২১
আজ আমরা যাবো মেলবোর্ন স্টেট লাইব্রেরি, আর-এম-আই-টি’র সিটি ক্যাম্পাস, মেলবোর্ন সেন্ট্রাল – যেটি একটি শপিং মল আর আন্ডারগ্রাউন্ডে ট্রেন স্টেশন।
গাড়ি পার্কিং লটে রেখে আমরা প্রথমেই গেলাম স্টেট লাইব্রেরিতে।
স্থাপত্যের দিক থেকে নান্দনিক এ ভবনটির উপরে বিশাল ডোম। এই ডোম এমনভাবে তৈরি যে
দিনের বেলা ভিতরে আলোর দরকার হয় না। তবে প্রত্যেক পড়ুয়ার টেবিলে ছোট টেবিল ল্যাম্প
আছে, যতক্ষণ সে পড়ছে ততক্ষণ জ্বলছে। যাবার সময় নিবিয়ে যাবে। এখানে কেউ আইন অমান্য
করে না।
নিরবতা লাইব্রেরি বা পাঠকক্ষের সবচেয়ে বড় শর্ত। এখানে সেটাই
একশ শতাংশ কার্যকর। বিশাল উঁচু ভবনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত থরে থরে সাজানো বই।
বৃত্তাকার লাইব্রেরির এক জায়গায় দাঁড়ালে মোটামুটি পুরোটাই চোখে পড়ে। তরুণ-তরুণীরা
নিজ দায়িত্বে পাঠে মগ্ন। কেউ তাদের জোর করে পাঠায়নি অথবা পড়ার নামে ক্লোজ-আপের
বিজ্ঞাপনের মত কাটাকুটি খেলছে না।
শিক্ষা এখানে বাণিজ্য হলেও তার মানদন্ড রক্ষায় এতটুকু নড়চড়
নেই। টাকা দিয়ে পড়ছ – পড়ো, কিন্তু পাশ তোমাকেই করতে হবে। অথচ আমাদের দেশে গত
শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ওপর থেকেই
নির্দেশ থাকে পড়া-লেখা পরীক্ষা এসব কোন বিষয় নয় – শিক্ষার্থী টাকা দিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। সুতরাং তাকে
পাশ করাতে হবে। বুয়েট থেকে পাস করার পর আমার মেয়েও কিছুদিন এরকম দুটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিল এবং সেখানে কর্তৃপক্ষের লিখিত না হলেও মৌখিক নির্দেশও এমন
ছিল।
অথচ এখানে টাকা দিয়ে পড়লেও
শিক্ষার মানদন্ড যথেষ্ট উঁচু এবং শিক্ষার্থী সত্যিকার অর্থেই শিক্ষাগ্রহণ করতে
আসে। তাইতো স্টেট লাইব্রেরিতে যেমন দেখলাম নিবিষ্ট মনে প্রত্যেকেই লেখাপড়ায় মগ্ন,
তেমনি আর-এম-আই-টির লাইব্রেরিতেও। এখানে পড়তে বসে এরা চোখে চোখে লুকোচুরি খেলে না,
কিংবা অন্যের বিঘ্ন ঘটিয়ে চড়াস্বরে আলাপচারিতা করে না। এটা তারা করে লাইব্রেরির
বাইরে শহরের পার্কে, বিনোদনের জায়গায়। যেখানে স্বাধীনভাবে তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন
করে হাঁটে, নিবিড় চুম্বনে ডুবে যায় – তখন কাউকেই তারা পরোয়া করে না।
তবে দেশে থাকতেও প্রদীপের কাছে জেনেছিলাম আর এখানে এসেও
জানলাম সত্যিকারের অজিরা সাম্প্রতিককালে লেখাপড়ার প্রতি উদাসীন। ধনী দেশের সন্তান,
সরকার ভাতা দেয়, আর শ্রমের বিভাজন নেই বলে প্রয়োজনে যে কোন কাজ (রাস্তায় সুরকি
ঢালা থেকে সবরকম শারীরিক পরিশ্রমের কাজ) তারা করে আবার সে টাকা মদে আর বান্ধবীর
পিছনে উড়িয়ে দেয়। ‘বান্ধবী’ শব্দটি কি সর্বাংশে শুদ্ধ? কারণ এখানেতো বন্ধু-বন্ধু আর
বান্ধবী-বান্ধবীতে বিবাহ-বহির্ভূত দাম্পত্যেও কোন সমস্যা নেই। আর ছুটির দিনে
পার্কে, গাছের ছায়ায় অথবা বিশাল দালানের ছায়ায় তারা মনের সুখে পরস্পর সঙ্গসুধা পান
করছে, আবার কাল সকালেই হয়তো তুচ্ছ বিষয়ে সম্পর্ক ভেঙে যাবে।
স্টেট লাইব্রেরি ঘুরে আমরা গেলাম ডকল্যান্ড ইয়ার্ডে। ইয়ার্ডের
জলসীমার দুপাড় ঘিরে উঁচু ভবন। একপাশে ইত্তেহাদ স্টেডিয়াম – দেখে মনে হয় আকাশ ছুঁয়েছে। প্রদীপ দেখাল অপর পারে রনির
অফিসভবন এরিকসন। জ্বলে ভাসছে সাদা জলপায়রা শঙ্খচিলের মত জলযান।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে একপাশে কিছু দোকান, তার মাঝে
দু-একটা চায়নিজদের। ক্রেতা আকর্ষণ করার মত আকর্ষণীয় কিছু পণ্য এসব দোকানেই আছে।
অন্য দু-একটা যা আছে সেগুলো একেবারেই ম্যান্দা। ইয়ার্ডের ওয়াকওয়ে দিয়ে অনেকদূর
পর্যন্ত হাঁটা যায়। মুক্তবায়ু, স্বচ্ছ জল, নীল আকাশ – আজ একটু মেঘলা তবু কি মোহনীয়!
ডকইয়ার্ড প্রাঙ্গনে দুটো নারী স্ট্যাচু আছে। এদের একজনকে
দেখিয়ে প্রদীপ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বলো তো, এই মেয়েটি দেখতে কেমন? সে কিন্তু একজন অভিনেত্রী। আমি খুঁচিয়ে দেখে
বললাম, ‘তেমন আহামরি মনে হচ্ছে না’।
‘হুঁ হুঁ – কেমন বোকা বনলে। এই ব্যক্তি পুরুষ, কিন্তু নারী সেজে
সারাজীবন এত নিখুঁত অভিনয় করেছেন যে অনেকে বুঝতেই পারে না। তাঁর নাম এডনা।
অস্ট্রেলিয়ানরা এই মানুষটিকে খুব ভালবাসে। তাই এর মূর্তি বানিয়ে রেখেছে।
বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর যথারীতি খিদে চাগিয়ে উঠল। তাই ‘নান্দুস’। মেলবোর্নের নান্দুস আমাকে জাদু করেছে। সুদূর পর্তুগাল থেকে
আসা এই খাবারটি অজিদেরও রসনা জয় করেছে। না হলে সর্বত্র এর এত কদর কেন?
বিকেল পাঁচটার পর শহর আস্তে আস্তে নির্জন হতে শুরু করে – সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী ... । আমরাও ফিরলাম। দূষণমুক্ত, সহজগম্য মনোরম এ শহরে সারাদিন ঘুরেও ক্লান্তি আসে না। আর আমাদের ঢাকা শহরে? যার ললাটে জুটেছে কখনো এক কখনো দু’নম্বর দূষিত শহরের তকমা। সেখানে পথেই নষ্ট হয় জীবনের কর্মঘণ্টা, যানজটে অ্যামবুলেন্সে আটকা পড়ে মৃত্যু ঘটে বহু অমূল্য জীবনের।
*****
২২
দেশের খবর না শুনলে ভাল
লাগে না। যত কিছুই করি মন পড়ে থাকে জননী জন্মভূমির সংবাদের জন্য। বাংলাদেশি খবরের
চ্যানেলে জানা গেল –
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে গত একমাসে চারবার আগুন লেগেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে
সুন্দরবন ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করে আর এই অরণ্যমাতা আমাদের অবহেলায় দিন দিন তার
ঐতিহ্য আর প্রাণ হারাচ্ছে। বিশ্বঐতিহ্যের গৌরবময় অংশ হয়েও দিনে দিনে বিরান হতে
চলেছে।
প্রদীপকে বললাম, ‘দেশে এসব শুনে শুনে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এ্রর মাঝেই খাই দাই দুঃখ করি আবার
ভুলেও যাই। আর দূরে আছি বলে যে কোন কিছুই মস্তিষ্কের কোটরে অনুরণন ঘটায়। নইলে
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে হানাহানি, তনু হত্যা, ছাত্রনেতা নাজিম হত্যা, সড়ক
দুর্ঘটনা, রেলগাড়ির লাইনচ্যুতি সবই এত মনোযোগ কাড়ে, এত আগ্রহ নিয়ে দেখি যেন শুধু
আমি মেলবোর্নে আসার পরই এসব ঘটছে। শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন যা আমাদের জীবনের
নৈমিত্তিক ঘটনা বলা যায় – তাও
আমাকে ভাবায়! আর এখানে মেলবোর্ন শহরে এসেছি দুমাসের মত হতে চলল, শুনিনি রাস্তায়
দুর্ঘটনা ঘটেছে, কোন নারী নির্যাতিত হয়েছে অথবা হিংস্রতায় কোন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
হায় ঈর্ষা, তুমি আমাকে এত জ্বালিয়ে মারছ কেন? আমি অতিসাধারণ গৃহজীবী, অতিসাধারণ
প্রাণী, দেশে থাকতে এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি।
আর আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও বলিহারি – দেশে যেন ভাল কিছু ঘটছে না। শুধু নেতিবাচক খবর আতাল-পাতাল
খুঁড়ে বের করে আনে। কার আগে কে কত বেশি দুঃসংবাদ পরিবেশন করতে পারে সেই
প্রতিযোগিতা।
আমার বন্ধু কাজল তার মেয়ের কাছে এখানে এসেছে গতবছর। একদিন এক
অজিবুড়ো আলাপচারিতায় তাকে নাকি বলেছিল – বাংলাদেশ? ঐ যেখানে ডিজাস্টার আর নানারকম ক্রাইম ঘটে! কাজল জানতে চাইল, ‘কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’
তার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘কেন তোমাদের মিডিয়াতেই তো আসে।‘
সেই থেকে দেশের মিডিয়ার ওপর কাজল খুব খাপ্পা। যেখানে
প্রতিবেশী ভারতীয় মিডিয়ার বেশিরভাগ চ্যানেল বিনোদনে মশগুল, সেখানে আমাদের চ্যানেলে
চ্যানেলে শুধু সংবাদ আর বিরতিহীন বিজ্ঞাপন। ভারতীয় সিরিয়াল এমন আধিপত্য বিস্তার
করেছে – আমরা যারা একদা বিটিভির একনিষ্ঠ দর্শক ছিলাম
তারাও এখন আর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করি না। অথচ ভারতীয়
চ্যানেলের পারিবারিক কূটনামীর চেয়ে আমাদের নাটক অনেক ভাল ছিল। তবে ইদানীং
নাট্যকাররা হুমায়ূন আহমেদকে নকল করে এত বাজে নাটক তৈরি করে তা দেখার আগ্রহই থাকে
না। সবাই যে হুমায়ূন আহমেদ হয় না এটা
উপলব্ধি করলে তাদের স্বকীয়তাও থাকত, নাটকও জনপ্রিয় হত।
*****
২৩
রাতের খাবার শেষে প্রদীপ
বলল, ‘গডফাদার দেখেছ? মার্লো ব্রান্ডোর?’
আমি বললাম, ‘সিনেমা পত্রিকার পোকা ছিলাম, তাই অনেক কিছু জানি, কিন্তু দেখিনি। গডফাদার
বইয়ের অনুবাদও পড়েছি।‘
‘তাহলে
দেখ, ভাল লাগবে’।
ছবি দেখতে দেখতে প্রদীপ জানাল, ‘এই ছবির জন্য মার্লো ব্রান্ডো শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি সেটা গ্রহণ করেননি’।
‘কেন?’ আমার চোখ কপালে উঠল।
‘কারণ,
তার ভাষ্য ছিল এই নেতিবাচক চরিত্রের জন্য অস্কার দিলে মানুষ তো কুখ্যাত মাফিয়া ডন
হতে অনুপ্রাণিত হবে’।
আসলে কেউ কেউ পারে এতটা দৃঢ়তা দেখাতে। যেমন জাঁ পল সাঁত্রে
নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ছবি দেখে অনেক আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
*****
২৪
সকালে উঠে যে খবর পেলাম
তাতে মনটা বিষাদে তিক্ত হয়ে গেল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল
করিমকে হত্যা করা হয়েছে। শিক্ষক হত্যা বাংলাদেশে খুব সাধারণ বিষয়। রাজনৈতিক কারণে নিজের
দলের কর্মী হত্যা সেটাও এখন স্বাভাবিক। অনেক সময় এসব দলাদলি আর হত্যার সংবাদে আমরা
এখন আর বিচলিত হই না। শুধু যার বা যাদের সন্তান যায় দুঃখটা তাদেরই আজীবন বয়ে
বেড়াতে হয়। আশি-নব্বইয়ের দশকে রাউফুন বাসুনিয়া অথবা নূর হোসেনের কিংবা ডাক্তার
মিলনের মৃত্যু আমাদের যতটা শোককাতর করেছিল এখন আর ততোটা করে না। কিন্তু রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ৬৯এ ডক্টর শামসুজ্জোহা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আদর্শিক
বিরোধে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে প্রাণ দিতে হয়েছে। সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রীদের মতে এরা
একেবারেই নিজকর্মে নিবেদিত ভাল মানুষ ছিল। আজ কষ্ট হচ্ছে কাল ভুলে যাব। শুধু
কষ্টের বোঝা জীবনভর বহন করবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা। আর বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে
কেঁদেই যাবে।
*****
২৫
আজ আমরা যাব ক্যাপ্টেন
জেমস কুকের কটেজ দেখতে। এই কটেজটির বৈশিষ্ট্য হল এর প্রত্যেকটি ইট পাথর, ব্যবহার্য
জিনিস ইংল্যান্ডে ঠিক যেমন ছিল খুলে প্যাকেট করে আবার এখানে এনে ঠিক সেভাবে স্থাপন
করা হয়েছে।
ছোট্ট দোতলা বাড়ি। সরু খাড়া সিঁড়ি, সামনে বাগান, পিছনে কিচেন
ও হার্ব-গার্ডেন। বাইরে একপাশে সেই সময়ের পোশাক, বনেটদেয়া টুপি পরে উৎসাহী
ট্যুরিস্টরা ছবি তুলছে। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে
অষ্টাদশ শতকে ফিরে যাওয়া। লেখার টেবিল, ঘর গরম রাখার পিতলের মালসা সবই যথাস্থানে
রাখা আছে। সম্ভবত এটা তার আদি নিবাস নয়। পড়ার টেবিলে কাগজ কলম পূর্ববৎ রাখা। টানা
ইটালিক অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
নিচের তলায় মিউজিয়াম এবং স্যুভেনির শপ। ছোট্ট মিউজিয়ামের
দেয়ালে কুকের সমুদ্র যাত্রার জলপথের মানচিত্র আঁকা। কি দুর্ধর্ষ নাবিক ছিল এই
মানুষটা! পৃথিবীর সমুদ্রের আর মহাসমুদ্রের কতটুকু সে পাড়ি দিয়েছিল সে ধারণা মনে হয়
তারও ছিল না।
*****
২৬
আজ রোববার, ২৪ এপ্রিল।
এদেশে এসেছি পুরো দুমাস হলো। আজকের পরিকল্পনা প্রদীপের আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখব। এই
এলাকাটি মেলবোর্নের ইস্ট সাইড, কিছুটা অসমতল। বাড়িগুলোও বনেদি ছাঁদের। কিছু কিছু
বাসার সামনে ফুলের বাগান এত বেশি পুষ্পশোভিত যে বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
প্রদীপ বলল, এসব বাড়ির মালিক সাধারণত বুড়োবুড়ি হয়। অবসরের কর্মহীন জীবনে এরা
বাগানের পরিচর্যা করে বেঁচে থাকার আনন্দ আহরণ করে। এক বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা
ডালিম গাছে অসংখ্য ডালিম ধরে আছে দেখে না দাঁড়িয়ে পারলাম না। পারি কীভাবে?
ক্ষুদ্রাকৃতির একটি গাছে এত ডালিম এটাতো আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য। কিছুক্ষণ পর ষষ্ঠ
ইন্দ্রিয় অনুভব করল আমরা ডালিম দেখছি, আর ঘরের ভিতর থেকে অন্য কেউ আমাদের ওপর
লক্ষ্য রাখছে। তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম। এদেশে নাগরিকতা কোন কিছুতেই অতিমাত্রায় কৌতূহল
পছন্দ করে না।
*****
২৭
মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়
দেখেছি। আর-এম-আই-টি’র বান্ডুরা
ক্যাম্পাস এবং শহরের কয়েকটি ক্যাম্পাস এবং লাইব্রেরি দেখেছি। আজ বিকেলে যাব
লা-ট্রোব ইউনিভার্সিটিতে। এটা প্রদীপের বাসার কাছে।
শেষ দুপুরের দিকে যখন বিকেল নামছে তখন আমরা গেলাম লা-ট্রোব
ইউনিভার্সিটিতে। অনেক বড় এরিয়া নিয়ে তৈরি এই ক্যাম্পাস। এত প্রচুর জায়গা যে এখনও
অনেক নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের জন্য। বিশাল সবুজে ঢাকা
চত্বর। আকাশমুখি সরল একহারা গড়নের বৃক্ষ, অসংখ্য হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া। পাহাড়ি
ঝিরির ওপর সেতু দিয়ে ক্যাম্পাসের দুপাশকে যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভাবতে যে
বিরাটত্ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মনের মাঝে যে প্রসারতা আসে এখানকার
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমনই। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়কে এর গুণ-মানের জন্য একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হত। এছাড়া
রাজশাহী, জাহাঙ্গীর নগর, চট্টগ্রাম এমনকি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও আকার আকৃতি,
স্থাপত্য আর শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক উচ্চস্তরে ছিল। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি,
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, সবকিছু নিয়ে আজ এসব বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ অধোগতির পথে ।
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নীতি-নৈতিকতা সকল মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসার আখড়া। কোন
কোনটা তো সাইনবোর্ডসর্বস্ব। অথচ এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখে মনে হয় কেউ চাইলে
জ্ঞানচর্চায় এখানে একজীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কিন্তু লা-ট্রোবের বিশাল আঙিনা ছেড়ে যেতে
মন চাইছে না। যেতে নাহি মন চায়, তবু যেতে হয় – কারণ সন্ধ্যার পর এখানে থাকা যাবে না। চলে যাচ্ছি তবু মনে
হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর-সুশোভন পরিবেশের স্মৃতি আজীবন আমার চোখে লেগে
থাকবে।
বাসায় ফিরলাম – এবার ফিরে যাওয়ার পালা। নাতি-নাতনী আর কন্যা-জামাতা অপেক্ষা করছে। সাউথ মোরাং
থেকে টারনিটের দূরত্ব ৫৪ কিলোমিটার। গাড়িতে ৪৫ মিনিটের মত লাগে। অনেক দূরত্ব,
কিন্তু রাস্তার মসৃণতা, সরলগতি, চলার শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে সময় অতটা টের পাওয়া যায়
না।
*****
২৮
টারনিটে ফেরার পর আবার
নতুন করে পরিকল্পনা শুরু হল কোথায় যাওয়া যায়। এখন পূর্বাদের ছুটি চলছে। এসময়
সাধারণত মা-বাবারাও ছুটি নিয়ে বাচ্চারাসহ বেড়াতে যায়। আমরা লিস্টে প্রথম রাখলাম
ওয়্যারাবি সাফারি। টারনিট থেকে ওয়্যারবি খুব কাছে। রাকারা ওখানে শপিং-এও যায়। এর
আগে ওরাও সাফারিতে যায়নি।
সুতরাং সাব্যস্ত হলো প্রথমে সাফারি। যাওয়ার পথে দুপাশে সবজি
ক্ষেত। মাটির নিচে থেকে পাইপ দিয়ে পানি দেয়া হচ্ছে। সজীব সুন্দর বাঁধাকপি, ফুলকপি,
টমেটো ক্ষেত। রনি বলল, এখানে চাষীরা হচ্ছে সবচেয়ে ধনী। আবার সরকারও তাদের
পেট্রোনাইজ করে। দুপাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেত। আবার
মাঝে মাঝে রাস্তার দুপাশে বৃক্ষবীথি সবকিছুকে আড়াল করে যেন বলছচে আমায় দ্যাখ।
মেঘ-রৌদ্রের মাখামাখি আবহাওয়া। কখনো মেঘে মুখভার কিন্তু পূর্বাভাস বলেছে বৃষ্টির
কোন সম্ভাবনা নেই।
সাফারির অনেক দূর থেকে দুপাশে গাড়ির লম্বা লাইন। রনি অনেক
দূরে গিয়ে পার্কিং-এর জায়গা পেল। গাড়ি রেখে কিছুটা পিছনে হেঁটে আমরা সাফারিতে
ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ। প্রচুর লোক বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। বাঁশের
ব্যারিকেড দিয়ে লোকজনকে আটকে রাখা হয়েছে। এত লোকজন, কিন্তু কেউ শৃঙ্খলা ভাঙছে না,
কেউ কাউকে ধাক্কা দিচ্ছে না।
ট্রেইল বাস একদলকে সাফারি
ঘুরিয়ে এনে অন্য জায়গায় নামিয়ে দিচ্ছে। একসঙ্গে দুটো করে বিশাল বাস জোড়া লাগানো।
গাইড সঙ্গে আছে। চালকও মাঝে মাঝে বর্ণনা দিচ্ছে। বিশাল এলাকাজুড়ে সাফারি। জিরাফ, গন্ডার, উট, জলহস্তী, হরিণ, জেব্রা সবই আছে। কিন্তু
নিরাপদ দূরত্বে সহ-অবস্থানে। পাখি, গাছপালা, জলহস্তী, ক্যাঙারু, কুমীর সবাই যে যার
মতো নিজের জায়গায় ঘুরছে ফিরছে। ট্যুরিস্টরা ছবি তুলছে।
এত বড় জায়গা তবু ঘুরতে ঘুরতে
আবার আগের জায়গায় এসে নামলাম। এখানেও অনেক কিছু দেখার। আদিবাসীদের নানারকম মুখোশ
দিয়ে সাজানো তোরণ, একটা গোল কটেজে একজন আফ্রিকান বাচ্চাদের সিংহের গর্জন এবং তার
ডাকের নানারকম কসরৎ দেখাল। পেছনে সেই মহাদেশের আদিম বাজনার দ্রিমি দ্রিমি ধ্বনি – এক ধরনের আবেশ তৈরি করছে। ভীষণ দক্ষ কালো মানুষটি স্পষ্ট
ইংরেজিতে বাচ্চাদের সাথে মজা করল অনেকক্ষণ। তারপর তার স্লটের সময় শেষ হতে একটুও
দেরি না করে ‘গুডবাই’ জানিয়ে বিদায় নিল।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম হাঁস, পাখি, কাকাতুয়া। এরপর বানর
আর সিংহ। বিরাট এলাকায় অনেক দূরে পাঁচ ছয়টি সিংহ-সিংহী বসে আছে। গ্রিলের ভিতর দিয়ে
দেখতে হয়। তবে আফ্রিকান সিংহের যে তেজ অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে দেখি তার কণামাত্রও
এখানে দেখলাম না। বিধ্বস্ত বুড়োটে হতাশ পশুরাজদের দেখে মনে হল – আসলেই বন্যেরা বনে সুন্দর।
সব প্রাণীর হয়তো সমান অভিযোজন ক্ষমতা থাকে না। কারণ এখানে তো
খাবার, যত্ন – কোনটারই অভাব নেই। নাহলে আমাদের দেশে যেমন
চিড়িয়াখানায় পশুপাখির বরাদ্দ খাদ্য রক্ষকরাই খায়। যে কারণে ঢাকা শহরের একটিমাত্র
সরকারি রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিষ্ঠিত চিড়িয়াখানায় অপরিচ্ছন্নতা, দুর্গন্ধ আর আধমরা
পশুপাখি একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখার শখ থাকে না। অথচ দুইকোটির কাছাকাছি মানুষের
ঢাকা শহরে এই চিড়িয়াখানাটি বিনোদন ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ক্ষেত্র হতে পারত শিশুদের
জন্য।
এখানে দেখছি শিশুরা কত মজা করছে, ছুটছে, খেলছে, লাফাচ্ছে।
মা-বাবার পরোয়া করছে না। কারণ এখানে নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিদ্র। দুপুরে আমরা একটা
গাছের ছায়ায় কাঠের টেবিল আর বেঞ্চে বসে সাথে আনা খাবার খেলাম।
আমি যেখানেই যাই শিশু, প্রকৃতি, প্রাণিকূল সবই আমাকে মুগ্ধ
করে। বিশেষত গাছপালার নিবিড় সাহচর্য।
এখানেও দেখছি সবুজ সুন্দর ঘাস, ছায়াদেয়া বৃক্ষ। লতানো গুল্ম আবার সর্বত্রই একটা
সৌষম্য।
দুপুর বিকেলের দিকে গড়াতে আমরাও ফেরার প্রস্তুতি নিলাম।
*****
২৯
আজ আমরা যাব মেলবোর্ন
শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবন ইউরেকা টাওয়ারের উপরে স্কাই ডেকে। আটাশি তলার উপরে উঠে
মেলবোর্ন দেখা। রনি আগেই টিকেট করে এনেছিল।
আমরা রওনা দিলাম। বাচ্চাদের ছুটি থাকায় বেশিরভাগ অভিভাবক নিজ
নিজ শিশুদের নিয়ে এসেছেন, পাশাপাশি তরুণ-তরুণী, প্রবীণ-প্রবীণাও কম নয়।
লিফ্ট এত দ্রুত চলে আমার জানা ছিল না। লিফ্টে উঠার পর ধপ্
ধপ্ করে কি যে দ্রুতগতিতে সেটি আমাদের স্কাইডেকে তুলে দিল বুঝতে পারলাম না
সেকেন্ডের সমষ্টিতে মিনিট পূর্ণ হল কি না।
এবার দেখার পালা। নিচে শহরের রাস্তাঘাট আর গাড়িগুলোকে মনে
হচ্ছে কোন শহরের পরিকল্পিত নকশা। স্কাইডেক আস্তে আস্তে ঘুরছে। মুভিং হওয়ার কারণে
শহর এবং শহরের চারপাশ দেখা যাচ্ছে। দূরে সাগর, সেখানে শ্বেতকপোতের মত জাহাজ, নীল
জলরাশিতে ভাসমান ইয়ট, অভিযাত্রীরা পাল তুলে যাত্রা করেছে কোন অজানার পানে – তারাই কেবল জানে। টেলিস্কোপ দেয়া আছে কিছু কিছু জায়গায়
দেখার সুবিধার জন্য। কিন্তু মানবচরিত্রে সর্বত্রই কিছু সাদৃশ্য রয়েছে যা সহজে
উপড়ানো যায় না। কারণ দেখলাম যারা একবার টেলিস্কোপ দখল করেছে তারা আর সহজে সেটা
ছাড়তে চাইছে না। অন্যদেরও যে দেখার অধিকার আছে সেক্ষেত্রে সেই বোধটা তাদের মগজ
থেকে ডিলিট হয়ে গেছে।
এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি বোটানিক্যাল গার্ডেন, সাইন অব
রিমেম্বারেন্স। কিন্তু সব যেন স্যুভেনির। পূর্বা-দিব্য ভীষণ আনন্দিত। আমরাও।
রনিবাবাকে থ্যাংকস জানালাম।
No comments:
Post a Comment