Friday, 14 March 2025

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধানে

 




বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণাগুলিকে প্রধানত পাঁচটি ধাপে ভাগ করা যায়: কণা পদার্থবিজ্ঞানের ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশানের গাণিতিক বিশ্লেষণ, জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সঠিক সমাধান, মহাজাগতিক ধুলোকণার ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি, এবং গাণিতিক অর্থনীতি।

জামাল নজরুল ইসলামের মৌলিক গবেষণা শুরু হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শুরু করার সময় থেকে। তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন জন ক্লেটন টেইলর। ব্রিটিশ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী জন টেইলর ছিলেন প্রফেসর আবদুস সালামের ছাত্র। ১৯৫৬ সালে প্রফেসর আবদুস সালাম এবং রিচার্ড ইডেনের তত্ত্বাবধানে তিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে পিএইচডি করেছেন। এরপর যোগ দিয়েছিলেন লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে প্রফেসর আবদুস সালামের ডিপার্টমেন্টে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনার পর ১৯৬১ সালে যোগ দিয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স ও থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসেবে। সেই বছরই সেখানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন জামাল নজরুল ইসলাম। জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন জন টেইলরের প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের একজন। জামাল নজরুল ইসলাম তখন মাত্র ২২ বছরের তরুণ, আর তাঁর সুপারভাইজার জন টেইলর তখন ৩১ বছরের যুবক।

জামাল নজরুল ইসলাম পিএইচডি গবেষণার কাজ শুরু করলেন ১৯৬১ সালে। গাণিতিক দক্ষতায় তুখোড় জামাল নজরুল ইসলামের আগ্রহ পার্টিক্যাল ফিজিক্সের সমসাময়িক গাণিতিক সমস্যার সমাধানের প্রতি। কাজ শুরু করলেন মাত্র তিন বছর আগে ১৯৫৮ সালে উদ্ভাবিত “ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভ্যারিয়েবল নিয়ে গবেষণা।

যাঁর নামে এই ভ্যারিয়েবল – সেই প্রফেসর স্ট্যানলি ম্যান্ডেলস্ট্যাম তখন ইংল্যান্ডেই ছিলেন। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন তখন। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে  জন্ম স্ট্যানলি ম্যান্ডেলস্ট্যামের। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে পোস্টডক্টরেট ফেলোশিপ করার সময়েই তিনি কণা পদার্থবিজ্ঞানে রিলেটিভিস্টিক তথা আপেক্ষিকতার আলোকে গাণিতিক হিসেবের সুবিধার্থে উদ্ভাবন করেছেন একটি বিশেষ সুবিধাজনক পদ্ধতি যা তাঁর নামেই পরিচিতি লাভ করেছে – ‘ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভ্যারিয়েবলস। দুটো কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটার সময় তাদের শক্তি, ভরবেগ এবং পারস্পরিক কৌণিক অবস্থান সবগুলিকে কার্যকরভাবে গাণিতিক সমীকরণে প্রকাশ করার জন্য ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান খুবই কার্যকরী।

ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান উদ্ভাবনের দশ বছর আগে ১৯৪৮ সালে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের হিসেবনিকেশ সহজ করার জন্য উদ্ভাবন করেছেন ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রামএর। ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশানও অনেকটা সেরকম পদ্ধতি হলেও ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গবেষণাতেই চতুর্মাত্রিক ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের সাথে ম্যান্ডেলস্ট্যাম পদ্ধতির সমন্বয় ঘটালে কী হয় – তা গাণিতিকভাবে করে দেখাতে সমর্থ হলেন। ১৯৬২ সালের ১৮ মে তিনি জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সে প্রকাশের জন্য পাঠালেন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র Modified Mandelstam Representation for Heavy Particles। সেবছরই নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। [Journal of Mathematical Physics, Volume 3, Number 6, November-December 1962, pages 1098-1106.]

জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রে ম্যান্ডেলস্ট্যামের পদ্ধতি অনেক ভারী কণার উপর প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারী কণার ক্ষেত্রে ফোর্থ অর্ডার ফাইনম্যান অ্যামপ্লিটিউড কাজ করে না। এই গবেষণায় তিনি বার্গম্যান-ওয়েইল ফরমুলা ব্যবহার করেছেন। অনেকগুলি গাণিতিক চলক বা ম্যাথমেটিক্যাল ভ্যারিয়েবলকে একসাথে সমন্বয় করে ইন্টিগ্রেল ফরমুলায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বার্গম্যান-ওয়েইল ফরমুলা খুবই কার্যকর গাণিতিক পদ্ধতি। ১৯৩৫ সালে ফরাসি গণিতবিদ আঁন্দ্রে ওয়েইল এবং ১৯৩৬ সালে পোলিশ-আমেরিকান গণিতবিদ স্টিফেন বার্গম্যান আলাদা আলাদাভাবে এই ফরমুলা আবিষ্কার করেন।

প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্র ‘ Acnodes and Cusps and the Mandelstam Representation’ প্রকাশের জন্য পাঠান জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সে। ১৯৬৩ সালের জুলাই সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। [Journal of Mathematical Physics, Volume 4, Number 7, pages: 872-878, July 1963.] এই গবেষণাতেও তিনি ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম এবং ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান এর সমন্বয়ের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেন ল্যান্ডাউ সমীকরণে প্রয়োগের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে কণার বিক্ষেপণের মাত্রা হিসেব করার জন্য ফাইনম্যান ইন্টিগ্রেলের শর্তগুলি নির্ধারিত হয় ল্যান্ডাউ সমীকরণের মাধ্যমে। সোভিয়েত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ল্যান্ডাউ ১৯৬২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তরল হিলিয়ামের সুপারফ্লুইডিটি আবিষ্কারের জন্য।

১৯৬২ সালে প্রফেসর জন টেইলরের গ্রুপে যোগ দেন সদ্য পিএইচডি অর্জন করা ব্রিটিশ তরুণ পিটার ভিনসেন্ট ল্যান্ডশফ। জামাল নজরুল ইসলামের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় অংশ নিতে পিটারও খুব আগ্রহী। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই জন টেইলর, পিটার ল্যান্ডশফ এবং জামাল নজরুল ইসলাম যৌথভাবে তৈরি করে ফেললেন গবেষণাপত্র ‘Singularity of the Regge Amplitude’.

ইতালির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী টুলিও রেজ্জে ১৯৫৯ সালে স্ক্যাটারিং মেট্রিক্স প্রপার্টিজ গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেছেন উচ্চশক্তির কণার বিক্ষেপণের সূত্র – রেজ্জে থিওরি। রেজ্জে অ্যামপ্লিচিউড হিসেব করা হয় বিক্ষেপণের মাত্রা থেকে। কণাপদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল এই গবেষণাপত্রটি যেটা পরবর্তীতে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, স্ট্রিং থিওরি এবং অন্যান্য ভারী কণার মিথষ্ক্রিয়ার হিসেব কষতে ব্যবহৃত হয়। জামাল নজরুল ইসলাম রেজ্জে অ্যামপ্লিচিউডের সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করেছেন ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্র। [Physical Review, Volume 130, Number 6, pages: 2560-2565, 15 June 1963.]

১৯৬৩ সালের এপ্রিলে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর পরের গবেষণাপত্র Leading Landau curves of some Feynman diagrams পাঠালেন ইতালির নোভো সিমেন্টো জার্নালে। এই গবেষণায় ল্যান্ডাউ কার্ভের সাথে ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের উপযোগিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান পরীক্ষা করে দেখা হয়। অবশ্য এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর মাসে [Nuovo Cimento, Volume 30, pages: 259-265, 1963]। তার আগেই তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস জমা দিয়েছেন।

১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম, সেটুকুই যথেষ্ট ছিল তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘Analytic Properties of S-Matrix Elements’ জমা দেন। মাসখানেক পরেই তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তবে পিএইচডির রেজাল্ট প্রকাশিত হবার আগেই তিনি আমেরিকার মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগে যোগ দেন রিসার্চ ফেলো হিসেবে। কোরিয়ান বংশদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী ইয়ং সু কিম মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে যোগ দিয়েছেন মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। ইউ এস এয়ারফোর্স আর ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশানের দুটো রিসার্চ-গ্রান্টের আওতায় তিনি তাঁর প্রথম রিসার্চ ফেলো হিসেবে বেছে নিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলামকে।

মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে দুবছর ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। কণাপদার্থবিজ্ঞানের দুরুহ গণিত নিয়েই গবেষণা চালিয়ে গেছেন সেখানেও। ১৯৬৫ সালের জুন মাসে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হলো ডক্টর কিমের সাথে তাঁর যৌথ গবেষণাপত্র Analytic property of three-body unitarity integral [Physical Review, Volume 138, Number 5B, pages: B1222-B1229, 7 June 1965।] এই গবেষণাটি তাঁর আগের গবেষণাগুলি থেকে কিছুটা আলাদা হলেও বিষয়ের দিক থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র নয়। বিক্ষেপণের সময় তিনটি কণার মধ্যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার জটিল গাণিতিক শর্তাবলী নির্ণয়ে ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশান এবং ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের বিশ্লেষণ এই গবেষণাতেও আছে।

জামাল নজরুল ইসলাম ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশান সংক্রান্ত অত্যন্ত জটিল যেসব গাণিতিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সেগুলি পরবর্তীতে কণাপদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির গণিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে স্ট্রিং থিওরি তখনো জন্ম লাভ করেনি, সেই স্ট্রিং থিওরিতেও এসব গাণিতিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হচ্ছে।

১৯৬৫ সালের শরৎকালে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এবার যোগ দিলেন প্রফেসর ফ্রেড হয়েলের কসমোলজি গ্রুপে। গাণিতিক কসমোলজির গবেষণা শুরু করলেন জামাল নজরুল ইসলাম।

১৯৬৪ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ পরপর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ফ্রেড হয়েল এবং জয়ন্ত নারলিকার [Proceedings of Royal Society, Volume A282, pages: 178-183, 184-190, 191-207, 1964.] এই তিনটি গবেষণাপত্রে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির আলোকে স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রেড হয়েল এবং জয়ন্ত নারলিকার। স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাঁরা একটি কাল্পনিক ক্রিয়েশান ফিল্ড বা সি-ফিল্ডের ধারণা প্রবর্তন করলেন। স্টেডি-স্টেট থিওরি সঠিক হলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও তার গড় ঘনত্ব সবসময় অপরিবর্তিত থাকবে। সেক্ষেত্রে অনবরত নতুন পদার্থের উদ্ভব হতে হবে। সি-ফিল্ডের প্রভাবে শূন্য থেকে হাইড্রোজেন পরমাণুর উদ্ভব হতে থাকে যতটুকু দরকার হয়, যখন দরকার হয়। গ্রিন ফাংশানের সাহায্যে সি-ফিল্ডের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকার। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সাহায্যে তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র এবং জেনারেল রিলেটিভিটির  প্রয়োগে ভর-ক্ষেত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণও তাঁরা করেন গ্রিন ফাংশানের মাধ্যমে। এজন্য গ্রাভিটেশানের একটি নতুন তত্ত্বও তাঁরা দেন [F. Hoyle and J. V. Narlikar, A New theory of gravitation. Proceedings of the Royal Society, Volume A282, pages: 191-207, 1964]. জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সাথে কোন বিরোধ নেই তাঁদের এই নতুন তত্ত্বে। কেবল পার্থক্য হলো জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ব্যাখ্যায় এবং মহাকর্ষ ধ্রুবকের মান নির্ধারণে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সমীকরণের বিশেষ পর্যায়ে [যখন Rik = 0] শূন্য মহাবিশ্ব বা মহাশূন্য অবস্থা তৈরি হতে পারে – যেখানে শূন্যস্থানের জন্যও স্থান দরকার হয়। ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের গ্রাভিটেশানের নতুন তত্ত্ব অনুসারে – শূন্যস্থান একেবারেই শূন্য – তাকে স্থান দেয়ার কোন দরকার নেই। শুধু তাই নয়, যে কোনো স্থানে কমপক্ষে দুটো কণা থাকতে হবে এই নতুন তত্ত্ব অনুসারে।

জামাল নজরুল ইসলাম ফ্রেড হয়েলের গ্রুপে যোগ দিয়েই প্রথম যে গবেষণাটি করলেন সেটা হলো হয়েল ও নারলিকারের সি-ফিল্ড, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক-ফিল্ড ও ম্যাস-ফিল্ডে যেভাবে গ্রিন ফাংশান প্রয়োগ করা হয়েছে – সেভাবে ডিরাক-ফিল্ডে গ্রিন ফাংশানের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা।

ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের সাথে অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর জামাল নজরুল ইসলাম রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করলেন Green function formulation of the Dirac field in curved space [Proceedings of the Royal Society of London, Series A, Mathematical and Physical Sciences, Volume 294, Number 1439, pages: 437-448, October 1966.] বলা যায় এই গবেষণাপত্রের মাধ্যমে শুরু হলো জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার নতুন ক্ষেত্র – জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি। জামাল নজরুল ইসলামই সর্বপ্রথম গ্রিন ফাংশানের মাধ্যমে ডিরাক ফিল্ডের গাণিতিক ফরমুলা আবিষ্কার করেন।

১৯৬৬ সালে ফ্রেড হয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্সটিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের এটাই ছিল প্রথম ইন্সটিটিউট। এর আগে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরি স্থাপিত হয়েছিল ১৮২৩ সালে। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোলার ফিজিক্স অবজারভেটরি। ১৯৭২ সালে এই তিনটি বিভাগকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় কেমব্রিজ ইন্সটিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি। থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হলেন ফ্রেড হয়েল। প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন জয়ন্ত নারলিকার। জামাল নজরুল ইসলামও এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করেছেন।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটে গবেষণা করে সাতটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন জামাল নজরুল ইসলাম। এই সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং গ্রাভিটি। যেগুলি ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজির মৌলিক গাণিতিক ভিত্তি।

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করে আবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ফিল্ড ইকুয়েশনের ক্ষেত্রে গ্রিন ফাংশান ফরমুলা কেমন হবে সে সম্পর্কিত জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র যে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে তা আগেই উল্লেখ করেছি। এবার তিনি যেকোনো ধরনের মহাকর্ষ ক্ষেত্রে কণাগুলির মিথষ্ক্রিয়ার গ্রিন ফাংশান ফরমুলা প্রকাশ করলেন তাঁর ‘Green function formulation of interactions of arbitrary fields’ গবেষণাপত্রে [Mathematical proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 65, Number 3, pages: 759-771, May 1969.]।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব সংক্রান্ত ক্ষেত্র-সমীকরণের উপর জামাল নজরুল ইসলামের শেষ গবেষণাপত্র ‘Conformal frames and field equations in a conformal theory of gravitation’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 67, Number 2, pages: 397-414, March 1970.]। ততদিনে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান এবং অন্যান্য প্রমাণ সামনে আসার পর ফ্রেড হয়েলের স্টেডি-স্টেট ইউনিভার্সের ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে যেতে শুরু করেছে। জামাল নজরুল ইসলাম এবার তাঁর গবেষণায় সরাসরি নক্ষত্রের দিকে মনযোগ দিলেন।

নক্ষত্রের গঠন সংক্রান্ত গবেষণাপত্র পড়তে শুরু করলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের  ‘Introduction to the study of stellar structure’ বইটি শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। নক্ষত্রের গঠন সম্পর্কে জানার জন্য এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য বই সেসময় আর ছিল না। জামাল নজরুল ইসলাম এই বই পড়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের পদার্থবিজ্ঞান – কসমোলজির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন।

১৯৬৯ সালের মে মাসের মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম শেষ করলেন তাঁর ‘’Some general relativistic inequalities for a star in hydrostatic equilibrium” গবেষণাপত্রের প্রথম খন্ড। প্রফেসর ফ্রেড হয়েল তা পাঠিয়ে দিলেন রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে। ১৯৬৯ সালে সোসাইটির মান্থলি নোটিশে তা প্রকাশিত হলো [Monthly notices of the Royal Astronomical Society, Volume 145, Number 1, pages: 21-29, July 1969.] । ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করলেন এই গবেষণার দ্বিতীয় খন্ড। জয়ন্ত নারলিকারের মাধ্যমে সেটা প্রকাশিত হলো ১৯৭০ সালে [Monthly notices of the Royal Astronomical Society, Volume 147, Number 4, pages: 377-386, April 1970.] । নক্ষত্রগুলির অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাপ এবং বাইরের মহাকর্ষ বলের চাপের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির যেসব গাণিতিক চলক বিভিন্ন ধরনের শর্ত মেনে চলে – সেগুলিকে সহজীকরণ করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম এই দুটো গবেষণাপত্রে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র-সমীকরণ সমাধানে তাঁর এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) যোগ দেন ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট হিসেবে। এক বছর ছিলেন তিনি সেখানে। তখন তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর কিপ থর্ন। বিশ্ববিখ্যাত এই ইন্সটিটিউটে তখন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় জামাল নজরুল ইসলামের।

১৯৭২ সালে জামাল নজরুল ইসলাম ক্যালটেক থেকে শিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রোনমির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর জর্জ ওয়ালেরস্টেইন এবং ফিলিপ কার্ল পিটারস। প্রফেসর ওয়ালেরস্টেইন নক্ষত্রের গঠন ও তাদের রাসায়নিক বিবর্তনের নিউক্লিওসিন্থেসিস নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেই সময়। আর প্রফেসর পিটারস কাজ করছিলেন উইক ফিল্ড গ্রাভিটেশনাল স্ক্যাটারিং সম্পর্কে। তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে জামাল নজরুল ইসলাম কসমোলজির বিভিন্ন বিষয় শিখেছেন যা তাঁর গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে।

ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কয়েক মাসের জন্য প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গেলেন জামাল নজরুল ইসলাম। সেখানে সেবার তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয় গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের সাথে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের নক্ষত্রের হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি পড়ে ফ্রিম্যান ডাইসন জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার প্রতি খুবই আগ্রহী এবং শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে তৈরি হয় খুবই সম্মানজনক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

১৯৭৩ সালে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের লেকচারার পদে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি কসমোলজিতে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রায়োগিক দিকের ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা করেন।

১৯৭৫ সালে জামাল নজরুল ইসলাম যোগ দেন কার্ডিফের ইউনিভার্সিটি কলেজের (বর্তমানে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি) অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্‌স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে। ডিপার্টমেন্টে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন শ্রীলংকান বংশদ্ভূত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নলিন চন্দ্র বিক্রমসিঙ্গে এবং লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী বারনার্ড সুৎজ। কার্ডিফে জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা-সহযোগী ছিলেন বার্নার্ড শুৎজ। তাঁরা একসাথে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছেন।

১৯৭৮ পর্যন্ত কার্ডিফ কলেজে ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এই সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় জেনারেল থিওরি অব রিলেটভিটির আইনস্টাইনের সমীকরণের সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তাঁর নয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বিষয়ে, বিশেষ করে আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সমাধান বিষয়ে।

মহাবিশ্বের স্থান-কালের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় মহাকর্ষ বলের দ্বারা। এর সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব হলো আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি যা মহাকর্ষ বলের ফিল্ড ইকুয়েশান দ্বারা প্রকাশ করা যায়। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বস্তু ও শক্তিগুলির মধ্যে যে অবিরাম জটিল মিথষ্ক্রিয়া চলছে তা ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীকরণ হলো ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ যেগুলি তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব রিপ্রেজেন্ট করে। মহাবিশ্বের গণিত বুঝতে হলে এই দুটোর কোনোটা ছাড়াই চলবে না। আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। জামাল নজরুল ইসলাম আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের বিভিন্ন অবস্থার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন তাঁর অনেকগুলি গবেষণাপত্রে।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হলো আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ সমাধানে তাঁর গবেষণাপত্র ‘A class of approximate stationary solutions of the Einstein-Maxwell equations’ [General Relativity and Gravitation, Volume 7, Number 8, pages: 669-680, January 1976.] ।

আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশানের ঘূর্ণায়মান অবস্থার সমাধান তখনো পাওয়া যায়নি। জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে আইন্সটাইনের সেইসব সমীকরণের সমাধান প্রকাশ করলেন তাঁর ‘A class of approximate exterior rotating solutions of Einstein’s equations’  গবেষণাপত্রে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 79, Number 1, pages: 161-166, January 1976.]। 

এর কয়েক মাস পরেই প্রকাশিত হলো আইনস্টাইনের সমীকরণের সার্বিক ঘূর্ণনের সমাধান সমৃদ্ধ গবেষণাপত্র ‘On the existence of a general rotating solution of Einstein’s equations’ [General Relativity and Gravitation, Volume 7, Number 10, pages: 809-815, 1976.] ।

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির স্ট্যাটিক ফিল্ড ইকুয়েশানের সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালের দুটো গবেষণাপত্রে। স্ট্যাটিক ফিল্ড সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। শুধু তাই নয়, স্ট্যাটিক ফিল্ডে কোন ঘূর্ণন থাকে না, অর্থাৎ স্পেস-টাইমে কোন ভাঁজ পড়ে না। সেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্র সময়ের অপেক্ষক নয়। আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ডকে স্ট্যাটিক ফিল্ড ধরে তার জেনারেল রিলেটিভিস্টিক সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘On the static field in general relativity’ গবেষণাপত্রে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 81, pages: 485-496, 1977.]। পরের বছর প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার দ্বিতীয় খন্ড [On the static field in general relativity: II, Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 83, Number 2, pages: 299-306, March 1978.] যেখানে স্ট্যাটিক ফিল্ড তথা ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশানের সমাধান করা হয়েছে আগের চেয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে।

সেই সময় (১৯৭৭-৭৮) জামাল নজরুল ইসলামের মতো আর কেউই এত বিস্তারিত এবং বহুমাত্রিক গণিতের মাধ্যমে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি তত্ত্বের সমাধান করেননি। স্টিফেন হকিং এব্যাপারে নিজে আগ্রহী হয়ে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলেন তাঁর পেপারগুলি রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করার জন্য।

জামাল নজরুল ইসলামের পরবর্তী গবেষণাপত্র “A Class of Exact Interior Solutions of the Einstein-Maxwell Equations” রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশের জন্য পাঠালেন স্টিফেন হকিং [Proceedings of the Royal Society of London. Series A, Mathematical and Physical Sciences, Volume 353, Number 1675, pages: 523-531, April 21, 1977. Communicated by S. W. Hawking, F. R. S.]

১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। এই সময়ে তিনি কসমোলজি এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র রচনা করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে তাঁর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণাপত্রগুলির মধ্যে আছে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতির গাণিতিক রূপরেখা, আদিপৃথিবীর ব্ল্যাকহোলগুলির বর্তমান অবস্থান কী হতে পারে, চার্জিত কণার উপর জেনারেল রিলেটিভি থিওরির সমীকরণ এবং তাদের সম্ভাব্য সমাধান।

১৯৭৭ সালে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নালে একটি ছোট্ট টেকনিক্যাল পেপার – ‘পসিবল আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স প্রকাশ করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এরপর নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার প্রমুখ বিজ্ঞানী তাঁকে অনুরোধ করলেন এই টেকনিক্যাল পেপারের একটি জনপ্রিয় ভার্সান রচনা করতে – যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে। এর আগে এরকম বিষয়ে হাতেগোণা কয়েকটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। স্টিভেন ওয়াইনবার্গের ‘ফার্স্ট থ্রি মিনিটস প্রকাশিত হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। জামালস্যার সবার অনুরোধে রচনা করলেন ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স

১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এই বই প্রকাশিত হবার পর মহাবিশ্বের ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরে জামাল নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করে এরকম বই আরো অনেকে লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর আইডিয়া  ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স থেকে উৎসৃত। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর জনপ্রিয় বই – ‘দি লাস্ট থ্রি মিনিটস – যা জামাল নজরুল ইসলামের বইটির পরের অধ্যায় বলা চলে। পল ডেভিস তাঁর বইয়ের সাব-টাইটেলে উল্লেখ করেছেন ‘কনজেকসার্স অ্যাবাউট দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’।

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণায়মান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেছেন তাঁর আরেকটি মাইলফলক গবেষণা-গ্রন্থ ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি মূলত গবেষক এবং শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য লেখা। এই গবেষণার জন্য কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জামাল নজরুল ইসলামকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেয়।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানুষের কৌতূহল মিটায়, হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা তৈরি করে। কিন্তু সত্যিকারের বিজ্ঞান-শিক্ষার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ। জামাল নজরুল ইসলাম ‘আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স-এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণিত ব্যবহার না করে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত। মহাবিশ্বের উৎস, গঠন, বিবর্তন এবং পরিণতির গণিত বুঝতে হলে একটা নির্ভরযোগ্য বইয়ের দরকার ছিল। সেই দরকার মিটিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি রচনা করেছেন ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’। ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হবার পর থেকে পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইটি প্রধান বইতে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এর অনলাইন সংস্করণ।

দেশের টানে দেশে ফিরে এসে তিনি স্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে শতাধিক গবেষক তৈরি হয়েছে। কর্মজীবনের শেষের দিকে তিনি গাণিতিক অর্থনীতির গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সঠিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারবে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ – এই পাঁচ বছরে তিনি গাণিতিক অর্থনীতি বিষয়ে ২০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।

 

তথ্যসূত্র

১। জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র ও গ্রন্থাবলি [তালিকা দেখুন: এই লেখকের সপ্তর্ষি, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২৪, পৃষ্ঠা ২১৬-২২৩]

২। ফ্রিম্যান ডাইসন, টাইম উইথআউট এন্ড:  ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োলজি ইন অ্যান ওপেন ইউনিভার্স, রিভিউ অব মডার্ন ফিজিক্স, বর্ষ ৫১, নম্বর ৩, ১৯৭৯।

৩। পল ডেভিস, দ্য লাস্ট থ্রি মিনিটস, বেসিক বুক্‌স, লন্ডন, ১৯৯৭।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত










No comments:

Post a Comment

Latest Post

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধানে

  বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণা...

Popular Posts