৯
সমানে দাওয়াত খেয়ে যাচ্ছি।
প্রত্যেক উইকএন্ডে শুক্রবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত কারো না কারো বাসায়
দাওয়াত। আর সেসব দাওয়াতে এলাহি কান্ড। বুয়েট থেকে পাস করা প্রায় সমবয়সী
সিনিয়র-জুনিয়র একদল ছেলে-মেয়ে পরস্পর পরিচিত হয়ে এখানে একটা অ্যাসোসিয়েশানের মত
হয়ে গেছে। এছাড়াও আছেন ডাক্তার, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। সমবয়সী সমমনা এসব
ছেলেমেয়েদের আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব পরস্পরকে আত্মীয়ের চাইতে আপন করে তুলেছে। আর এটা
তো সত্যি এই দূর বিদেশে আপনজন ছেড়ে আসা ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার
সম্পর্ক গড়ে না তুললে বাঁচবে কীভাবে! তাই সপ্তাহের পাঁচ দিন কাজ করার পর এরা
পরস্পরের বাসায় যায় অথবা আবহাওয়া ভাল থাকলে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে।
তবে খাঁটি অজি বা অন্যান্য
অভিবাসীদের সঙ্গে একমাত্র অফিসিয়াল যোগাযোগ ছাড়া এদের পারিবারিক বা সামাজিক
যোগাযোগ তেমন দেখলাম না। এর মূল কারণ সম্ভবত সাংস্কৃতিক দূরত্ব। কিন্তু স্কুলে
বাচ্চারা খুব সহজে অজি, ইন্ডিয়ান, তুর্কি, নাইজেরিয়ান সবার সাথেই মিশছে এবং বন্ধুত্ব
হচ্ছে। ভবিষ্যতে যখন এরা এই দেশকে নিজের দেশ ভাববে তখন তারা সবার সাথেই মিশবে।
আমাদের সন্তানেরা যারা
প্রবাসে স্থায়ী হয়েছে তারা কিন্তু নিজেদের ভূখন্ড, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস
সবকিছু সাথে নিয়ে গেছে এবং সেগুলোকে জীবন-যাপনে মন-মননে সযত্নে লালন করছে। কিন্তু
পরবর্তী প্রজন্ম অভিবাসী দেশকেই নিজের দেশ ভাববে আর তৃতীয় প্রজন্মতো মিশেই যাবে।
শুধু গায়ের বাদামি অথবা শ্যামলা রঙের উত্তরাধিকার বহন করে নিজেদের
স্বাতন্ত্র্যটুকু হয়তো বজায় রাখবে।
*****
১০
এত আনন্দের মাঝেও দেশের খবরের
জন্য উদ্গ্রীব থাকি। কিন্তু টেলিভিশনে
বাংলাদেশের খবর শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজ শুনলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থপাচারের ঘটনা। আমেরিকায় যে রাখা হয়েছে সেটার সুইফ্ট কোড ভেঙে ম্যানিলাভিত্তিক কিছু দুর্বৃত্ত আট লাখ ডলারেরও বেশি
টাকা চুরি করেছে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ড. আতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রী সমীপে স্বেচ্ছা-পদত্যাগপত্র
দাখিল করেছেন। ব্যাংকের প্রধান হিসেবে হয়তো এ দায় কিছুটা তাঁর ওপর বর্তায়। কিন্তু
দুঃখ হলো, যে মানুষটা তাঁর সততা, দক্ষতা দিয়ে ব্যাংকের অনেক বিশৃঙ্খলা দূর করেছেন,
রিজার্ভ বৃদ্ধি করেছেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ এদেশের কৃষিজীবী মানুষের জন্য
মাত্র দশ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছেন, সিস্টেমের ভুলে অথবা
অসাধু আন্তর্জাতিক চক্র কিংবা কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারণে আজ তাঁকে ভুলের দায়
কাঁধে নিয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগল অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য
শুনে। আমাদের অর্থমন্ত্রীর এই এক দোষ। হুট করে মন্তব্য করেন, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে
সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনাও করেন।
এখানেও সবার মাঝে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, নানারকম হাইপোথিসিস
হচ্ছে। কিন্তু আমার মনটা ড. আতিউর
রহমানের জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মন কেবলই বলছে এটা ওনার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য
নয়। জানি মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়, তবুও কোন কোন মানুষ তাঁদের কাজ দিয়ে যে
ইমেজ তৈরি করেন তাতে আঁচড় পড়লে আমাদের মত সাধারণ মানুষ বড় কষ্ট পায়। আজ আমিও তেমন
কষ্টের শিকার।
*****
১১
এর মাঝেই ইস্টারের ছুটি পড়ল। এই ছুটিতে আমরা সপরিবারে যাব প্রদীপের বাসায় এবং সেখান থেকে শহর দেখতে। আমার নাতনী পূর্বার খুব প্রিয় তার প্রদীপ ভাইয়ার
বাসা। প্রদীপের বইঠাসা লাইব্রেরি, পড়ার টেবিল, কম্পিউটার
এসব নিয়ে অফিস অফিস খেলা তার খুউব পছন্দ।
প্রদীপ আগে থেকেই সুগৃহিনীর মত রান্না-বান্না করে ঘরবাড়ি
পরিপাটি করে রেখেছে। আগের বার আমরা দুজন এসেছিলাম। এবার নাতি-নাতনী আছে। সুতরাং
তাদের সব প্রিয় খাবারের বন্দোবস্তও করা হয়েছে। রাতে অনেকক্ষণ আড্ডা চলল।
হৈ-হুল্লোড, হাসি-ঠাট্টা – অবশেষে ঘুমাতে যাওয়া।
সকালে উঠতেই তার দুলাভাই বলল, “প্রদীপ, কাল রাতে তোর জানালা দিয়ে হাওয়া আসছিল। আর সে
হাওয়ায় যেন কার ফিসফিসানি শুনলাম”।
আমি বললাম, “প্রদীপ যখন আদম তখন হাওয়াইতো আসবে”। আবার হাসির হর্রা।
তার ব্যাকইয়ার্ডে এবার প্রচুর লাউ ফলেছে। তার সাথে ফলেছে
বাটারনাট পাম্পকিন। এ কুমড়োর আকৃতি ঠিক আমাদের দেশের কুমড়োর মত নয়, অজিদের মত।
প্রচুর লাউ সে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের বিলিয়েছে। রাকার জন্যেও নিয়ে গেছে। তার
বাসায় আসার আগে আমি বলেছি, “আর যাই খাই লাউ নয়”। অতএব উঠোনে লাউডগা ফলসম্ভারে নত হলেও সে লাউ ঘরে এল না। এ প্রসঙ্গে সে বললো,
পাশের বাসার শ্রীলঙ্কান প্রতিবেশীকে পর পর দুটো লাউ দেবার পর সে এখন তাকে দেখলেই
সটকে পড়ে কী জানি কখন আবার লাউ ধরিয়ে দেয়! এখানে এত খাওয়ার মানুষ কই? আর ওরাতো
আমাদের মত লাউ দিয়ে ডুগডুগিও বানাতে জানে না। আহারে সাধের লাউ। আর বাটার নাট কুমড়া
নামে যতই মাখনযুক্ত থাক তা এককোপে কাটতে জল্লাদেও পারবে না – এত শক্ত।
খাওয়ার পর দুপুর থাকতেই আমরা সিটির দিকে রওনা দিলাম। এই প্রথম
মেট্রোরেলে চড়লাম। দুপাশে কখনও সাবার্ব আবার কখনও গাছপালা, ঝোপঝাড়, পার্ক, স্টেশন
দেখতে দেখতে শহরে পৌঁছালাম।
মেলবোর্ন সিটি গড়ে উঠেছে ইয়ারা নামের নদীর দুই তীরে।
রোমাঞ্চিত হলাম এই সেই ইয়ারা যাকে নিয়ে প্রদীপ তার এদেশে প্রথম আসার সংগ্রাম আর
স্মৃতি নিয়ে লিখেছে ‘ইয়ারার
তীরে মেলবোর্ন’। ইয়ারা খুব বড় নদী নয়।
আমাদের দেশে এখনও এরকম নদী বাঁশের সাঁকো দিয়ে পাড়ি দেওয়া হয়। আমার শৈশবের নদীটিও
শীতকালে প্রায় এরকম থাকতো। যদিও ভরা বর্ষায় সে দুকূলপ্লাবী ভিন্নরূপ ধারণ করতো,
আমরা বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার করতাম। একবার নতুনদার মতো আমাদের এক ফুপাতো ভাই টাই
স্যুট বুট নিয়ে সাঁকো পার হতে গিয়ে ঝপাং করে পানিতে পড়ে গিয়ে আমাদের সবার হাসির
খোরাক জুগিয়েছিল।
‘আমাদের
ছোট নদী’র মতো ইয়ারাও বাঁকে বাঁকে চলেছে আর অনেকগুলো
সেতু তাকে পাকে পাকে বেঁধেছে। একটা সেতু দিয়ে আমরা সাউথব্যাঙ্কে অর্থাৎ দক্ষিণ
তীরের দিকে যাত্রা করলাম। ইস্টারের ছুটি তাই অনেক মানুষ। সবাই আনন্দে উৎফুল্ল।
সেতুতে পায়দলে চলা, কোন শকট বা বাহন এখানে চলে না। দলে দলে মানুষ হেঁটে চলেছে।
আবার মোড়ে মোড়ে কিছু মানুষ জোকার সেজে মানুষকে আনন্দ দেয়ার নামে পয়সা কামাচ্ছে।
কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে যাচ্ছে একমনে। যার ইচ্ছে হচ্ছে সে তার বিছানো রুমালে কয়েন
দিচ্ছে।
সাউথব্যাঙ্কে পা রাখা বলতে যা
বোঝায় তা সাউথব্যাঙ্কে এসেও করা গেল না। আমি তো পা রাখিনি, সারাক্ষণই চাকায় চড়ে
চলেছি। প্রদীপ আমার কন্যার চাইতেও এককাঠি সরেস। সে এক মুহূর্তও ভুলতে পারে না যে
আমার মেরুদণ্ডে দুবার পি-এল-আই-ডি অপারেশন হয়েছে। সুতরাং এবার রথের চাকা ঠেলার
দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় কাঁধে – না ভুল হল – হাতে তুলে নিয়েছে।
আহ্ কী শান্তি। কিসের
শান্তি? মানুষ দেখার। ইস্টারের ছুটিতে প্রচুর মানুষ শহরে এসেছে। আমার যে কী আনন্দ
হচ্ছে। যে দিকে তাকাই শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সী মানুষ। খোলা পাবগুলোতে মদের গ্লাস
হাতে তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই ধুমসে সোমরস পান করছে। নারীদের অনেকের দৃষ্টি
মদালসা, কপোল আপেল-লাল। রাস্তায় জনস্রোত। এরই মাঝে কেউ ছবি আঁকছে, কেউ ম্যাজিক
দেখাচ্ছে, কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। তামাশা আর তামাশা। যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে যাও, ইচ্ছে
হলে দ্যাখো, মন চাইলে কিছু দাও অথবা চলে যাও কোন অনুযোগ নেই। ব্যান্ডের গান বাজছে।
উচ্চগ্রামের বাদ্যযন্ত্রের সুর কানে লাগছে। সব মিলিয়ে উৎসবের আমেজ, উৎসবের রঙ।
তরুণীদের নজরকাড়া সাজসজ্জা
চোখে ঘোর লাগায়। সাদা-কালো-বাদামী সবাই সেজেগুজে পথে নেমেছে। ইয়ারার তীরে বসার
জন্য সারি সারি বেঞ্চ দেয়া আছে। পার্ক আছে। বড়রা সেখানে বসছে। শিশুরা কেউ পার্কে,
কেউ ঘাসে খেলায় মেতেছে। প্রবীণাদের ঠোঁটে এবং পোশাকে কড়া রঙ। বৃদ্ধা বললাম না,
কারণ নারীরা নাকি বৃদ্ধা সম্বোধনে মনে কষ্ট পায়। আমি নিজেও তেষট্টি বছরে দৌড়ানো
বৃদ্ধা, তবু নিজেকে বৃদ্ধা বিশেষণে বিশেষায়িত করতে মন সায় দেয় না। প্রবীণ ভাবতেই
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
শখের ভিক্ষুকও দেখলাম দু-একজন। যারা শতছিন্ন পোশাক পরে
আলসভাবে শুয়ে বসে আছে। পাশে প্লাকার্ডে লেখা – আমি গৃহহীন, আমাকে সাহায্য করো। এদেশে সরকার বেকারদের ভাতা
দেয় – যার নাম ‘ডোল’। সুতরাং কেউ গৃহহীন থাকার কথা নয়। মনে হল এরা স্বভাবেই
ভিক্ষুক।
ইয়ারার বুকের ঘোলা পানিতে শ্বেত কপোতের মত প্রমোদতরী ভাসছে।
ট্যুরিস্টরা সেই তরীতে প্রমোদবিহারে যায়। কিন্তু এখানেও সেই ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’। আমরা এসেছি বিনি পয়সার ভোজ খেতে, তাই দূর থেকে ওগুলোর
আসা-যাওয়া দেখলাম।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা দেখলাম ইউরেকা টাওয়ার। আটাশি তলা এ ভবনটি
এখনো পর্যন্ত মেলবোর্নের স্কাই-স্ক্র্যাপার। বেশি উপরের দিকে তাকাতে গেলে টুপি পড়ে
যাওয়ার অবস্থা।
ইউরেকার পর গেলাম মেলবোর্নের ক্যাসিনো দেখতে। ক্রাউন
ক্যাসিনো। জুয়াড়ি না হয়েও প্রতিদিন বহু মানুষ এই সুন্দর ভবনটি দেখতে আসে। ভবনের
সৌকর্যের সাথে সাথে লাইটিং বা আলোর খেলাও মনোহরণকর। ইন্টেরিয়র ডিজাইনও যতটুকু
দেখলাম তাতে মানুষের সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হলাম।
রাত হয়ে আসছে। এবার ফিরতে হবে। মানুষ দেখার আনন্দে সপ্রাণ, সতেজ হয়ে আবার রেলে চড়ে ডেরায় ফেরা। সাউথ মোরাং স্টেশনে নামার সময় দেখলাম এক বেহেড মাতাল ট্রেনের মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। কয়েকজন টেনেও তাকে তুলতে পারছে না। এরকম আরো কয়েকজনকে দেখলাম। সবাই তরুণ। ছুটির দিনে এখানে এরকম দৃশ্য নাকি অতিসাধারণ।
*****
১২
আজ আমরা যাচ্ছি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি
দেখতে। পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
মধ্যে মেলবোর্ন অন্যতম। দেড়শতাব্দীরও
বেশি সময় ধরে এই শিক্ষাঙ্গন জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত। প্রদীপ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছে প্রফেসর কেন অ্যামোসের
তত্ত্বাবধানে। ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে গড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি
এর বিশাল আয়তন, ভবন এবং পরিকল্পিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও
মনোমুগ্ধকর।
আমরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ভবন
দেখলাম। এক জায়গায় শিশুসহ একটি বিশাল নারীমূর্তির
ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। সম্পূর্ণ কালো পাথর কুঁদে তৈরি করা এই মূর্তিটির সৌন্দর্য অনেকক্ষণ দেখেও মন ভরল
না। মনে হল আরো দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ছুটির দিনে লুকোচুরি
খেলার মত খেলায় মেতেছে। তাদের কেউ
মুখোশ পরা, কারো মুখে রঙ, কারো পোশাক ভাইকিং বা ড্রাকুলার মত।
তবে লক্ষণীয় অধিকাংশই চীনে
ম্যান। ছেলেমেয়ে প্রায় সবার চেহারায় চৈনিক
ছাপ স্পষ্ট। প্রদীপ বলল, অস্ট্রেলিয়াতে চীনের প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে আসে। এখন চীন বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। কিন্তু দেশে টাকা খরচ করার সুযোগ কম, তাই এরা এখানে আসে। তবে লেখাপড়া তারা ঠিকই করে। আমাদের দেশেও এখন ধনী পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের অনেকের পুত্রকন্যারা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমায়। আর মেধাবী স্বল্প সংখ্যক বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করতে
আসে।
ছুটির দিন। তাই ফিজিক্স
বিল্ডিং-এর নিচে দাঁড়িয়ে ছয় তলায় প্রদীপের বসার রুমের জানালা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে
হল। স্টুডেন্টদের ইউনিয়ন হল দেখলাম। এখানে বিভিন্ন রকমের নোটিশ থাকে নবাগতদের
জন্য। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে কুকুর পালনের চাকরি – সব বিজ্ঞাপনই আছে। এরকম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে
প্রদীপেরও ভয়ঙ্কর এবং হাস্যকর (রক্ষা পেয়েছে বলে) অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে ‘ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন’ বইটিতে।
মেলবোর্ন সিটির রাস্তাগুলো পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে সরল
রেখায় টানা। দুপাশে রেস্তোরাঁ, বড় বড় দোকান – ব্র্যান্ডশপ যাকে বলে, পানশালা এসবই দৃশ্যমান। চওড়া
ফুটপাতেও ট্রাম-বাসের জন্য অপেক্ষমান পথিকের বসার ব্যবস্থা আছে। শহরের মূল সড়কে
ব্যক্তিগত গাড়ি তেমন চোখে পড়ে না। সবাই নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিংলটে গাড়ি পার্ক
করে ট্রামে-বাসে শহরে ঘুরে বেড়ায়। এক পাঞ্চ কার্ডেই ট্রেন-ট্রাম-বাস সবকিছুতে চড়া
যায়। চলাচলের সহজ পদ্ধতি। হাসিখুশি
উচ্ছল শিশু-তরুণ বয়সী মানুষ দেখে আমার প্রাণ ভরে গেল।
*****
১৩
রাকাদের বাসায় ফিরে আবার দাওয়াতের
পালা শুরু। পূর্বা-দিব্যর স্কুল খোলা। ওরা বাসায়
না থাকলে টিভি দেখা, বইপড়া আর মা-মেয়েতে গল্প চলে। মাঝে মাঝে শপিং-এ যাওয়া হয়। সংসারের এটা-ওটা লাগে। আমার নিজেরও টুকটাক কেনাকাটা। বেশিরভাগই স্যুভেনির। দোকানপাটগুলো কেমন নির্জন লাগে। সবাই ঘুরছে-ফিরছে, কেনাকাটা করছে, কিন্তু কোন
হৈ চৈ নেই। বিশাল মার্কেট। সেখানেও মাঝে মাঝে বসার ব্যবস্থা। শিশুদের খেলার জন্য নানারকম ব্যবস্থা আর এসবের
জন্য কোন কড়ি গুণতে হয় না। বাবা-মায়ের কেনাকাটার সময় তারা খেলাধুলা করে। এখানে পার্কিং-এর ব্যবস্থা বেসমেন্ট থেকে দোতলা তিনতলা পর্যন্ত, কিন্তু মার্কেট এক তলা। আলো সাশ্রয়ের জন্য ছাদগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যাতে প্রাকৃতিক আলো কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ
খরচের সাশ্রয় হয়।
মার্কেটে সমানে কেনাকাটা করছে সাদা-কালো-বাদামী সবরকমের
মানুষ। রাকা বলল, বিশেষ করে আফ্রিকান ইমিগ্র্যান্টরা ‘ডোল’ খায় আর ঘুরে বেড়ায়। ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহ স্বীকৃত বলে নাইজেরিয়া বা আফ্রিকার
অন্যান্য দেশ থেকে আসা অনেকে দুতিনটি করে স্ত্রী নিয়েও বসবাস করে। প্রচুর
বাচ্চা-কাচ্চা। অস্ট্রেলিয় আইন এক্ষেত্রে অচল। এরা তাই দু-তিনটে গাড়ি নিয়ে একাধিক
স্ত্রী ও একদঙ্গল বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সরকারি ভাতায় মৌজফূর্তি করে। শুনে এবং
এখানকার কসমোপলিটান চেহারা দেখে মনে হল ভাগ্যদোষে নিজ দেশ থেকে এলেও এখানে এরা
ভাগ্যবান। কারণ গৃহযুদ্ধের কারণে এদের অনেকেই স্বদেশচ্যুত। এরকম আছে
শ্রীলঙ্কানরাও।
দোকানীদের মধ্যে এশিয়ান – ভারতীয় ও চায়নিজদের সংখ্যা বেশি। ইদানীং বাঙালি ব্যবসায়ীর
সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশের কচুর লতি থেকে রাঁধুনীর মশলা, চাষী চিনিগুঁড়া চাল
সবই বাংলাদেশি দোকানে সহজলভ্য।
দাওয়াত খেতে গেলে একটা বিষয় খুব মনে লাগে। কষ্ট হয়, কারণ এসব
পাকা রাঁধুনী মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত এবং কেউ কেউ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। আমার নিজের
মেয়েও বুয়েট থেকে ট্রিপল-ই ইঞ্জিনিয়ার। এরা সংসার করছে নিপুণভাবে কিন্তু চাকরি
করতে পারছে না। অধিকাংশেরই একটা কারণ – শিশুসন্তানের দেখাশোনা করার আত্মীয়পরিজনের অভাব। অনেকেরই শিশুজন্মদানের সময়
দেশ থেকে মা অথবা শাশুড়ি আসেন। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য। শিশু একটু বড় হলে
ডে-কেয়ার থাকলেও ভাল ডে-কেয়ারের খরচ বেশি। আবার সেখানেও হ্যাপা কম নয়। গায়ের রঙের
একটা বিষয়তো থাকেই। অজি শিশুরা যত যত্ন পায়, অনেক সময় কালো বা বাদামীরা ততোটা পায়
না। বাচ্চা অসুস্থ হলে তার প্রেসক্রিপশন থাকা সত্ত্বেও ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়
না।
আমার নাতি দিব্য কিছুটা
দুর্বল স্বাস্থ্যের এবং জ্বরজাড়ি লেগেই থাকে। চাকরিকালীন সময়ে তাকে ওষুধ খাওয়ানোর
জন্য মাঝে মাঝে তার মাকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হত। চাকরির ক্ষেত্রে এ সুযোগ আর
ক’দিন পাওয়া যায়। সুতরাং চাকরি ছাড়তে হল।
আমাদেরও কথা – আগে তোমার বাচ্চা, তারপর ক্যারিয়ার।
কিন্তু সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে বুয়েট পর্যন্ত যে মেয়েটি মেধা,
শ্রম, অধ্যবসায়ে প্রকৌশলী হলো তার তো এসবে কিছুটা হতাশা আসবেই। আবার এটাও চরম
সত্যি যে সন্তানের জন্য সারাপৃথিবীতে তো মায়েদের এভাবেই নিজের স্বপ্ন আকাঙ্খা
বিসর্জন দিতে হয়।
অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু
মেয়ে আবার লড়াকু মনোভাবের। এরা খুব দৃঢ়চেতা বলে অনেক সমস্যা নিয়েও কাজ করে। আবার
এক্ষেত্রে তার জীবনসঙ্গীর সাপোর্টও একটি বড় ফ্যাক্টর। তবে আমি যাদের দেখেছি তাদের
হাজব্যান্ডরা সমর্থন দিলেও পরিবেশ পরিস্থিতিও অনুকূলে নেই।
বাংলাদেশি মেয়েদের কেউ কেউ অবশ্য বেবিসিটিং-এর ট্রেনিং নিয়ে
চাকরীজীবী মায়েদের দু-একটি করে শিশুর তত্ত্বাবধান করে। বেশি করারও উপায় নেই। কারণ
এসব কাজে সহযোগী লাগে, সেজন্য যে কড়ি গুণতে হয় আর ঝামেলা পোহাতে হয় তাতে আরো দশটা
ফ্যাকড়া লাগে। কেবল সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ডে-কেয়ারেই বেশি শিশু একসাথে থাকতে পারে।
সমস্যা হয় যখন শিশুরা অসুস্থ হয়। সংক্রমণের ভয়ে তখন তাদের
ডে-কেয়ারে অ্যালাউ করা হয় না। তখন মা-বাবার উপায় কী? এসব কারণে অনেক মা-ই চাকরি
করতে পারেন না। বিশেষত বাঙালি তথা এশিয়ান মায়েরা। কারণ প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশের
মায়েরা অধিক সন্তানবৎসল। তাই সবার আগে বাচ্চাই তাদের কাছে টপ প্রায়োরিটি।
আবার নবজাতকের ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মের আগে থেকে মা-কে যেমন
কাউন্সেলিং করা হয়, তেমনি মাঝে মাঝে আকস্মিক পরিদর্শনে স্বাস্থ্যসেবার লোকজন এসে
দেখে যায় বাচ্চাকে আলাদা কট্-এ রাখা হয় কি না। কারণ তারা চায় একটি শিশু তার
ইনফ্যান্ট অবস্থা থেকেই স্বনির্ভর হবে। পরনির্ভরতাকে তারা ঘৃণা করে। এমনকি ন’দশ মাস থেকে বাচ্চাকে তারা অন্য বাচ্চাদের সাথে একসাথে বসে
চামচে করে নিজে নিজে খাওয়ার অভ্যাস করায়। এমনও শুনলাম, একবার একটি বাচ্চাকে
কেয়ারটেকার খেতে সাহায্য করেছিল বলে সেই মহিলার চাকরি চলে যায়।
কিন্তু বাঙালি মায়ের প্রাণ বলে কথা। আপন সন্তানকে বুকের ওম না
দিয়ে নিজেই কি থাকতে পারবে? তাও বাঙালিবাসায় শিশু মায়ের বুকে ঘুমালেও
পরিদর্শনকারীদের জন্য বেবিকটও রাখা হয়।
আমার বন্ধু কাজল তার মেয়ের
ঘরের নাতিকে লালন-পালন করতে গিয়ে দেশে ফিরে আসার সময় নিজেই ভীষণ ভেঙে পড়েছিল।
বাচ্চাটির দশাও তথৈবচ – কারণ সে
তো নানীকেই মায়ের মত পেয়েছিল।
আসলে যে কোন বিষয়েরই ভাল-মন্দ
দুদিক আছে। ওদের সিস্টেমে বাচ্চা স্বনির্ভর হয় ঠিকই, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর
মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে পিছন ফিরে তাকায় না, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না। প্রদীপ একবার
একটা ঘটনা বলেছিল, অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রে (সম্ভবত) সংবাদটা এসেছিল। একজন অশীতিপর
ধনী বৃদ্ধ প্রাসাদোপম একটি বাড়িতে একা থাকতেন। খাবার আনতে দোকানে যাওয়ার মত
সামর্থ্যও তার ছিল না। এটা দেখে এক প্রতিবেশি তার দুধ, পাউরুটি ইত্যাদি প্রয়োজনীয়
খাবার দরজার সামনে রেখে যেত। সেই বৃদ্ধও ডলার দরজার সামনে রেখে দিত। তো সেই
বৃদ্ধের মৃত্যুর পর কারো কোন খবর নেই। দরজার সামনে জিনিস পড়ে থাকতে দেখে সেই
প্রতিবেশিই পুলিশে খবর দিল। পরবর্তীতে যখন জানা গেল বৃদ্ধ তার সমস্ত সম্পত্তির
উত্তরাধিকারী করে গেছেন সেই প্রতিবেশিকে – তখন? তার সন্তানদের টনক নড়ল। আইন আদালততো আছেই। ‘বিষয় তো বিষ’ – তা তো প্রবাদ হিসেবে এমনি এমনি উক্ত হয়নি।
আসলে সবকিছুর ভাল-মন্দ দুদিক আছে। যুগ এবং সময়ের দাবিতে আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থা যৌথপরিবার ভেঙে অণুপরিবারের দিকে যাত্রা করলেও এখনও বেশিরভাগ পরিবারই বয়োজ্যেষ্ঠ বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধান করে থাকে। আর এর কারণ সম্ভবত আশৈশব স্নেহ-ভালবাসার বন্ধন।
*****
No comments:
Post a Comment