__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - নেপথ্যে
__________________________________________
নেপথ্যে
মোবাইল
ফোনটা বাজতেই স্ক্রিনে চোখ রাখলেন জাহির খান। শাশুড়ি-আম্মা। আরো দুবার রিং হতে
নিজেকে প্রস্তুত করে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন জাহির।
"আসস্লামালেকুম আম্মা।"
"হ্যাঁ বাবা জহির, আমি তোমার আম্মা।"
"জী আমি জানি। কী ব্যাপার
আম্মা?"
"আনোয়ার আর হাসিবুলকে পাঠাচ্ছি তোমার
কাছে। তুমি ওদেরকে তোমার প্রোফাইল সহ একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়ে দিয়ো, স্যুভেনিরে দিতে হবে। ও
হ্যাঁ,
আরেকটা কথা ওদের কিছু টাকাও দিয়ে দিয়ো খরচপাতির জন্য।"
"জী আচ্ছা।"
ফোনটা
রেখে ইন্টারকমে সেক্রেটারিকে ডাকলেন। তারপর ফাইলে মন দিলেন।
"মে আই কাম ইন স্যার?"
"ইয়েস"
- ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন। আরও কিছুক্ষণ
কাটল। এবার তাকালেন সেক্রেটারির দিকে।
"দুটো ছেলে আসবে, ওদের বসিয়ে রাখবে, সবার শেষে লাঞ্চ আওয়ারের পর ওদের আমার কাছে পাঠাবে।"
"জী
স্যার।"
"যাও"
সেক্রেটারি বেরিয়ে যাবার পর চেয়ারে
হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন জাহির খান ওরফে জহির খান ওরফে জহির মৃধা। শাশুড়িমাতা
ফোন করেছেন ছেলেগুলোকে টাকা দিতে হবে।
টাকা – টাকা কি এত সহজে দেয়া যায়?
শ্বশুরের পরিবার তিন পুরুষের
ধনী তারা কী বুঝবে টাকার মূল্য? জীবনে আর যা কিছু চিনেছেন না চিনেছেন টাকা চেনেন জহির মৃধা।
ধুর! মনে মনে ভাবতে গেলে এখনও জহির মৃধা নামটাই উচ্চারণ
করেন।
আজকে দেশের কোটি কোটি কোটিপতিদের একজন জহির খান। শূন্য হাতে এই
রাজধানীতে এসে কোঠাবাড়ি আর সিন্দুক পূর্ণ করেছেন যেভাবে সেকথা ভাবতে গেলে নিজেই
তাজ্জব বনে যান।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসেছিলেন,
কলেজে পড়ার শখ ছিল। স্কুলে মধ্যম মানের ছাত্র
ছিলেন। কিন্তু আদর্শ ছিল ছোট মামা যিনি কিনা নবাবপুরে বিহারী দোকানের সেলসম্যান
থেকে স্বাধীনতার পর সেই দোকানের মালিক হয়ে এক বছরের মধ্যেই ব্যবসায়ীতে পরিণত
হয়েছিলেন। তবে মামার একটা গুণ ছিল
- আত্নীয়স্বজনকে দূরে ঠেলে
দেননি।
বাহাত্তরের গোলমালের পরীক্ষায় নকল করে জহির যখন প্রথম বিভাগে
পাস করলেন, তখন পরিবারে হুলুস্থুল
বেঁধে গিয়েছিল। এর আগে এ বংশে তো কেউ ম্যাট্রিক পাশ করেনি তার উপর আবার ফার্স্ট
ডিভিশন।
মামা একটা ঘড়ি নিয়ে ভাগ্নেকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখনই জহির
আবেদন করেছিলেন, "মামা আমি ঢাকা যেতে চাই,
পড়তে।"
মামা খুশি হয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। তারপর লঞ্চে চড়ে মামার সাথে
ঢাকায় আসা। মামা-ভাগ্নে মিলে নবাবপুরের জীর্ণ পুরনো এক বাড়িতে ভালই কাটছিল।
কিন্তু বিপদ ঘটলো মামী আসার পর।
মামী সঙ্গে নিয়ে এল তার ভাইকে,
দোকানে কাজ করবে বলে। আর তাই শুরু থেকে ভাগ্নেকে
তাড়ানোর কৌশল খুঁজতে লাগলেন।
জহির অবাক হয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের সেই মামীর কূটকচালি দেখে।
কিন্তু সেই তরুণ বয়সেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন। মামাকে বললেন "আমি
বাড়ি চলে যাই।
আমার জন্য আপনার সংসারে অশান্তি হচ্ছে।"
মামা কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন,
"তোকে বি.এ পাস করতেই হবে। আমি বুবুকে কথা দিয়েছি। মাথা গরম
করিস না। আমাকে দ্যাখ, যুদ্ধের
সময় যদি পালিয়ে যেতাম তাহলে তো সেলসম্যান হয়েই জীবন কাটত। যে কোন কাজে লেগে
থাকতে হয়, বুঝলি জহির, লেগে না থাকলে জীবনে উন্নতি করা যায়
না"… মামার কথাটা মনে ধরেছিল।
মামার পরামর্শে একটা মেসে উঠেছিলেন।
মাসে মাসে টাকাটা মামাই দিতেন। মামার তখন রমরমা অবস্থা,
একটা থেকে দুটো তারপর তিনটা দোকান হয়ে গেল। পুরনো
ঢাকাতেই একটা পুরনো বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করলেন।
জহির আশ্চর্য হয়ে দেখতেন। মামাকে ম্যাজিশিয়ান মনে
হত। মামার বদৌলতেই জহির মেসে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। সিগারেট ধরেছেন, বন্ধুবান্ধব প্রচুর জুটেছে।
কিন্তু এত সুখ সইল না, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হঠাৎ একদিন মারা গেলেন মামা। অতিরিক্ত
খাটুনির চাপ তার দেহযন্ত্র সহ্য করেনি, স্ট্রোক করেছিলেন। আর মামার মৃত্যু রাতারাতি জহিরকে যেন ভবনের
শীর্ষ থেকে মাটিতে ফেলে দিল।
জহির দেখলেন, বন্ধুবান্ধব সব উধাও। মেসের বিল পরিশোধ করতে পারেন না। এক
প্যাকেট ক্যাপস্টেন সিগারেটের বদলে দিনে দুই তিনটা স্টার সিগারেট। ধার দেনায় গলা
ডুবে যেতে লাগলো। আর সবচেয়ে অবাক হয়ে দেখলেন মামার ব্যাবসার স্বত্বাধিকারী হয়ে
উঠেছে মামার শালা - আতিক। যে
মামী একদিন বাসা থেকে তাড়াতে ব্যস্ত হয়েছিলেন,
তিনি বাসায় গেলে জহিরকে ধরে কাঁদেন। কিন্তু জহিরের
নিজেরই তখন মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
একবার ভেবেছিলেন গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু ওখানে
ফিরে গেলে মাথাটা সবার কাছে হেঁট হয়ে যাবে। নাহ,
বাড়ি যাওয়া যাবেনা। তারচেয়ে ঢাকা শহরে মরে
যাওয়াও ভাল। মায়ের শখ ছিল ছেলে বি.এ পাস করবে। মামাও চেয়েছিলে ভাগ্নে বি.এ পাস
করুক। সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকাতেই থাকবেন। মামার কথাটা মাথায় ঘুণপোকার
মত লেগে থাকত- “লেগে থাকলে হবে।”
মামা অবশ্য বলতেন “লাগি থাকলে ভাগী হবি।”
একটা হাসির রেখা ফু্টে উঠে ঠোঁটের কোণে আবার তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে
যায়।
হ্যাঁ, লেগে ছিলেন বলেই আজ তিনি জাহির খান।
স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছেন জহির। সেই সময়ে সারা দেশে দুর্ভিক্ষ, অভাব,
অনটন। তারপরও দুটো টিউশনির উপর ভর করে চলছিলেন।
এভাবেই নাইট শিফটে বি.এ পাস করলেন কোন রকমে।
মনে পড়ে যে ছাত্র দুটোকে পড়াতেন,তাদের পড়ানোর চেয়েও কান উৎকর্ণ থাকতো কখন চা-নাশতা
আসবে। সে দুর্দিনে বিকেলের চা-বিস্কুট খেয়েই মাঝে মাঝে রাত কাটাতে হত।
বি.এ পাস করে যখন দরখাস্ত নিয়ে অফিসে অফিসে ধরনা
দিচ্ছিলেন, তখনি একদিন দেখা হল
ফার্স্ট ইয়ারের বন্ধু ফরিদের সাথে। সেই নিয়ে গেল রিয়াজের কাছে।
রিয়াজের বাবার ম্যানপাওয়ারের বিজনেস। সোজা কথায় আদম ব্যবসা।
ফরিদ সেখানে ঢুকেছে। জহিরকেও নেয়া হল। কিন্তু শর্ত একটাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ডেলিগেট আসবে, ওদের দেশে শ্রমিক সুইপারের প্রয়োজন, তাই লোক জোগাড় করতে হবে - সোজা
কথায় যাদের বলা হত আদম। জহির
জানলেন কী করতে হবে। কাজ শিখতে গিয়ে দেখলেন কাঁচা পয়সার কারবার। ঝুঁকি
আছে, তবে একবার যদি একথোকে
কিছু লোক পাঠাতে পারেন তাহলে পকেটে ঝমঝম করবে টাকা। কিন্তু লোকে বিশ্বাস করবে কেন?
রিয়াজের বাবার পরামর্শে জহির প্রথমে গেলেন নিজের এলাকায়।
কিন্তু হতাশ হতে হল। বিদেশ যাওয়ার কথা শুনলেই মানুষ ভয় পায়।
তারচেয়েও বড় সমস্যা – টাকা কোথায়? জহির যতই বোঝাতে চেষ্টা করে আপনাদের টাকা না থাকলেও জমি আছে।
ওরা আরও বেশি ভয় পায়, ছেলেদের চেয়ে বাবাদের বেশি ভয়! বাপদাদার ভিটে মাটি হারাবো তার
ওপর আবার ছেলেও।
কিন্তু নানা ঘাটের জল খাওয়া জহির ততদিনে অনেক পরিণত ও
বুদ্ধিমান হয়েছেন। তিনি দেখলেন গ্রামের ঘুরে ফিরে আড্ডা দেওয়া জোয়ান ছেলেগুলোর
চোখে একটু যেন ইচ্ছে ঝিকিয়ে উঠছে।
পরের
বার বাবাদের চেয়ে ছেলেদের বোঝাতে লাগলেন -
বিদেশ গেলে এখনকার চেয়ে দশগুণ বেশি জমি কেনা যাবে। দুগন্ডা,
চারগন্ডা জমির লোভ না করে একবার যদি ওগুলো বেচে
বিদেশ যাওয়া যায় তখন আর লাঙলের খুঁটি ধরতে হবে না কাউকে। তারপর আনতে
পারবে ট্রানজিস্টার, টেপরেকর্ডার, ক্যামেরা, কম্বল… কী নয়? আরবের দেশগুলো তো সোনার খনি,
একটু চালাক হলে কতভাবে এসব সোনা দেশে এনে রাতারাতি
দালান-কোঠা….
কথা শেষ করে
না জহির, জানে পাথর গড়াতে শুরু করেছে। ছেলেরা উতলা হচ্ছে। আর তখনও জহির
মনে মনে জপছেন মামার সেই উপদেশ- লেগে থাকলে হবে।
এভাবে দু'চারজন করে আসতে থাকে। তারপর আশির দশকে এল সেই জোয়ার।
দলে দলে লোক যেতে শুরু করল বিদেশে। টাকা কোন বিষয়
নয়।
মাঠের জমি থেকে ঘরের ভিটে সব কিছুর বিনিময়ে
ছেলেদেরকে বিদেশে পাঠাতে প্রস্তুত পিতারা। এমন কি বিয়েতে যৌতুকের চেয়েও বড় শর্ত
জুড়ে দিতে লাগল ছেলেপক্ষ
- বরের বিদেশ যাওয়ার খরচ দিতে হবে, এন.ও.সি যোগাড় করে দিতে হবে।
তখন কত ভদ্র পরিবারের বখে যাওয়া ছেলেকেও ক্লিনার স্যুইপারের
চাকরী দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছেন তার হিসাব নিজেও জানেন না। ততদিনে পরিশ্রম আর
বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রিয়াজের বাবার ডান হাত হয়ে উঠেছিলেন জহির। রিয়াজ যখন টাকা ওড়াচ্ছে
দুই হাতে, জহির তখন ব্যাবসা শিখছেন, টাকা জমাচ্ছেন। একটাই মন্ত্র
মনে মনে জপছেন- উপরে উঠতে হবে আরও উপরে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। চট্টগ্রাম থেকে
ঢাকায় ফিরতে দাউদকান্দি ফেরীতে গাড়িসহ মেঘনায় ডুব দিলেন রিয়াজের বাবা।
রিয়াজের মা ব্যবসায়িক ব্যাপারে নির্ভর করলেন জহিরের উপর।
কারণ রিয়াজের বাবা করতেন।
মা-ছেলেতে শুরু হল দ্বন্দ্ব। এদিকে ইঁদুর গোলা কাটছে।
তারপর আর-এম-পি ইন্টারন্যাশনাল ভেঙে গড়ে নতুন আদমের প্রতিষ্ঠান আল-এরাবিয়ান
ইন্টারন্যাশনাল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেই বন্ধু ফরিদ আজ আল-এরাবিয়ান
ইন্টারন্যাশনালের অ্যাকাউনটেন্ট।
ইন্টারকমটা পুঁ পুঁ শব্দ করে উঠল।
"ইয়েস"
"স্যার, আমি আরমান, পি এস"
"হ্যাঁ,
বল"
"স্যার, আজকে লাঞ্চ করবেন না? টাইম ওভার হয়ে যাচ্ছে,
ড্রাইভার বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। আর স্যার –"
"আর কী? কোন প্রবলেম?"
"না স্যার তবে ওই ছেলে দুটো এখনও বসে আছে।"
"ও আচ্ছা আচ্ছা। তা বসে থাক। তুমি খাবার পাঠিয়ে দাও। আমি খেয়ে
ওদের সাথে কথা বলব।"
ঘড়ির দিকে তাকালেন - দুটো বেজে দশ। আজ তেমন কোন কাজই হয়নি। ভাবতে
ভাবতেই একটা বেলা কাবার করে দিলেন। রুমা থাকলে এতক্ষণে তিনবার ফোন দিত, কিন্তু সে গেছে কানাডায় ছেলেকে ভর্তি
করাতে।
আজকাল এ এক ফ্যাশন হয়েছে। দাড়ি গজানোর আগেই ছেলেগুলো বিদেশে যেতে চায়। ইংরেজি স্কুলে
পড়া ছেলেরা বাংলাদেশের চাইতে বিদেশে পড়াশুনা করাটাকে স্ট্যাটাস সিম্বল মনে করে।
অবশ্য জাহির নিজেও মনে করেন। তার ছেলে বিদেশে না পড়লে সামাজিক অবস্থানে তিনিও
কিছুটা পয়েন্ট হারাবেন।
ভাত খেয়ে একটা সিগারেট ধরালেন,
তারপর ছেলে দুটোকে ডেকে পাঠালেন। রুমে ঢুকতেই ভাল করে
পর্যবেক্ষণ করলেন। এমন কি ওদের সালাম দেওয়াও। তাঁর আদেশ মতো সামনের চেয়ার দুটোতে
বসল ওরা।
"হ্যাঁ, বল।"
"স্যার, সাফিয়া ম্যাডাম পাঠিয়েছে আমাদের।"
"জানি, এখন বল হিসাবপত্তর এনেছ কিনা। কোন খাতে কত খরচ স্পষ্ট করে না
দেখালে আমি টাকা পয়সা দেব
না।"
"জী স্যার, হিসাব পাক্কা। দাওয়াতপত্র, ব্যানার, কম্যুনিটি সেন্টার ভাড়া,
ডেকোরেটার আর পদক সব সহ সাতান্ন হাজার টাকা স্যার। এটা অবশ্য আনুমানিক।"
কথা শেষ করতে না দিয়েই ধমকে উঠলেন জাহির খান -
"এত টাকা কেন? এত
টাকা হলে তো ঢাকা শহরেই পদক পাওয়া যেত। তার জন্য বিক্রমপুর যেতে
হত না।"
"স্যার তা
তো অবশ্যই। তবে কি স্যার জানেন এখন রাজধানীর মত
মফস্বলের মানুষও দর হাঁকতে ছাড়ে
না। মিডিয়া মানুষকে অনেক বেশি চালাক বানিয়ে
ফেলেছে। জানেন না স্যার, ম্যাডাম বলার পর থেকে আমরা কলেজের পড়া বাদ দিয়ে দিনরাত
ছুটাছুটি করছি।"
"আচ্ছা, আচ্ছা"
- হাতে ফোন তুলে নিতে নিতেই বললেন "আমি
একাউন্টসে বলে দিচ্ছি। তোমরা আপাতত বিশ হাজার টাকা নাও। তাও সই করে নেবে।"
"মাত্র বিশ হাজার স্যার?"
চটপটে ছেলেটা অবাক হয়ে বলল। "ঢাকা
শহরে যাতায়াত করতেই তো অনেক সময় আর টাকা খরচ হয়।"
ভালো করে তাকালেন ছেলে দুটোর দিকে। বেশ চালাক চতুর মনে হচ্ছে।
এরা কি আসলেই পারবে শাশুড়ি মাতার ইচ্ছা পূরণ করতে?
"কী নাম তোমার?"
যে ছেলেটি কথা বলছিল তাকে প্রশ্ন করলেন।
"জী আনোয়ার।"
"আর তোমার?"
"হাসিবুল।"
"তো আনোয়ার, তোমরা মনে হয় জানো না কোন কাজ করতে গেলে পুরো টাকাটা অগ্রিম
দেয়া হয় না। আর আমি ফুল পেমেন্ট করব পুরো কাজ শেষ হলে,
বিল দেখে। তোমরা এখন যাও। আর হ্যাঁ এর আগে যে
পাঁচশো টাকা দিয়েছিলাম সেটা তোমাদের যাতায়াত ভাড়া। আর এখন থেকে সব টাকা কাগজে
কলমে সই করে নেবে।"
"স্যার - "
"আঃ আর কথা বলার সময় নেই। আমার হাতে অনেক কাজ"…
জহিরের আঃ শব্দের ধাক্কাই যেন ছেলে
দুটিকে চেয়ার থেকে দাঁড় করিয়ে দিল। ওরা সালাম দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।
সামনের ফাইলটা খুলে মনযোগী হলেন। এমন সময় মোবাইলটা আবার বেজে
উঠলো। আবার শাশুড়ি আম্মা।
"জাহির, ছেলেগুলো এসেছিল? কথাবার্তা হয়েছে তো?"
"জী আপনি চিন্তা করবেন না। সব হয়ে যাবে।"
ফোন রেখে এবার হাসলেন জাহির। টাকা হয়েছে, এবার খ্যাতির পিছনে ছোটো।
প্রতিষ্ঠিত হতে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় হওয়াতে একটু বেশি
বয়সে বিয়ে করেছেন। কিন্তু সেখানেও ক্যালকুলেশন ছিল। শ্বশুরবাড়ি যাতে বিপদে আপদে
সাপোর্ট দিতে পারে সেরকমই খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী বন্ধুর ভাইজিকে বিয়ে
করলেন।
কিন্তু কিছুদিন থেকে বউ আর শাশুড়ির শখ চেপেছে নাম কেনার, সমাজে আরও বিশিষ্ট হওয়ার।
হতে আপত্তি তারও নেই, শুধু টাকা খরচ করতে ইচ্ছে করে না। টাকা যে পৃথিবীতে
সবচেয়ে দামী, সেটা
তার চেয়ে বেশি কে জানে?
জাহির খান রেডি হচ্ছেন। স্ত্রী রুমা তার টাই
ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। সবশেষে এবার কানাডা থেকে আনা দামী পারফিউমটা
কোমল ভাবে স্বামীর শরীরে ছড়িয়ে দিল।
গাড়ি প্রস্তুত। বার বার ফোন আসছে - "স্যার আসছেন তো? সব রেডি।"
সভায় পৌঁছাতে যানজটে পড়ে একটু দেরিই হল। ঢাকা
থেকে বিক্রমপুর- কম রাস্তাও তো নয়। গেট দিয়ে ঢুকার আগেই কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল – ভিডিও হচ্ছে। একপাশে শাশুড়ি, একপাশে স্ত্রীকে নিয়ে হাসিমুখে
দাঁড়ালেন। এবার সাংবাদিকদের পালা। ঘিরে ধরেছে।
"স্যার, আপনি তো প্রথম জগদীশচন্দ্র পদক পাচ্ছেন।"
"হ্যাঁ"
- অল্প কথায় সারতে চাইলেন।
"তা এই খবর যখন জানলেন তখন আপনার কেমন লাগলো?"
শাশুড়ির দিকে তাকালেন জহির।
হাসলেন। তারপর জবাব দিলেন -"কাজের স্বীকৃতি পেলে কে
না খুশি হয় বলুন? আমি
সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করছি, তাঁরাও আমাকে সেজন্য স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করছেন।
এটা তো আনন্দের বিষয় অবশ্যই।"
চারপাশের অভ্যর্থনাকারীরা হাততালি দিয়ে উঠল। জহির আবারও
হাসলেন। ভিতরে-বাইরে
সব রিহার্সেল
দেয়া। তবুও এমন ভাব, যেন চমকিত হচ্ছেন।
সবাইকে পিছনে রেখে আনোয়ার আর হাসিবুল তাকে এসকর্ট করে
সামনের সারিতে নিয়ে এলো। মঞ্চে আলোচনা চলছে- জগদীশচন্দ্র বসুর
জীবন ও কর্ম। এখন থেকে প্রতিবছর সমাজসেবা আর শিক্ষায় অবদানের জন্য একজনকে এই পদক
দেয়া হবে।
জাহির প্রধান অতিথির কাছ থেকে পদক নিলেন সমাজসেবায় অবদানের
জন্য। নিজের পছন্দ করা পদক।
চারপাশে ফ্লাশ জ্বলে উঠল। আজ রাতে চ্যানেলে চ্যানেলে দেখাবে, কাল পত্রিকায় আসবে – একদার আদম ব্যাপারী বর্তমানের বিশিষ্ট
ব্যবসায়ী জাহির খানের গুণকীর্তন। তারপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অভিনন্দন জানাবে – সবই ব্যবসা।
বিদায় নেবার বেলায় ছেলে দুটো দৌঁড়ে এল। গাড়িতে
তুলে দিতে দিতে নিচু স্বরে বলল,
"স্যার আমাদের বাকি টাকাটা?"
চকিতে মামার সে কথাটা মনে এল। সিটে উঠতে উঠতে ওদের
বললেন, "লেগে থাক।"
গাড়িটা ছাড়তেই আনোয়ারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল –
“শালা
কঞ্জুসের বাচ্চা কঞ্জুস!”
No comments:
Post a Comment