            মর্গ থেকে লাশ ছাড়িয়ে আনতে রাত আটটা বেজে গেল। বাড়িতে তখনও লোক গিজগিজ করছে। ইতোমধ্যে উঠানের একপাশে সামিয়ানা টানিয়ে মুর্দাগোসলের গরম পানি আর গোসল করার জায়গা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

            পিক-আপে করে আসতে আসতে দূর থেকেই লোকজনের সরব উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। উপস্থিত স্বজনদের কেউ তার টেনে বাড়ির বাইরে একটা বাল্ব জ্বালিয়ে রেখেছে। লাশটা কয়েকজন ধরে বারান্দায় শুইয়ে দিতে জামাল মিয়া ঘরে ঢুকলেন স্ত্রীকে দেখতে।

            সকালে সেই যে বেহুঁশ হয়েছে তারপর এখনো তার পুরোপুরি জ্ঞান আসেনি। একটু চেতনা এলেই নাকি সাজ্জাদকে ডেকে আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।

            জামাল মিয়া দরজায় দাঁড়াতেই কাজের বুয়া ফাতেমা দৌড়ে এল - "চাচায় আইছে। আপনেরা সইরা যান, সইরা যান।" কিছু মহিলা অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। দু-চারজন আত্মীয়া যারা খাটের ওপর সাজ্জাদের মাকে ঘিরে আছে তারা ঘোমটা বড় করে তেমনি বসে রইলেন।

            জামাল মিয়া কাছে এসে স্ত্রীর কপালে হাত রাখলেন। "জাভেদের মা, ও জাভেদের মা, উঠ, শক্ত হও। আল্লারে ডাক।"

            কিন্তু জাভেদের এবং সাজ্জাদেরও মা নিঃসাড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে এলেন জামাল মিয়া।

            এখনো অনেক কাজ। সকাল থেকে হয়রানির পাশাপাশি প্রচুর টাকা পয়সাও জোগাড় করতে হয়েছে। থানাওয়ালারা কি এমনি ছাড়ে? পারলে বাপকে খুনী সন্দেহ করে হাজতে ভরে। বাড়িতে না আসার জন্য মোটা টাকা ঢালতে হয়েছে। ভাগনেকে ফোন করেছিলেন টাকা নিয়ে আসতেতার কাছ থেকে টাকাগুলো নিতে হবে।

            বাইরে এসে দেখলেন লাশ গোসলের প্রস্তুতি চলছে। ভাতিজা হাশেমকে হাত ইশারায় ডাকলেন। সে কাছে আসতেই নিচুস্বরে বললেন, "মোল্লা-মৌলবী ডাকস নাই ক্যান? একটু দোয়াদরুদ পইড়ত।"

            হাশেম মাথা নিচু করে চাচার কথা শুনছিল। কথা শেষ হবার পরও তেমনি চুপ করে রইল।

            "কিরে হাশেম, কথা কস না ক্যান?"

            এবার চোখ তুলল হাশেম। সমবয়সী চাচাতো ভাইটির জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার চোখদুটো জবাফুল হয়ে আছে। চাচার দিকে তাকিয়ে এবার হাশেম বলল - "ডাইকতে গেছিলাম"

            "তয়?"

            "আইল না। ওনারা কইল আত্মহত্যা কইরছে। হে তো এমনেই দোজখে যাইব। হের লাইগা দোয়া করা নাজায়েজ"

            "নাজায়েজ?"

            "হ, ইমাম সায়েব ত -" হাশেম চুপ করে গেল।

            "কী কইছে ইমাম সাব কস না ক্যান?"

            "কইছে খাটিয়া দিব না। আরো কয় বিষ খাইয়া মরছে হের লাশ এই খাটিয়ায় বহন করা গুনাহ।"

            "চুপ কর। আর কইস না।" চাপা কন্ঠে গর্জে ওঠেন জামাল মিয়া।            
          "যা, এক কাম কর। সাজ্জাদের ঘরে গিয়া হের খাটটা খুইল্যা উঠানে পাত। খাটিয়া লাগব না। আর পিকআপ ভ্যানের ট্যাকা অহনও দিই নাই। তারে কও খানিক বইসতে।"

            হাশেমকে নির্দেশ দিয়ে পা বাড়াবেন তখনই হাশেম ডাক দিল "কাকা"

            "কী?" - দাঁড়িয়ে গেলেন জামাল মিয়া।

            "কাকা কবরের জায়গা ঠিক অয় নাই। কবর খোঁড়া অয় নাই।"

            "এতক্ষণ কস না ক্যান?"

            "আপনে তো আইলেনই এখন।"

            "ক্যান, আমারে মোবাইল করলেই তো পারতিস।"

            হাশেম চুপ করে থাকে। এই মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে আরো দুঃসংবাদ জানাতে কারো সাহস হয়নি। হাশেমের বাবা যে কিনা সম্পর্কে জামাল মিয়ার বড়ভাই তিনিও বলেছেন - "একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় অইব। হেরে এই কথা জানাইলে আরো ভাইঙা পড়ব।"

            তাইতো কেউ জানায়নি। সবার আশা ছিল একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু দিন গিয়ে রাত এল এলাকার মহল্লার পাঁচটা কবরস্থানের একটাতেও কবর দেবার অনুমতি পাওয়া গেল না। সবখানে মোল্লা মৌলভিদের এক কথা - "আত্মহত্যা! খোদকুশি! এ লাশ এখানে কবর দিলে গোরের মুর্দারা আল্লার কাছে ফরিয়াদ করবে আর তাদের রুহের বদ্‌দোয়া জিন্দাদের মুসিবত ডেকে আনবে।

            হাশেম বুঝতে পারে না কোন লাশ কি কোনদিন মাটির উপরে পড়ে থাকে। যেভাবেই মরুক কোন না কোনখানে তাকে তো মাটিতেই শোয়াতে হয়। কিন্তু আজকে একদিনের মধ্যে চারদিকে যত গুঞ্জন উঠছে সেগুলো কি চাচাকে এখন বলা যায়, না বলার সময়!

            "কি রে হাশেম্যা চুপ কইরা আছস ক্যান? তর বাপে কই? আরো মুরুব্বিরা কই?"

            "আব্বা ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে গেছে। ফোন কইরা দ্যাখেন।"

            জামাল মিয়া পকেটে ফোন হাতড়াতে হাশেম সেখান থেকে কেটে পড়ে। চাচা যদি আরো কিছু জানতে চায় হাশেম কী বলবে? সে কি বলতে পারবে "কাকা, মৌলভী সাহেবদের কথা শুনে এলাকার কিছু মানুষ জোট বেঁধেছে। তারা আত্মহত্যার লাশ এলাকার কবরস্থানে কবর দিতে বাধা দেবে। তারা গোর খুঁড়তে বাধা দিয়েছে। তাই সারাদিন ছোটাছুটি করেও কোথাও গোর খোঁড়া যায়নি।"

            রাত বাড়ছে। কিন্তু এখনো লাশ কবর দেয়ার কোন ব্যবস্থা হয়নি। লাশের গোসল শেষে কাফন পরিয়ে তাকে তার খাটিয়াতে শোয়ানো হয়েছে। লোকের ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। নিকট আত্মীয়-স্বজন আর দু-একজন অতি কৌতূহলী এখনো উপস্থিত। রাতের নির্জনতা আর লাশের উপস্থিতি যেন পরিবেশটাকে বিষন্ন আর ভৌতিক করে তুলেছে। আত্মীয়দের দু-একজন গরমে ঘেমে ঘাম মুছতে মুছতে দুশ্চিন্তা করছে - "এভাবে পইড়া থাকলে তো লাশে পচন ধরব। কিন্তু দশটার ওপরে বাজে। সাজ্জাদের বাবাও গেল কমিশনারের কাছে। কই এখনও তো ফিরা আইল না।"

            রাত প্রায় বারোটার দিকে পিক-আপের শব্দ শোনা গেল। লাশ ঘিরে থাকা মানুষদের দু'একজন ত্রস্ত হয়ে গেটের দিকে ছুটল। সাজ্জাদের বাবা, এলাকার কমিশনার  এবং আরো কয়েকজন নামল।

            "কী ব্যবস্থা? কোনখানে অইব কবর? আমরা তো সব কাম থুইয়া আপনাগো লাইগা বইসা আছি। গোরখোদকেরা অপেক্ষা করতাছে।"

হাশেমের বাবা মাথা নাড়ল - "কোনখানে ব্যবস্থা অয় নাই। কমিশনার সাবে কী কয় শোন।"

            কমিশনার উপস্থিতি লক্ষ্য করে বলেন - "কী করমু? ইমাম মৌলভিরা রাজি হইল না। তাই এলাকার মানুষও রাজি না। তাই আমরা ঠিক করছি লাশ না পচাইয়া আমরা আঞ্জুমানরে দিমু।"

            "আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম? ক্যান? সে কি বেওয়ারিশ লাশ?"

            "না। তা না। পরিস্থিতি বিবেচনা কইরা আমরা সিদ্ধান্ত নিছি। লাশ তো এইভাবে ফেইলা রাখন যায় না।"

            "এইডা একটা কথা? এইডা আমাগো পোলা না?"

            "কিন্তু এলাকার মানুষতো মাইনতে চাইতাছে না।"

            কমিশনার নিজেও বুঝতে পারছেন না আসলেই মানুষগুলো এমন হয়ে গেল কেন? যে ছেলেটা সবার চোখের সামনে সবার সাথে মিলেমিশে বড় হল ঝোঁকের মাথায় আত্মহত্যা তাকে এতটা পতিত করে দিল। ধর্মের এত ভয় মানুষের! ইমাম সাহেবের কথাই বড় হল? এই দেশে কি ধর্মের নামে সকল মানবিকতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আজ সন্ধ্যা থেকে তিনি নিজেও এলাকার সবগুলো মসজিদে গিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কেউই রাজি হয়নি। কিন্তু আর তো দেরি করা যায় না।

            সাজ্জাদকে যখন পিকআপে তোলা হল তখনও তার মায়ের জ্ঞান ফিরেনি। চাচী-মামী সম্পর্কের উপস্থিত মহিলারা কেঁদে উঠতেই হাশেমের বাবা গর্জে উঠলেন - "চুপ। একদম কাইনবা না। হারামজাদা নিজে তো মরছে, আমাগোরেও মাইরা গেছে।"

            হঠাৎ ধমকে ঘরের ভিতর আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পিকআপের ইঞ্জিনের শব্দ কেমন গোঙানীর মত শোনা যেতে লাগল। লাশ নিয়ে গাড়িটা যখন রাস্তার মোড় ঘুরে গেল তখন সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি উৎকন্ঠা ছাপিয়ে স্বস্তি এল জামাল মিয়ার দেহ-মনে। ছেলের মৃত্যুর আকস্মিকতা তাকে যতটা শোকার্ত করেছে তার চেয়ে ছেলের দাফনের জটিলতার সমাপ্তি তাকে বুকচাপা পাথর ফেলে মুক্ত নিঃশ্বাসের স্বস্তি দিল।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts