Saturday, 1 March 2025

রিফাৎ আরার 'মেলবোর্নে দেশ বিদেশ' - পর্ব ১৪-২০

 



১৪

 

এখানে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের গ্রাহক হওয়া যায়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি বা প্রকৌশলগত সমস্যার কারণে কি না জানি না, একমাত্র সময় টিভি চ্যানেল ছাড়া আর কোনটাই ভাল দেখা যায় না। তাই বাসায় থাকলে সকালে উঠেই আমার সঙ্গীর কাজ হল টিভি ছেড়ে বাংলাদেশের খবর শোনা। যদি কোনদিন আবহাওয়াগত কারণে সংবাদ শুনতে সমস্যা হয়, সেদিন তার মুখে ভাত রোচে না, হজম হওয়াতো দূরের কথা।

          যদিও জানি টিভি অন করলেই বাংলাদেশের যেসব সংবাদ শুনব সেগুলো মন ভালো করার চাইতে সারাদিনের জন্য মনের ভেতর একটা কাঁটা বিঁধিয়ে রাখবে। যত হাসি আনন্দ করি, ঐ কাঁটাটা মাঝে মাঝেই খচ্‌ করে একটা খোঁচা মারবে বেলুনে পিন ফোটানোর মত। কারণ এমন দিন নেই, যেদিন দেশে ট্রেন-বাস দুর্ঘটনার কথা নেই। অধিক জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ এই দেশে আমরা নানা দুর্ঘটনায় পায়ের তলায় পিঁপড়ের মত পিষে যাই। শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, ,গুম, খুন, হত্যা, সামান্য কিছুতে দুইপক্ষের মারামারিতে আহত নিহত এরকম এরকম অসংখ্য ঘটনার বয়ান মনকে পীড়িত করে। অথচ আমাদের এই দেশে একটা বীজ পড়লে যত্ন ছাড়াই বড় হয়, ফুল ফোটায়, ফল দেয়। প্রকৃতির বিচিত্র সবুজ আর সীমাহীন নীলাকাশ, অসংখ্য নদী খাল বিল সব কিছুই এই বদ্বীপকে দিয়েছে উর্বর শস্যের শ্যামলিয়া। কিন্তু সংবাদে কোন ভাল সংবাদ নেই।

          এখন প্রচন্ড দাবদাহে পুড়ছে বাংলাদেশ। চৈত্র-বৈশাখের খরা, তার ওপর ভূমিদস্যু আর নদীখেকোরা মাঠ-বাট, খালবিল্‌ নদী জলাশয় সব এমনভাবে গিলেছে যে মানুষ পানির কষ্টে, গরমে কেবলই অসুস্থ হচ্ছে। শহরে-গ্রামে সর্বত্রই দূষণ। ইটভাটা, কলকারখানা, ট্যানারি-মানববর্জ্য সব মিলে এই দেশটাকে শ্রীহীন করে তুলেছে। আধুনিক নগরায়ন অবশ্য ধনীদের জন্য বিলাসবহুল বাড়িঘর, অ্যাপার্টমেন্ট আর কনভেনশন সেন্টার, হোটেল, রেস্টুরেন্ট রিসোর্টের পসরা সাজিয়েছে কিন্তু পরিবেশের কথা কেউ ভাবছে না। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা ছাড়িয়ে মেঘনার দিকেও যাচ্ছে দূষণ। কোথাও বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা, কোথাও পানিশূন্যতা। আর বন-জঙ্গলতো যে রক্ষক সেই ভক্ষক। হায় বাংলাদেশ, হায় দুঃখিনী মা আমাদের।

          এসব খবরের মাঝেও হঠাৎ যে খবরে চমকে উঠলাম সেটা তনু হত্যা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে এই তরুণীটির লাশ পাওয়া গেছে। ঘাতকের দল খুবলে খেয়ে প্রাণটুকুও রাখেনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্সের ছাত্রী তনু নাটক করত। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিল। টিভিতে ওর ছবিটা দেখছি মাথায় হিজাব পরা নির্মল সুন্দর একটি মুখ। এই মুখ দেখেও মায়া হয় না নরখাদকদের? এরাতো পশুরও অধম।

          কুমিল্লা শহর থেকে বিক্ষোভ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। তনুর মা পাগলপ্রায়। কিন্তু হত্যার কোন ক্লু পাচ্ছে না। যাদের বাসায় যেত তাদেরকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। কি জানি এ হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটন হবে কবে। কারণ সামরিক ঘাঁটির মত নিরাপদ জায়গায় এসব কাজতো সবাই করতে সাহস পাবে নানিশ্চয় এমন কেউ আছচে যাদের হাত অনেক লম্বা। আর প্রশাসন চাইলে অপরাধী ঠিকই ধরা পড়ে, আবার না চাইলে সাগর-রুনির হত্যার মত, ত্বকী হত্যার মত অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের কোনদিনও কোন সূত্র পাওয়া যায় না। এখানে বিবেক প্রশ্নকাতর কিন্তু বোধ নিরুত্তর।

 

*****

১৫

 

অস্ট্রেলিয়ায় প্রত্যেকটি আবাসিক এলাকায় শর্ত হচ্ছে পার্ক, লেক, খেলার মাঠ, প্রাইমারি স্কুল এগুলো থাকতে হবে টারনিট আবাসিক এলাকায় রাকাদের বাসার উল্টোদিকেই খেলার মাঠ, পার্ক, আরো কিছুটা হেঁটে গেলে লেক

          স্কুলগুলোতে প্রতি দশ সপ্তাহ ক্লাসের পর দুসপ্তাহ ছুটি এবং ফাইভ পর্যন্ত কোন পরীক্ষা নেই। শুধু শিক্ষকের মূল্যায়ন আছে শিক্ষার্থীর ক্লাস পারফরম্যান্স ও অন্যান্য কারিকুলামের ভিত্তিতে। এই এলাকায় অভিবাসী বেশি হওয়ার কারণে বেশিরভাগ স্কুলের শিক্ষার্থী এশিয়ান ও আফ্রিকানদের সন্তান। প্রথম শ্রেণিতে আমার নাতি দিব্যকে দেখলাম বাসায় টুকটাক প্র্যাকটিস করে আর একটা করে বই নিয়ে আসে। সে বইয়ের পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি আর নিচে এক লাইনের বাক্য থাকে। এর ফলে যেটা হয় একই শব্দ ঘুরে ফিরে আসে। এর ফলে যেটা হয় একই শব্দ বারবার দেখতে দেখতে সে পড়তে শিখছে। একবার মনে হল। আহা বাংলায় যদি এমন হত।

          পরমুহূর্তেই মনে হল আরে বাবা, আমার মাতৃভাষা কি এত সহজ। তার একটা বিশেষ মর্যাদা এবং গৌরব আছে, আছে যুক্তাত্তর, ফলা, রেফ, মাথার ওপরে চন্দ্রবিন্দু আরো আরো কত কি। নাহ্‌ সম্ভব নয়। দরকার নেই আমরা না হয় আরেকটু কষ্ট করে শিখব, যেমন শিখছে চাইনিজ, রাশিয়ানরা।

          পার্কে যাই। আবহাওয়া ভাল থাকলে ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, নীল আকাশ আর তার বুকে সাদা মেঘের ভেলা। নানান দেশের নানা রঙের শিশু এবং অভিভাবক। গায়ের রঙ বা বর্ণই বলে দিচ্ছে এরা এশিয়ান এরা অজি, আবার এশিয়ানদের মধ্যে এরা সম্ভবত শ্রীলঙ্কান বা তামিল। পাঞ্জাবী আর শিখদের তো টুপিতে যায় চেনা। শিশুরাও মাথার চুল তালুতে বেঁধে আঁটোসাটো টুপি পরে থাকে। আর চাইনিজ, মালয়েশিয়ান, ইন্দো-জাপানিজ আলাদা করে চিনতে আমার কষ্ট হয়। তবে এই এলাকায় চায়নিজ তেমন চোখে পড়ে না। পার্কে যেমন ইচ্ছে খেলছে শিশুরা, দোলনায় দুলছে, দড়ি ধরে ঝুলছে, ধাঁধার পথ ধরে ওপরে উঠছে। সবাই আনন্দে মেতে আছে যেন আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে

          নাতি-নাতনি খেলে, আমরা বসে থাকি। আশেপাশে আমার চেয়েও অনেক বয়েসী মহিলা আছেন, আছেন তরুণী এবং বৃদ্ধ দাদুরাও। আমার ইচ্ছে করে কথা বলতে। ভাল ইংরেজিও জানি নাযেটুকু জানি সেটা এত টুটাফাটা যে মনে মনে ট্রান্সলেট করতে গিয়ে হিমশিম খাই। তবু ভরসা এখানে আমাকে কেউ চিনে না। তাই কখনও ইয়েস, নো, ভেরি গুড-এর মত ইংরেজি, আবার কখনো বলিউডি চালে হিন্দি বলার চেষ্টা করি। কিন্তু একজন বাংলাদেশিকেও পাই না। প্রবীণরা বেশি আসেন নাতি-নাতনির দেখাশোনা করতে। কারণ মা-বাবা চাকরি করে। কেউ কেউ অবশ্য বেড়াতে আসেন।

          একদিন এক পাকিস্তানি তরুণী-মাকে জিজ্ঞেস করলাম সে বাংলাদেশের নাম শুনেছে কি না। জানাল, শুনেছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ১৯৭১-এ তোমরা যে বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলে তা জান?

          মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে ভাল করে দেখল। তারপর বলল, না।

          কয়েক মুহূর্ত পর সে আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেল। আমার কেমন মনসুখ মনসুখ লাগল। একজন পাকিস্তানিকে তো বলতে পারলাম - তার দেশ পরাজিত।

          আমি এসব করি। প্রবীণাদের প্রশ্ন করি আপ কিসকে পাসসে রাহ্‌তে হ্যায় লেড়কা ঔর লেড়কি? তিনি জানালেন বেটা। তখন মনে পড়ল এটা তো লেড়কা-লেড়কি হবে না, হবে বেটা। তখন মনে হল, আহারে মহিলা আমার জ্ঞানের বহর দেখে মনে মনে হাসছেন। ধূর! তাতে কী এসে যায়। আমি কে, কী, কোথা থেকে এসেছি তা তো সে জানে না। মনে পড়ল একটা চুটকি এক অফিসের পার্টিতে একজন কর্মকর্তা বসকে দেখিয়ে জুনিয়র একজনের কাছে খুব দুর্নাম করছিল। অনেকক্ষণ পর জুনিয়রটি প্রশ্ন করল, জানেন আমি কে?

          না কর্মকর্তাটি বলল।

          আমি ওনার ছেলে

তখন কর্মকর্তাটি পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি জানো আমি কে?

          ছেলেটি বলল না

তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। বলেই তিনি কেটে পড়লেন। আমাকে অবশ্য কেটেও পড়তে হল না। কারণ এ বিদেশ-বিভূঁয়ে আমাকে কেউই জানে না।

          আমার এসব কর্মকান্ডের মধ্যে নাতি-নাতনিদের নানা বসে বসে কেবল আফসোস করেন দেশে থাকা নাতনীটির জন্যে। আহা আমাদের অথৈতো এসব আনন্দ করার সুযোগ পায় না। ঘুরে ফিরে ফ্ল্যাটবাড়ির খাঁচায় বন্দী শিশু। এমনই তার ব্যাকুলতা পারলে অথৈকে উড়িয়ে নিয়ে আসে। আমি কিছুটা নির্বিকার। বাংলাদেশের লক্ষ কোটি শিশু অথৈদের মতই জীবন যাপন করে। আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমাদের হয়ে অঙ্গীকার করলেও আমরা পালনে ব্যর্থ। তাই কষ্ট হলেও আমি চুপ করে থাকিকিন্তু ভদ্রলোক শিশুদের আনন্দ দেখে ওর কথা বলে, আমার ভিতরে কষ্ট আরও বাড়ে।

          দিব্য-পূর্বার স্কুল খোলা থাকলে ঐ সময়টুকুতে আমরা কোনদিন শপিং মলে যাই। কোনদিন বাসার কাছে লেকের পারে ঘুরতে যাই। এখানকার সজীব গুল্মলতা আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। যত দেখি চোখ ফেরাতে পারি না। লেকে হাঁস সাঁতার কাটে। অনেক বড় বড় রাজহাঁস, ছোট পাতি হাঁস আর দুটো বড় ব্ল্যাক সোয়ান। ব্ল্যাক সোয়ান মনে হয় অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব কোথায় যেন পড়েছিলাম। সবাই বাসা থেকে পাউরুটি নিয়ে আসে। টুকরো করে ছুঁড়ে দিলেই কার আগে কে নেবে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

          লেকের ওপর বাঁধানো সেতু, পারাপার করা যায়। ওপারেও সুন্দর আবাসিক এলাকা। ছবির মত নয়, ছবিই বটে। কারণ হুশহাস শব্দে দুএকটা সচল মোটরযান গেলেও মানুষ চোখে পড়ে না।

          এ পারে লেকের ধারে কিছু বাড়ি ডুপ্লেক্স। এসব ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটবাড়িগুলোকে এরা বলে টাউন হাউজ। রাকাকে বলি, এখানে যারা থাকে তারা নিশ্চয় অনেক সুখি। এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায়। বলেই মনে হল, সুখতো আসলে মনে। মনে সুখ না থাকলে পৃথিবী স্বর্গ হলেই বা কী আসে যায়।

 

*****

১৬

 

শপিং মলে গেলেই মেয়ে আমাকে কিছু না কিছু খাওয়ায়। আবার সবাই মিলে ছুটির দিনে ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে যাই। একদিন গেলাম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। ওরে বাপ। সেকি ভীড়।  আমাদের এখানে অনেক বিয়ে বাড়িতে যেমন  যারা খাচ্ছে তাদের পরের ব্যাচে বসার জন্য চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই কাজটা উভয়পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর, তবু খালি পেটেতো ফিরে আসা যায় না। এখানেও উইকএন্ডে সেরকম ভীড়। আজ আবার এক নবদম্পতির বিয়ের পার্টি। সুতরাং ঠান্ডা গরম থেকে সবরকম পানীয় এবং খাবার আছে। এখানে মূল্য অনুপাতে খাবারের দাম বেশি বলে মনে হলো।

          এই রেস্টুরেন্টের মালিক কি কলকাত্তাইয়া? কারণ কলকাতার অর্থাৎ পূর্ব-বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার মানুষদের মাঝে খাদ্যসংস্কৃতিতে বিরাট ব্যবধান। আমাদের বাংলাদেশের মানুষরা যেমন ভরপেট খেতে ভালবাসে তেমনি খাওয়াতেও ভালবাসে। অতিথি সত্যিই তাদের কাছে নারায়ণ। যত দরিদ্র গৃহস্থই হোক না কেন তার সাধ্যমত চেষ্টায় সে অতিথি আপ্যায়ন করে। অন্যদিকে কলকাতার মানুষদের কিপ্টেমি নিয়ে এই বাংলায় নানারকম কৌতুক প্রচলিত আছে। ওখানে নাকি কখনো খাওয়ার সময় ছেলে বাবার কাছে এলে বাবা জানতে চান, তুই নিশ্চয় খেয়ে এয়েচিস

          হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি খেয়েচি, ও নিয়ে তুমি ভেবো না বলে ছেলেও বাবাকে আশ্বস্ত করে। আমার ছোট ভাই কমল প্রায় মজা করে, কারণ পশ্চিম বাংলার সাথে আমাদেরও আত্মীয়তা আছে। তার একটা গল্প এরকম দরজায় নক করার পর গৃহিনী জানতে চাইলেন, কে?

          বাইরে থেকে সাড়া এল, দরজা খোল পিসি, আমি জয়ন্তখাবারের সময় জয়ন্ত! পিসি গলা চড়িয়ে জবাব দিলেন কে জয়ন্ত, কস্মিন কালেও জয়ন্ত নামের কোন ভাইপো আমার ছিল না

     পিসি, আমি খেয়ে এসেছি, তুমি দরজা খোল- পিসি অমনি ছুটি এসে দরজা খুলে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন, আয় বাবা জয়ন্ত, বুকে আয়

          আমার এক ছাত্রী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। সেও বলেছিল, ম্যাডাম ওখানে দোকানে একটা মিষ্টিও কেনা যায়, আর কাটাপোনা মানে মাছের কাটাটুকরো অহরহ এক, দুটুকরো বিক্রি হয়। মনে পড়ছে একবার সানন্দা পত্রিকায় কিছু টিপ্‌স পড়েছিলাম। সেখানে একটা ছিল এরকম ধরুন আপনি নিজে খাবেন বলে রোস্ট রান্না করেছেন। এমন সময় বাড়িতে অতিথি এল তখন আপনি কী করবেন? একটা মোমবাতি কিছুক্ষণ জ্বালিয়ে রাখুন তাহলে অতিথি রোস্টের গন্ধ পাবেন না, আর আপনারও সমস্যা হল না।

          টিপ্‌স পড়ে হাসতে হাসতে দম ফাটার জোগাড়। কারণ মেহমান যদি আসে আমি বা আমরা তো খুশি হয়ে আগে রোস্ট তার পাতে তুলে দিয়ে মানসিক পরিতৃপ্তি লাভ করব।

          এখানেও দেখলাম স্টেনলেস স্টিলের ছোট ছোট বাটিতে এবং স্টিলের কড়াইতে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে যা দামের তুলনায় যৎসামান্য। বসার চেয়ারগুলোও এতবেশি গায়ে গায়ে লাগানো যে ঠাসাঠাসি অবস্থা। অর্থাৎ যেখানে কুড়িজন বসতে পারে সেখানে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের ব্যবস্থা। আলো-আঁধারিতে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক বাজছে, আবার হঠাৎ ধুমধাড়াক্কা গান। দেয়ালে কত্থক নৃত্যের ভঙ্গিমায় নারীর চিত্রপট। ঠিক আরাম পেলাম না। তবে এটাও ঠিক বিদেশিরা উইকএন্ডে রেস্টুরেন্টে যায় খেতে, পান করতে। তাই সাধারণ রেস্টুরেন্টগুলোতে অন্দরসজ্জার তেমন কোন আকর্ষণীয় আয়োজন নেই, অথচ আমাদের মধ্যমানের রেস্তোরাঁ বা চায়নিজ খাবারের দোকানগুলো এর চেয়ে অনেক বেশি ওয়েল ডেকোরেটেড।

          আমার নাতি দিব্যবাবুর পছন্দ ফিস-বার্গার। আর আমাদের চিকেন বা বিফ। সে একমাত্র ম্যাকডোনাল্ডসের ফিসবার্গারই খায়। অন্যত্র আমরা খেতে গেলে হাত তুলে বসে থাকে।

          তবে যত জায়গায় খেয়েছি আমার কাছে জম্পেশ লেগেছে নান্দুস এর মুরগি আর পটেটো ফিঙ্গার। তাই রাকা এবং প্রদীপের সাথে বাইরে গেলে আমার বায়না একটাই নান্দুস।

          মল-এর খাবারের দোকানগুলোতে গোটামুরগি যেভাবে বেক করে তা দেখে খাবারের রুচি তো পরে, তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলেই বাঁচি।

          শপিং মলগুলো এখানে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। শুধু কোল্‌স, আলডি, উলওয়ার্থস এরকম চেইনশপগুলো দিনরাত্তির খোলা থাকে। তখন খুব প্রয়োজন না হলে মানুষ দোকানে যায় না। কারণ তারা ভোরে উঠে কাজে যায়। দুপুরে হালকা খাবার খায়, সন্ধ্যায় ডিনার খেয়ে ঘুমাতে যায় অথবা ব্যক্তিগত কাজ করে। সপ্তাহে পাঁচদিন জীবন তাদের গতির ছন্দে বাঁধা। বাকি দুদিন মাস্তি। খাও-দাও, প্রচুর বেড়ানোর জায়গা আছে, বিচ আছে, ঘুরে বেড়াওহাসো, মাতো, ফুটি খেল অথবা দেখ।

          হ্যাঁ, ফুটি। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট ওরা খেলে, কিন্তু ফুটি শিশু থেকে নারীপুরুষ সবার মাঝে ফুটির জন্য যে মত্ততা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। যেদিন ফাইনাল থাকে সেদিন ট্রামে বাসে উপচে পড়া ভীড়রাস্তায় দলে দলে নারী-পুরুষ-শিশু সমর্থক দলের জার্সি গায়ে, হাতে ফুটি নিয়ে স্টেডিয়ামে যাচ্ছে। ভাগ্যিস সেদিন শহরে গিয়েছিলাম, না হলে বুঝতে পারতাম না মেলবোর্নে এত মানুষ থাকে।

          ফুটির বল ফুটবলের মত গোলাকার নয়। অনেকটা রাগবি খেলার বলের মত। দলে দলে নারীপুরুষ শিশু-প্রবীণ ফুটি দেখতে স্টেডিয়ামে যাচ্ছে। তাদের পোশাকে, চলায় বলায় আনন্দ উপচে পড়ছে। খাবারের অভাব নেই, অভাব নেই স্বাচ্ছন্দ্যের। তাই শৈশব থেকে এরা প্রাণোচ্ছল।

          আর আমরা বেগম রোকেয়া তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ভাল আছি এই কথাটা বলতেও বাঙালির দ্বিধা। বেশি ভাল নেই চেহারা মলিন করে এই কথাটা বলা আমাদের সংস্কৃতি। তারপর প্রশ্নকর্তাকে হয়তো অবান্তরভাবে ভাল না থাকার পাঁচালী শুনিয়ে দিই। অথচ একবারও ভাবি না, এসব সমস্যা যাকে বলছি তারও আছে এরকম হাজারো সমস্যা। এটা শুধু প্রথম সাক্ষাতে ভব্যতার প্রকাশ, ভাব বিনিময় প্রথা।

          এদিক থেকে অজিরা অনেক প্রাণবন্ত। চোখাচোখি হলে হাই-হ্যালো করে। সবাই মিলে ফটো তোলার সমস্যা হলে এগিয়ে এসে নিজেরাই তুলে দেয়।

 

*****

১৭

 

বেশিরভাগ উইকএন্ডে আমাদের দাওয়াত থাকে রাকা-রনিদের বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় প্রচুর খাবার, নানারকম ডেজার্ট সবই আমাদের মেয়েদের হাতে তৈরি কারণ আমরা যে ধরনের খাবার খাই সেগুলোর অনেকগুলোই এখানে দোকানে রেডিমেড পাওয়া যায় না তাছাড়া নিজের হাতে তৈরি খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করার আনন্দই আলাদা          এদের সবারই নিজের বাড়ি, তাই বাড়ির সামনে পেছনে সুন্দর বাগান এসব ফুল, লতা, গাছ সবই আমার জন্য নতুন একমাত্র গোলাপ ছাড়া তবে গোলাপও যেভাবে গাছেই তোড়া সেজে থাকে সেটাও দেখার বিষয়

          ঘুরে ফিরে দেখি, আমি আর সাজু আপা গল্প করি। নবীন, প্রবীণ, শিশু সবাই যার যার দল নিয়ে আনন্দ করে। শিশুদের এখানে সাথীর অভাব হয় না। এসব দেখে মনে হয় বাংলাদেশের শিশুরা ফ্ল্যাটবাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্টের সুদৃশ্য খাঁচায় নিরাপত্তাহীনতার অভাবে এক অদ্ভুত মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠছে। এখন আবার তাতে যোগ হয়েছে মোবাইল, আইপ্যাড আর ট্যাব।

 

*****

১৮

 

অস্ট্রেলিয়া একটি মহাদেশ, তাই এর এক এক অঞ্চলে সময়ের হিসেব ভিন্ন ভিন্ন। আবার গ্রীষ্মে সূর্যের আলো সাশ্রয়ের জন্য দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। মেলবোর্নে ফেব্রুয়ারিতে আমরা যখন গেলাম তখন গ্রীষ্মকাল এবং সূর্য অস্ত যায় রাত নয়টার পরে। ফলে মেলবোর্নের সাথে আমাদের সময় ওদের শীতকালে ব্যবধান চার ঘন্টা আর গ্রীষ্মে পাঁচ ঘন্টা। অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থানের কারণে তাদের যখন গ্রীষ্মকাল, আমাদের তখন শীতকাল। প্রকৃতি ভারসাম্য রক্ষার জন্যই বোধহয় এমনটা করেছে।

 

*****

১৯

 

এখানে ট্রেনে বাসে চড়তে খুব আরাম। সরাসরি হুইলচেয়ারেও ওঠা যায়, কারণ প্লাটফরম আর গাড়ির দরজা একই সমতলে। আর আমাদের দেশে প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেনের পাদানি এত উঁচুতে থাকে যে একটু পা ফসকালে ট্রেনের চাকার নিচে যাওয়াও অসম্ভব নয়। প্রথম এবং শেষ স্টেশন ছাড়া মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে যে কী হুড়োহুড়ি করে উঠতে নামতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

          যানবাহনে ওঠানামার নিয়ম হলো আগে নামবে, তারপর উঠবে। হায়রে নিয়ম! আমাদের ফেনী জেলার রেল স্টেশনে অনেক সময় মেইল ট্রেনগুলো প্ল্যাটফরমের বাইরে চলে যায়। তখন যারা সি অফ করতে আসে তারা আত্মীয় সম্পর্কিত মহিলা যাত্রীদের অনেক সময় কোলে করে ওঠায়। এরকম একটা ঘটনা আমার জীবনেও ঘটেছিল যা মনে পড়লে আজও মনে মনে হেসে উঠি। চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেসে আমরা কজন ফেনী যাচ্ছিলাম। তো যেমন হয়, ফেনীর আগের স্টেশন কালীদহ স্টেশন পার হওয়ার আগেই আমরা তল্পিতল্পা নিয়ে প্রস্তুত। ট্রেন স্টেশনে ইন করার আগেই বেশ কিছু মানুষ ব্যাগবস্তা নিয়ে উঠে ট্রেনের দরজায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নিজেদের লোকজন আর মালপত্র তোলার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে। আমরাও কম যাই না। নোয়াখাইল্যা তো। হাউকাউ করে জায়গা নিয়ে শরীর ব্যাঁকাত্যাড়া করে নানান কসরত করতে করতে নেমে হাঁফ ছাড়লাম। যারা ওঠার তারা উঠল। সব মিলিয়ে কতক্ষণের ব্যাপার! দুই থেকে আড়াই মিনিট! কিন্তু গাড়ি থামবে পাঁচ মিনিট। সুতরাং বাকি আড়াই তিন মিনিট গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকল। মাছিমশাও উঠল না। হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে যাওয়া নির্জন স্টেশনে ট্রেনটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার ভীষণ হাসি পেতে লাগল। আজও মনে পড়লে দৃশ্যটা আমাকে হাসায়

  

*****

২০

 

এই সাপ্তাহিক ছুটিতে আমরা প্রদীপের বাসায় যাবো। বিকেলে সে অফিস থেকে এসেছে। এ সপ্তাহের ছুটিটা আরো দুএকটা ছুটি মিলিয়ে বেশ লম্বাআমরাও যাচ্ছি শহরে ঘুরব, সাউথ মোরাং এর মাঠে ক্যাঙারু আসে সেগুলো দেখব। রাকাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব, চোখ গেল চাঁদের দিকে। আজ পূর্ণিমা তিথি এই তিথিকেই তো বলে রাকা যে জন্যে আমি আমার প্রিয়তম কন্যার নাম রেখেছিলাম রাকা।

          কিন্তু এত্ত বড় চাঁদ! আমাদের বাংলাদেশে আমি এত বড় পূর্ণিমার চাঁদ দেখিনি। চারদিকে অপরূপ জ্যোৎস্না ঝরছে। কিন্তু চারপাশ এত নির্জন যে এত আলো ছড়িয়েও চাঁদটা যেন একটু বিষন্ন। বিশাল গোল চাঁদ, বিরাট আকাশে একাকী নিঃসঙ্গ। এখানে কি কেউ জ্যোৎস্নারাতে বনে যায় না! নাকি চাঁদকে নিয়ে আমরা যত রোমান্টিক, উন্নতদেশের মানুষ ততোটা নয়! কী জানি! এই বিশাল পৃথিবীর কিছুই না জেনে চিরটা দিন এক চাকাতে বাঁধা থেকে বেলাশেষের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।

          পথে যেতে যেতে চাঁদও আমাদের সাথে তার নিয়মে চলতে থাকল। প্রদীপ গাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়েছে। আমি বিমনা, আনমনা হয়ে শুনছি আর তন্ময় হয়ে চাঁদ দেখছি। সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে কি বয়স লাগে? আমার মনে হয় না। সৌন্দর্য চিরন্তন, চিরকালীন। শুনছি রবীন্দ্রসঙ্গীত, আবার একাকী নির্জন চাঁদ দেখে মনে পড়ছে জীবনানন্দকে। এমন নির্জন বিষন্ন জনশূন্য প্রান্তরের চাঁদের বর্ণনা আছে তাঁর কবিতায়।

          বাসায় পৌঁছে ডিনার শেষ করে প্রদীপ বলল, চলো তোমাকে বনে নিয়ে যাই চাঁদ দেখাতেতথাস্তু। আজ জ্যোৎস্নারাতে আমরা যাব বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে

          প্রদীপ ড্রাইভ করছে। আমি আর তার ভগ্নীপতি কথা বলছি। মাঝে মাঝে ভগ্নীপতির নানারকম রসাত্মক বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে সে জঙ্গলের নির্জনতা খান খান করে হা হা হাসছে।

          অবশেষে আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। বন-জঙ্গল সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা এটা ঠিক সেরকম নয়। দুপাশে জঙ্গল, মাঝখানে মসৃণ পাকা রাস্তা শহরের অন্যদিকে চলে গেছে।

          চাঁদের আলো আর গাছের ছায়া কেমন একটা রহস্যময় নির্জনতা তৈরি করেছে। অথচ এই রহস্যময়তায় কোন ভয় তৈরি করছে না। কারণ এখানে সব জায়গায় মানুষ আর প্রাণির জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে।

          প্রদীপ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে রাস্তার একপাশে দাঁড় করাল। গাড়িতে বসেই জঙ্গল এবং চাঁদের আলো উপভোগ করতে হবে। বের হলেই জঙ্গলের ভয়ঙ্কর প্রাণির সামনে পড়ে বিপদ হতে পারে। আর গাড়িও চালাতে হবে সাবধানে। কারণ জঙ্গলের প্রাণিরা এখানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে, সুতরাং তাদের যেন কোন ক্ষতি না হয়। অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষ করে ক্যাঙারুর দাপট বেশি। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হয় একেবারে ড্যামকেয়ারলি। কেয়ারফুল হতে হবে মানুষকে।

          গাড়িতে বসে চাঁদের আলো উপভোগ করছি। কোনদিন কি ভেবেছি এই সৌভাগ্য হবে! কিন্তু হলো। মনে পড়ছে আমার মায়ের খাতায় লেখা গান চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো

     মা মাঝে মাঝে গাইতেন। গানের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা ছিল। তখন তো বই এত সুলভ ছিল না। রেডিও বা গ্রামোফোন রেকর্ডে শুনে হয়তো কপি করেছিলেন। তখন এটাই রীতি ছিল।

          চাঁদের আলো উছলে পড়ছে। কিন্তু রজনীগন্ধা? এদেশে কি রজনীগন্ধা ফোটে? অনেকক্ষণ চন্দ্রালোক উপভোগ করে জঙ্গলের আরো ভিতরের রাস্তা দিয়ে অনেকদূর গিয়ে বুকের মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্যের স্মৃতিটুকু নিয়ে ফিরে চললাম গৃহপানে।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts