__________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।
গল্প - সুখপাখি
____________________________________________
সুখপাখি
সায়মার বড় ছেলে যখন টেবিলটা
নিয়ে এল তখন বাড়িতে তিন ভাই-বোনের মধ্যে একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। কোথায় রাখা হবে
টেবিলটা কোনদিকে মুখ করে মা বসবে, জানালার বাতাস, ফ্যানের বাতাস ঠিকমতো লাগবে
কিনা এ নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা আর হুড়োহুড়ি হল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল মায়ের বিছানার
পাশে জানালার কাছে রাখা হবে এতে ফ্যানের বাতাসও জানালা দিয়ে আসা আলো বাতাস দুটোই
পাওয়া যাবে। আজকালতো অহরহ লোডশেডিং আবার সুইচবোর্ডটা খাটের পাশের দেয়ালে থাকায়
প্রয়োজনে টেবিল ফ্যানটাও রাখা যাবে। এখনতো গরম এত বেশি আর এ বছরের গরমেরতো
হিসাব-নিকাশ নেই।
সন্তানদের উচ্ছলতায় এক ধরনের স্নেহমাখা
আনন্দ অনুভব করে সায়মা। বাৎসল্য রসে তাঁর বুকটা ভরে ওঠে। হোক না ছোট্ট একটা টেবিল।
আহামরি কিছু নয়। কিন্তু ছেলে মেয়েরা যে তার কথা ভেবেছে, মায়ের কষ্টটা, চাওয়াটা
অনুভব করেছে সেটাইতো পরম পাওয়া। বড়ছেলে চাকরি পেয়ে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে
সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য টেবিলটা কিনে এনেছে। ছোট দুভাইবোনও এতে মহাউল্লসিত। মেজ
ছেলে যে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রীর অপেক্ষায় আছে সেও আজ টিউশানীতে যায়নি। আর
মেয়েতো এখনি লাফাচ্ছে, ভাইয়া একটা টেবিলল্যাম্পও লাগবে। আমিতো মায়ের পাশে শুই,
রাতে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে লেখাপড়া করলে আমি ঘুমাবো কীভাবে?
-তুইতো একটা কুম্ভকর্ণ। ঘুম এলে তোকে
চোরে নিয়ে গেলেও তুই টের পাবি না।
-হুঁ, তোকে বলেছে- আমি তো রাতে ঘুমাই।
আর তুই তো সুযোগ পেলে দিনরাত ঘুমাস।
-এত বকবক করিস নাতো সুমী। মা তোমার
টেবিল ক্লথটা বের করোতো। সুমী বিছিয়ে দিক। আর সবসময়ের দরকারি বইগুলো টেবিলে গুছিয়ে
রাখুক।
টেবিল ক্লথের কথা উঠতেই স্মৃতিকাতর হয়ে
পড়ে সায়মা। কতদিন আগের করা টেবিলক্লথ! ত্রিশ বছরে মতো তো হবে। বিয়ের পর পর যখন
সংসারের কাজকর্ম করেও সময় কাটতো না, তখন স্বামীকে বলেছিলেন- আমার জন্য দেড় গজ সাদা
কাপড় এনো তো। আজিম জানতে চেয়েছিল- কি করবে?
-একটা টেবিলক্লথ সেলাই করব এমব্রয়ডারি
করে।
-তাহলে তো সুতাও লাগবে।
-হ্যাঁ।
-তাহলে অফিস থেকে এসে দুজনে মিলে বিকেলে
মার্কেটে চলো তোমার পছন্দের রঙের সুতাও কিনবে।
সেই কাপড় সেই সুতা দিয়ে ট্রেসিং পেপারে
ফুল-লতা-পাতার ছাপ দিয়ে যত্ন করে টেবিল ক্লথটি সেলাই করেছিল। কিন্তু টেবিলের অভাবে
আর বিছানো হলো না। ওটা পড়ে থাকল স্যুটকেসের কাপড়ের ভাঁজে। দুজনের সাবলেটের বাসায়
টেবিল রাখার জায়গা ছিল না।
তারপর ছেলেমেয়েরা জন্ম নিল পর পর।
অফিসের কোয়ার্টারে বাসা হল। দুটো বেডরুম আর ড্রইং ডাইনিং রুমের স্বল্প পরিসরে
টেবিল আর এলো না। বাচ্চারা ডাইনিং টেবিলে বসেই লেখাপড়া করেছে। সায়মা নিজেও বি এড
পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন ঐ টেবিলে বই খাতা রেখেই। পরে যখন শিক্ষকতা পেশায় যোগ
দিল তখনও ভরসা ঐ ডাইনিং টেবিল। তখন মাঝে মাঝে মনে হতো একটা পড়ার টেবিল থাকলে নিজের
মতো করে লেখা যেত, পড়া যেত। দু’চারটা বই টেবিলে থাকলে অবসরে নেড়েচেড়ে দেখা যেত। কিন্তু সংসার এমন এক
পাকচক্র এখানে অনেক সময় ছোট ছোট সুখগুলোও কোন কোনও মানুষ নানা কারণে সারা জীবনেও
কিনতে পারে না। আজকাল করে জীবন বয়ে যায় সাধটুকু পূরণ হয় না। সায়মারও হয়নি।
বিয়ের তিনবছরের মধ্যে দুই ছেলে জন্মালে
স্বামীকে সাবধান করেছিল- এবার ফুলস্টপ।
-একটা মেয়ে না হলে সংসার ভরে? আজিম
বলেছিল।
-না, এসব একদম বলবে না। তাহলে তোমাকে
আরেকটা বিয়ে করতে হবে।
-তুমি সেটা সইতে পারবে? হাসতে হাসতেই
প্রশ্ন করেছিল আজিম।
-পারবো না, কিন্তু বাচ্চা নিতেও আর পারব
না। ছেলে মেয়ে মানুষ করার দায় আছে না।
কথাটাতে ইঙ্গিত ছিল। আজিমকে চাকরির
টাকায় একদিকে মা-ভাই-বোনকে টানতে হত অন্যদিকে নিজের সংসার। বিয়ের আগে বি এ পাশ ...
বিয়ের পর সায়মা অনেক কষ্ট করে বি এড পাশ করে স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। এরই মাঝে ছোট
ছেলের তিনবছর পর সামান্য অসাবধানতায় সুমী এল। এবং আজিমের ইচ্ছা পূরণ করতেই যেন
মেয়েটা এল।
বাপের সেকি আদিখ্যেতা মেয়েকে নিয়ে। সেই
মেয়েরই মুখে কথা না ফুটতে অফিসট্যুরে গিয়ে বাস অ্যাক্সিডেন্টে লাশ হয়ে ফিরল।
তারপরতো দীর্ঘ সংগ্রামের জীবন। ছেলেমেয়ে মানুষ করো, টিউশানী করো, সংসার সামলাও।
এত বছর পরও মনের ভিতর একটা সখ লুকানো
ছিল। নিজের একটা রুম, যেখানে নিজের মতো করে হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায় আর একটা টেবিল
যেটা তাঁর সামান্য লেখালেখি আর পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য থাকবে। কিন্তু
মধ্যবিত্তের জীবন আবার যে জীবনে মাথার ওপর ছাতার মতো ছায়া দেবার মায়া দেবার
মানুষটাও আচমকা বিদায় নিয়েছে সে জীবন চৈত্রের রোদ ছাড়া আর কিছু থাকে কি?
থাকে। সন্তান থাকে, তাদের প্রতি দায়
থাকে এবং সে দায়ের বোঝা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তারপর সন্তান সঠিক মানুষ হলে কিছুটা
হলেও স্বস্তি আসে।
সায়মা আজ সেটুকু কিছুটা হলেও পেয়েছেন।
ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে। মায়ের দুঃখ কষ্টটা ওরা বুঝতে
পারে, খেয়াল রাখে। আজ তাই কোন অতৃপ্তি নেই তার। জীবন এত খেয়ালী যে কারটা কখন কেড়ে
নেবে আবার কখন ফিরিয়ে দিয়ে ভরিয়ে দেবে তা কেউ জানে না।
সায়মার জীবনটাও শত অভাব অনটনেও
ছেলেমেয়েদের ভালবাসায় ভরে উঠেছে। মাকে না জানিয়ে বড় ছেলে মায়ের জন্য টেবিলটা কিনে
এনে মাকে বিস্মিত আনন্দিত করতে চেয়েছে এর চেয়ে বড়ো সুখ আর কী আছে!
সারা সন্ধ্যা ঘুরে ফিরে টেবিলটাই মনের
মাঝে একটা আনন্দের আবহ তৈরি করে রাখল। মনে পড়ল ক্লাশ সেভেনে স্কুলের দেয়াল
পত্রিকার প্রথম ছোট্ট একটা গল্প ছাপা হয়েছিল। তারপর বার্ষিকীতে কবিতা। তারপর
ছোটমামা একদিন বাসায় এসে সায়মার লেখার খাতাটা দেখেছিলেন। অনেক সংকোচের বাঁধা
পেরিয়ে মামাকে বলেছিল, আমার না লিখতে ইচ্ছা করে মামা। বইতে যেসব গল্প কবিতা পড়ি
সেগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় আমিও লিখি।
-ভালই তো। লিখিস না কেন?
সায়মা আমতা আমতা করে বলেছিল, লিখেছিতো
দু-একটা। তুমি কী দেখবে?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখা।
মামা আগ্রহ নিয়ে পড়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ
তোর লেখা বেশ ঝরঝরে। আর ভুলটুলও তেমন নেই। আজকালতো বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ভুল লিখতে
ভুল করে ঊ-কার দেয়।
পরের সপ্তায় মামা দুটো বই নিয়ে
এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা আর গল্পগুচ্ছ। সেদিন সায়মার সে কী উত্তেজনা। সে
বই দুটো আজও পরম যত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে। পাতা উল্টালে মামার হাতে লেখা আশীর্বাণী
চোখে পড়ে। অথচ মামা চলে গেছেন কতদিন আগে।
আজিমের কথা মনে হয়। নিজের পড়ার অভ্যাস
না থাকলেও সায়মাকে উৎসাহ দিত। কিন্তু যখন একটা গল্প-উপন্যাসের ভিতর ঢুকে রাত জেগে
পড়তে চাইত তখন আপত্তি জানাত। রাতটা আমার জন্য রাখোনা সামু। তুমি বইয়ের প্রেমে মজলে
এ অভাগা কোথায় যাবে।
পিছন থেকে দু হাতে জড়িয়ে বইটা বন্ধ করে
দিত। আজও ভাবলে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। চলে যাবে বলেই কি এত ভালবেসেছিল মানুষটা।
তাকে ঘিরে মাত্র কটা বছরের সুখস্মৃতি আজও সায়মাকে কাঁদায় হাসায়।
মা কি এত ভাবছ?- সুমী এসে পেছন থেকে
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
-কই কিছু না তো!
-না, কিছু তো ভাবছিলে তবে মজার কিছু
হবে। তোমার মুখটা কেমন হাসি হাসি দেখাচ্ছিল।
-তাই বুঝি। আমার মেয়েটাতো দেখি অনেক বড়
হয়ে গেছে। মুখ দেখেই সবকিছু বুঝতে পারে।
মেয়ের হাত দুটোকে আরও টেনে গলায় চেপে
ধরেন।
রাতে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ছোট
ছেলে টিউশানী সেরে ফেরার সময় সত্যি সত্যি একটা ল্যাম্পশেড নিয়ে এল। মেয়ের উচ্ছ্বাস
বাঁধভাঙা। টেবিলের ওপর কোথায় রাখলে মায়ের সুবিধা হবে আর ঘুমেরও ডিসর্টাব হবে না
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটা যাচাই করল। তারপর তার পছন্দের জায়গায় রাখল।
সায়মার মনে হল, সুখ কাকে বলে? সুখ কিনতে
কি অনেক টাকা লাগে? অনেক স্বপ্নের টেবিল আর সুন্দর ল্যাম্পটা ছাপিয়ে সন্তানদের
ভালবাসা তাকে যে সুখ আজ দিল তার মতো পার্থিব-অপার্থিব আর কিছু কি আছে। সুখের
আতিশয্যেই বুকটা টনটন করছে? সায়মা বুঝতে পারে না। বেশ কিছুদিন ধরেই বুকটা চিনচিন
করে। আজ এত খুশিতে চিনচিন করছে। তাহলে এটা সুখের ব্যাথা।
মেয়ে শুয়ে পড়েছে। সায়মা মশারির ওপর
পাতলা একটা কাপড় ঝুলিয়ে দেয় যেন ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। সকালে উঠেইতো দৌড়াবে
ইউনিভার্সিটিতে।
বইয়ের ব্যাগ থেকে একটা ডায়রী বের করেন।
নিউ ইয়ারে এক ছাত্রী দিয়েছিল। খুব সুন্দর এই ডাইরীটিতে কবিতা লিখবে বলে যত্নে
রেখেছিল। আজ বহুদিন পরে যেন তার ভেতর জেগে উঠেছে কবিতার শ্যামল চরাচর। একদিন জীবন
নদীর ভাঙনে যে চর ডুবে গিয়েছিল আজ বহুদিন পর সে চরের মাটিতে যেন সবুজের আভা
জেগেছে।
কি লিখবে? অনেকক্ষণ কলম ধরে নিজেকে
খুঁজে বেড়ায়। আজিমের কথা মনে পড়ছে। শরীরে রক্ত ভেজা কাপড়। মুখটা থেঁতলে গেছে গাড়ির
নিচে। সে মুখ সায়মাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না।
সায়মা কতবার কতজনকে বলছে, আমাকে শুধু
একবার দেখতে দাও। একবার ধরতে দাও। আমি একবার ওকে জ্ঞিজ্ঞেস করবো, কেন কেন আমাকে
এভাবে একা রেখে সে চলে গেল।
কিন্তু চাচী, ফুফু, বোনেরা তাকে জোর করে
ধরে রেখেছে। উহ কত শক্তি থাকলে সে ওদের হাত থেকে ছাড়া পাবে। কত শক্তি, শক্তি যে
নিঃশেষ হয়ে আসছে। উহ, ছেড়ে যাও, ছেড়ে দাও। বুকটা চিনচিন করছে। বুক চেপে ধরে উহ বলে
মাথাটা টেবিলের ওপর গড়িয়ে পড়ে। হাতের কলম ছিটকে যায়। রাত বাড়তে থাকে।
No comments:
Post a Comment