Saturday, 1 March 2025

রিফাৎ আরার 'মেলবোর্নে দেশ বিদেশ' - পর্ব ৩৮-৪৪

 



৩৮

 

রনিকে বললাম, রনিবাবা, বোটানিক্যাল গার্ডেনটা আরেকবার ঘুরে দেখতে চাই

          শনিবারের ছুটির দিনে রনি আমাদের নিয়ে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। অন্য যে দিন এসেছিলাম সেদিন স্রাইন অব রিমেম্বারেন্স দেখে গার্ডেনে ঢুকতেই বেলা পড়ে এসেছিল। আজ সকাল সকাল আসাতে রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল বাগানে ঢুকেই মন ভাল হয়ে গেল।

          এখানে ঘাস যেন মখমল পাতা। ইচ্ছে করলেই যে কোন জায়গায় শুয়ে পড়া যায়। অনেককেই দেখলাম রৌদ্রস্নান করছে। এক তন্বী তরুণী উর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস পরেই উপুড় হয়ে গভীর মনযোগে লেখাপড়া করছে। অনভ্যস্ত চোখ আমার সুন্দরী মেয়েটির দিকে বার বার যায়, আর ভাবি মেয়ে, তোমরা কত নিরাপদ। আর আমাদের দেশের মেয়েরা সর্বাঙ্গ ঢেকেও মনুষ্যস্বাপদের নখ-দন্ত থেকে রেহাই পায় না।

          অনেক পরিবার এসেছে যাদের শিশুরা নানারকম খেলায় মেতেছে। খেলার সরঞ্জাম ওরা নিয়েই এসেছে।

          আমি হেঁটে বেড়াই। মেয়ে বারবার সাবধান করে আম্মু, ব্যাকপেইন বাড়বেবাড়ুক। আমি পাত্তা দিই না। এত সুন্দর প্রকৃতি, এতো আলো, উদার আকাশ, প্রাণময় সজীব বৃক্ষ দেখতে গিয়ে ব্যথা বাড়লে আমি সয়ে নেব।

          কত রাস্তা কত দিকে গেছে। কত রকমের গাছ। কিন্তু একটা জিনিসের অভাব বোধ করলাম গাছের গায়ে তার প্রজাতির নাম, বয়স এগুলো লেখা নেইঅথচ একেকটা গাছের গুঁড়ি আর বিশাল ডালপালা ছড়ানো শাখাপ্রশাখা দেখে মনে পড়ল লেখক মোতাহার হোসেন চৌধুরির জীবন ও বৃক্ষ প্রবন্ধের স্মরণীয় উক্তি নিরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের জীবনের সার্থকতার গান শোনায়রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষ কবিতার কথাও মনে এল। সত্যিই তো এই সবুজ সতেজ গাছগুলো না থাকলে এই জায়গাটাওতো নিরস মরুভূমির মতই লাগত।

          কোথাও কোথাও আবার ছোট ছোট লেক। যত দিকে রাস্তা গেছে ততদিক আজকেও পুরোটা দেখা সম্ভব হবে না। হঠাৎ একটা জলাশয়ের সামনে আপাত সমতল জায়গায় দাঁড়িয়ে রনি আঙুল তুলে দেখাল সামনের দিকে। সে জায়গাটা কিছুটা উঁচু কিন্তু সূর্য ডোবার প্রহরে কী যে অপরূপ দেখাচ্ছে ঐ জায়গাটাকে তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। অবাক হয়ে আমরা কিছুক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে দেখলাম মহাপৃথিবীর এক টুকরো সৌন্দর্য যা যুগপৎ প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্টি। কারণ এটি একটি পরিকল্পিত প্রকৃতি-বাগান। এ বাগানে গবেষণার নানা উপাদান সংরক্ষণ ও পরীক্ষাগারও রয়েছে।

          আর নাই যে বেলা নামল ছায়া ধরণীতে হ্যাঁ, বেলা প্রায় শেষ প্রান্তে। তবুও দিনের শেষ প্রহরের আলোয় পথে যেতে যেতে আরো কিছু দেখা যাবে।

          বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পথের মোড় ঘুরতেই নানারকম ক্যাকটাস। ক্যাকটাস যে কতরকম, তা এই প্রথম দেখলাম এবং মনে হলো শেষবারও।

          যেখানেই গিয়েছি রনি আর প্রদীপ অনেক ছবি তুলেছে। কিন্তু স্মৃতির রঙ প্রত্যেকেরই ভিন্ন। এর আগে ফিটজ্‌রয় গার্ডেনে গ্রিনহাউজের মত একটি ঘরে অর্কিড দেখে কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। গঠন সৌষ্টবে, বর্ণিলতায় সেগুলো একের মধ্যে অনন্তকে যেন ধরে রেখেছে। এসব জায়গায় গেলে কেবলই মনে হয় বসে থাকি। আমাদের জীবনের একেকটি পর্বকে আমরা নিরন্তর বয়ে চলা সময়কে ভাগ করে নিজেদের শৃঙ্খলে বেঁধেছি। তাই সময় হয়েছে ঘরে ফেরার।

 

*****

৩৯

 

এই শনিবারে এখানকার একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের বাসায় দাওয়াত। এর আগে অবশ্য রনিদের বন্ধু ডাক্তার আনোয়ার হোসেনের বাসায় দাওয়াত খেয়েছি। ওনাদের সাথে একসাথে বেড়াতেও গিয়েছি। তিনটি ফুটফুটে মেয়ে তাদের। বড়জন নবনী দশ-এগারো বয়স হবে হয়তো, কিন্তু খুব মিশুক, আর ছোটবোনদের বিষয়ে খুবই কেয়ারিং।

          অস্ট্রেলিয়াতে ডাক্তারদের উপার্জন বেশি। কেউ কেউ বলে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি। কিন্তু ডাক্তার ওখানে সবাই হতে পারে না। অনেক বেশী মেধাবী এবং নাইনটি প্লাস স্কোর না করলে মেডিক্যালে ভর্তির চান্স পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ থেকে যারা যায় তারা ওখানে আবার অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলের বিশেষ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে তারপর জি-পি হয়। তারপর কারো ইচ্ছে থাকলে আরো উচ্চতর ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া করে। তবে জিপি হতেইতো পেট্রোল শেষ। কারণ একবারে তা হওয়া কঠিন। আমার ছোট মেয়ে দিঠির বন্ধুরাও দু-একজন ওখানে আছে। কেউ পাশ করে চাকরি করছে, আর কেউ পড়াশোনা করছে।

          আজ যে ডাক্তারের বাসায় যাব তিনি প্রবীণ। তার স্ত্রী যতটুকু বলেছিলেন তাতে মনে আছে তারা প্রথমে নিউজিল্যান্ডে ছিলেন। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় অর্থাৎ মেলবোর্নে স্থায়ী হয়েছেন। রাকাদের কামরুল ভাই (আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক) আমাকে বললেন, আন্টি এতদিন গরীবদের বাসাবাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন। আজ বড়লোকের বাড়ি দেখবেন

          সন্ধ্যায় আমরা গেলাম। বিরাট জায়গা নিয়ে সুবিশাল ডুপ্লেক্স। সামনে পেছনেও অনেক জায়গা। ডাক্তার গৃহিনীকে আগেও দেখেছি। দুই ছেলে তার। একজন বিয়ে করেছে। পুত্রবধু সহসাই মা হবে।

          কিছু কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় তারা এই পৃথিবীর ধুলোমাটির কিছুটা উপরে থাকেন। তাই তাদের চেহারায় কোন মালিন্য থাকে না। মধ্যবয়সী এই ভদ্রমহিলাটিকে যখনই দেখেছি প্রশান্ত মুখ, হাসিখুশি আর সর্বঅবয়বে সুখি সুখি ভাব। তার বেয়ান এবং বেয়ানের পুত্রবধুও এসেছে। ননদ-ভাবী কাজ করছে। বেয়ানও মাঝে মাঝে সামাল দিচ্ছে। অ্যাডভান্স স্টেজ-এর হবু মাও কিচেন সামলাচ্ছে। এরা এদেশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কারণে শরীরে মনে অনেক বেশি শক্ত। আর এ রকম বৈবাহিক সম্পর্ক দাম্পত্যের মানসিক সাম্যের জন্যেও ভাল। কারণ এখানেই দু-একটি আলোচনায় শুনেছি বা আগেও বন্ধুদের পুত্র-কন্যাদের দেখেছি বিদেশে বড় হয়ে দেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর সমস্যা হয়।

          ভাল লাগল। যেখানেই যাই নতুন দু-চারজনের সাথে আলাপ হয়, আর পুরানোরাতো আছেই। এদের সামাজিক সম্পর্কে শিশু বেশি হওয়াতে টিনএজারদের তেমন দেখলাম না। স্বভাবতই শিশু আর বড়দের আড্ডায় তারা আসতে চায় না। অনেকে এভাবে একাকী হয়ে নিজের ও পরিবারের জন্য নানা সমস্যা তৈরি করে। বয়ঃসন্ধিকাল এমনিতেই জটিল সময়।

         

*****

৪০

 

দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় এগিয়ে আসছে। তাই কন্যাসম কন্যারা এটা সেটা স্মৃতির সুগন্ধি রুমালের মত হাতে তুলে দিচ্ছে। হায় এত ভালবাসা কি হাতের মুঠোয় ধরা যায় এসব রইল আমার প্রাণে। তন্বী, মেঘলা, জ্যোতি, এনথিয়া, রুমকি, ফওজিয়া, নবনীর মা, নায়লার মা, লুনা সবাই যেন আমার রাকামণির মত। ওরাও বন্ধুদের মা-কে পেলে কিছুটা হলেও হয়তো মায়ের সুবাসটুকু পায়। আমিও আন্তরিক আলিঙ্গনে ভাললাগা ভালবাসার স্পর্শটুকু জানিয়ে দিতে চাই। মনে মনে বলি তোমরা ভাল থেকো, সুখে থেকো।

 

*****

৪১

 

যাবার সময় হল বিহঙ্গের। সত্যি সত্যিই সময় এগিয়ে আসছে। যা কিছু টুকটাক কেনাকাটা করেছি সেগুলো বাঁধা ছাঁদা হচ্ছে। পূর্বার মন খারাপ। আর আমার কন্যারতো যতই চাপুক চোখের জল চোখ ছাপিয়ে যখন তখন ঝরছে

          এমন সময় একদিন রনি বলল, অস্ট্রেলিয়াতে এসে বারবিকিউ না করে আম্মারা চলে যাবেন তা কী করে হয়?

          অস্ট্রেলিয়ায় বারবিকিউ ভীষণ জনপ্রিয়। প্রত্যেক পার্কেই বারবিকিউর চুলা, গ্যাসলাইন সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। রনি নিজেও একটা কিনেছে। কিন্তু যেহেতু মেলবোর্নের গ্রেট ওশ্যান রোডে আমাদের যাওয়া হয়নি, তাই সাব্যস্ত হল গ্রেট ওশ্যান রোড পর্যন্ত দূরত্বের কারণে যাওয়া না গেলেও ঐ পথে লর্‌ন বিচে যাওয়া যায়।

          সুতরাং সাব্যস্ত হল ফেরদৌস-তন্বী, রাকা-রনি, সাকি-রুমকি, লুনা-মেহেদি এই চার পরিবার যাবে। বারবিকিউতে ছেলেদের কাজ একটু বেশি। মেয়েরা সেদিন খায়-দায়, আড্ডা দেয়। আর খাবার হচ্ছে সাধারণত প্রসেসড মাটন, বিফ, চিকেন। শুধু চুলা জ্বালিয়ে ঝলসে নাও, আর গরম গরম খাও। সাথে নানা পদ মেশানো সালাদ।

          একটু সকাল সকালই রওনা দিলাম আমরা। অনেক দূরের পথ। গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার দূরত্বও কমপক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রামের সমান। যদিও মসৃণ রাস্তার কারণে সেটা গায়ে লাগে না।

          আরামের যাতায়াত। দুপাশে সুন্দর প্রকৃতি। কখনও সমতল, কোথাও পাহাড়-জঙ্গল। তবে রাস্তা পাহাড় কেটে করাতে পাকদন্ডীর মত কিছুটা ঘুরে ঘুরে গেছে। তাই বাঁক ঘুরতে চালককে সাবধানে থাকতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলে নির্ঘাত দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। তবে সেটা হয় না। প্রত্যেক পথের বাঁকেই সতর্ক সংকেত দেয়া আছে।

          বেশ অনেকটা যাওয়ার পর শুরু হল একপাশে সমুদ্র, অন্যপাশে পাহাড়। পাহাড়ে প্রচুর গাছপালামাটিধ্বসের বিপদাশঙ্কায় পাহাড়ের ঢাল লোহার কঠিন জালে বাঁধা।

          পথে দুএকটা মফস্বল শহরের মত শহরও দেখলাম। পাহাড় আর সমতল মিলিয়ে শহর। আর সমুদ্রে ভাসমান ইয়ট নিয়ে ঘুরছে সমুদ্র-বিলাসীরা।

          একটা জায়গায় এসে আমরা থামলাম। লর্‌ন থেকে কিছুটা আগে। এ জায়গাটার নাম অ্যাঙ্গেল-সি। শান্ত জল, বাতাসে একটু ঝিরিঝিরি কাঁপছে। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে অ্যাঙ্গেল সির পানিতে রূপালী আলোর নাচ। মনে পড়ল আমাদের বাড়ির পুকুরের টলটলে জল একবার ইচ্ছে হল ঝাঁপ দিই রবীন্দ্রনাথের ছেলেটা কবিতার ছেলেটার মত দেখি না কী আছে ওখানে।

          আম্মু আসেন। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে লর্‌ন-এ পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে

          মুহূর্তের অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ত্রস্ত পায়ে এসে গাড়িতে উঠলাম।

          এবার দেখছি একপাশে নীল সমুদ্র। অন্যপাশে পাহাড়ে খুব সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। রনি বলল, এখানে সাধারণ অত্যন্ত ধনীরা বাস করে। আবার কেউ কেউ নিজেরা যখন থাকে না, তখন পর্যটকদের ভাড়া দেয়।

          সুরম্য অট্টালিকা, খোলা বারান্দা, বসলেই সমুদ্র সৈকত আর অপার নীল জলরাশিউপরে আকাশের নীল সামিয়ানা আর পুঞ্জ মেঘের ভেসে বেড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে মন গুনগুনিয়ে ওঠে কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ...। হায় খোদা, গলায় একটু সুর দিলে না যে মন খুলে গাইব।

          আমাদের দলের সবাই কিছু আগে পরে এসে পৌঁছালাম মহাসাগরের বালুকাবেলায়। সবুজ ঘাসে ঢাকা বেলাভূমি আবার মাঝে মাঝে বালুকারাশি। ঘন ঝোপে ঘেরা সমুদ্রের একপাশ। সেখানে মাঝে মাঝে বসার জন্য হেলানো বেঞ্চি। তারপরই ওয়াকওয়ে। একদিক একবারে খালি। সেখানে সমুদ্রে নামার সৈকত। এই সমুদ্রের পরে কী আছে? আমি জানি না। যারা দুঃসাহসী কেবলমাত্র তারাই জানতে পারে, জানার জন্য জীবন দেয়, মানুষকে জানিয়ে যায়। এভাবে সভ্যতার স্তরে স্তরে মানুষের জানার পরিধি বাড়ে।

          আমরা বাঙালি দুধে-ভাতে সুখেই ছিলাম। তাই কবিও বলেছেন, ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশএখন আর তেমন দিন নেই। দিন বদলের পালায়। ঔপনিবেশিক শাসনে-অত্যাচারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের সন্তানেরা ঘর বন্ধক রেখে শ্রম বিক্রি করতে দেশান্তরে যায়। সাগর মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারায়। তবুও প্রাণ হাতে নিয়ে পরের দল এগিয়ে যায়।

          এই মহাসাগর (গ্রেট ওশ্যান) পানি নিয়ে খেলছে শান্ত লয়ে। বাংলাদেশের পতেঙ্গা বা কক্সবাজারে যে দুরন্ত ঢেউ এখানে তেমন। মহাসমুদ্র মানে তো বিরাট বিশালত্বের ব্যাপার তাই কি সে নিজের উচ্ছ্বাসকে নিজের ভিতরে ধরে রাখতে চায়?

          আমি আর সাজু আপা গল্প করছি। শামসুল আলম ভাই আর সিরাজুল ইসলাম সাহেবও হাত ধরাধরি করে ঘুরছেন, দেখছেন। শিশুরা বালি নিয়ে খেলছে। পূর্বা, মেহরিন এই দলে একটু বড় তবু তাদের বন্ধু তানিশা। দিব্য, তাসিন, সারিক আর সোফি একটা খেলার জায়গায় ব্যারিকেড ডিঙিয়ে খেলছে। আমাদের কন্যারা রুমকী, রাকা, তন্বী, লুনা গল্প করছে। আজ তাদের আপ্যায়নের ভাবনা নেই।

          ছেলেরা বারবিকিউ চুলা পরিষ্কার করে তাতে খাবার ঝলসানো শুরু করে দিয়েছে। সাজু আপার কনিষ্ঠ পুত্র বাবন সালাদ কাটছে। রান্না হতে হতেই চুলোর উপর থেকে নিয়ে খাচ্ছে সবাই। ইয়ামি -ইয়াম্মি।

          বাচ্চাদেরও জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। তাদের মন খেলায়। বেশ কিছু হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া খাবারের গন্ধে ঘুরে ফিরে আসছে। একটাতো একটু আদর আহ্লাদ করতেই বাবনের কাঁধে চড়ে বসল, তারপর আর যেতে চায় না।

          মজা করেই খেলাম। রান্নার খুন্তি ধরে ছবিও তুললাম। তবে সালাদপাতা আর সালাদড্রেসিং দিয়ে বানানো বাবনের সেদিনের সালাদের স্বাদটা চিরদিনের জন্য আমার মুখে লেগে থাকবে।

          খাওয়ার পর সবাই মিলে বিচে ঘোরাফেরা, ছবি তোলা হল। সার্ফাররা নামতে শুরু করেছে। এখানে সাগর এবং সৈকত এত নিরাপদ যে রোদ পড়ে আসতে শুরু করে সার্ফাররা সাগরে নামে।

          মহাসিন্ধু পারে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্ষুদ্রতম আমি হৃদয়ের একান্ত অর্ঘ্য নিবেদন করলাম। আর কোনদিন দেখা হবে না। ফেরার সময় দেখলাম সন্ধার পরেও সমুদ্রে জলকেলি করে বেড়াচ্ছে কিছু মানুষ। জীবন আমাদের প্রতি পদে দিল শঙ্কা-অনিশ্চয়তা, আর ওদের এত বরাভয়।

          রনি বলল, পাহারা আছে। বিপদ হলেই উদ্ধার করবে

          যত শঙ্কাই থাক, তবু সসীম জীবন সীমাহীন বেঁচে থাকার আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে যায়। আমাদের দেশের ষোল কোটি মানুষও তাই ভয়কে জয় করে এগিয়ে যায়।

          ফেরার পথে একটা বাঁকে একটা রাস্তা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। রনি বলল, এটা লাইট হাউজে যাওয়ার পথ

          নিরব নির্জন। দুএকটা গাড়ি হঠাৎ হুসহাস পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। একুশ শতকের অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তির যুগে লাইটহাউজের উপযোগিতা আর নেই। তবু অতীতের স্মৃতি হিসেবে এটি মূল্যবান নিদর্শন। মানুষের ক্রমোন্নতির সাক্ষী। গাড়ি রেখে আমরা নামলাম। রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠতে হয়। নাবিকদের দিকচিহ্ন প্রদর্শক বিশাল উঁচু লাইটহাউজটি দেখে গোধূলি সন্ধ্যায় মনটা কেমন যেন কোন সুদূরের পিয়াসী হয়ে উঠল। প্রকৃতি আমাদের উৎফুল্ল করে আবার বিষন্নও করে। ধূপছায়া সেই সন্ধ্যায় হয়তো প্রিয়জনদের সাথে আসন্ন বিচ্ছেদ ব্যথায় আমি আমার পূর্বা-দিব্যকে জড়িয়ে ধরলাম।

 

*****

৪২

 

প্রদীপ ফিরে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার কনফারেন্স শেষ করে। মাঝে মাঝে এসে আমাদের সামান গুছিয়ে দেয়। এটা-সেটা টুকিটাকি জিনিস যেগুলোর মূল্য স্যুভেনির হিসেবে সেগুলো কোনটা কোথায় রাখলে ভাল থাকবে এসব দেখে শুনে রাখছে। রাকা-রনিও সাথে আছে। পূর্বার ভীষণ মন খারাপ নানু কেন চলে যাবে।

          আবার আমি দোটানায়। একদিকে ছেড়ে যাবার কষ্ট, অন্যদিকে অথৈর কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দ। আর ছোট্ট কল্প যাকে রেখে এসেছি সে এখন হাত-পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করে। স্কাইপে দেখেই বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। আর রাকা তার দুচোখে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছেই।

          হায় খোদা, পৃথিবীতে এ মায়ার মিলনে বাঁধন যেমন আনন্দের, বিচ্ছেদ তেমনি কষ্টের। সন্তানের মত প্রিয় আর কোন কিছু কি পৃথিবীতে আছে!

          এর মাঝেই জেরিনদের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। গেলাম মহুয়া আর জীবনের বাসায়। ওদের পুত্র আধৃত একেবারেই শিশু, কিন্তু হাসিটা উত্তমকুমারের মত মন-কাড়ানিয়া।

          সুনীল, শীর্ষেন্দুর গল্প-উপন্যাসে প্রবাসী সমাজের কথা পড়েছি। পড়েছি জাহানারা ইমাম, সাম্প্রতিক রেজাউর রহমান ও অন্যদের লেখায়। আর ভ্রমণ কাহিনি সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, ডাক্তার বরেন চক্রবর্তী এরকম অনেকের লেখা আরো টুকিটাকি যেখানে যা পেয়েছি। প্রদীপের প্রথম দেখা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে, ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন এছাড়াও সাময়িকপত্রে যখন যা চোখে পড়েছে পড়েছি। কিন্তু মেলবোর্নে এসে তিন মাস থেকেও আমি কিছুই লিখতে পারিনি। তবে আমি দেখেছি আমাদের বাংলাদেশের একদল উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে, তাদের পরিবার ও শিশুদের। ওরা এখানে ভাল আছে, মিলেমিশে আছে। হয়তো অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য পদমর্যাদায় সমান হওয়ার কারণে অসুস্থ কোন প্রতিযোগিতা চোখে পড়েনি এবং এটা মনে হয়েছে ওদের সবচেয়ে পজিটিভ দিক। বাংলাদেশকেও তারা ভোলেনি। দেশের বিভিন্ন ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন থাকে।

 

*****

৪৩

 

অনেকেই দেখা করতে আসছে সাথে এটা-সেটা গিফ্‌ট। মেয়েগুলোর জন্য মায়া লাগে। হয়তো দেশে নিজের ফেলে আসা মায়ের কথা মনে করে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। যাদের সাথে বেশি ওঠা-বসা ছিল সেই তন্বী আর মেঘলাতো কেঁদেই অস্থির। আমার জন্য ওদের এ ভালবাসা আমিও বুকের ভেতর স্মৃতির সুগন্ধি রুমালের মত বয়ে বেড়াব আর যে কটা দিন বাঁচি।

          শিশুদের জন্যও মায়া হচ্ছে। তাসিন, তানিশা, মেহরীন, সারিক, ফিওনা, সোফি আর মেঘলার মেয়ে জায়না এরা সবাই এখন আমার নাতি-নাতনি। এদের সবাইকে আবার কি দেখব? আর কি হে হবে দেখা? দেখা না হোক, প্রবাসী কবি তার নদী কপোতাক্ষের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। আমি তার মত মনে মনে এদেরকে বলি যদি দেখা নাও হয় তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের জন্য ভালবাসা।

          সাজু আপার মন খারাপ আমি চলে গেলে তিনি একা হয়ে যাবেন, বেড়াতে গেলে ভাল লাগবে না। মেঘলা আর তন্বী তো দেখা করতে এসে কেঁদেই সারা। আমাদের মেয়েরা এত মায়াবতী কেন? মাত্র কটা দিনের মেলামেশায় এরা এমন মায়ার জালে জড়িয়ে নিল। মেঘলার মেয়ে জায়না অপরূপ সুন্দর একটি শিশু। একবার মাকে দেখে, একবার আমাকে দেখে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করি।

 

*****

৪৪

 

মে মাসের ২২ তারিখ দুপুর দুটোয় আমাদের ফ্লাইট। বাঁধাছাঁদা শেষ। রনি কয়েকবার ওজন নিয়ে দেখল। প্রদীপ কাল থেকে আমাদের সাথে আছে। ভাল লাগছে না কিছুই। বাসার বাগানে হাঁটি। থোকা থোকা গোলাপ, লিলি, আরো নানা জাতের ফুলগুলিকে ছুঁয়ে দিই। সবজির গাছ দেখি, আকাশের দিকে তাকাই। সীমাহীন নীলের সমুদ্রে পালতোলা মেঘের নৌকা। শৈশব-কৈশোরে এ দৃশ্য মনে কত যে কল্পনার রঙিন স্বপ্ন বুনে দিত। আজ আর তা হয় না। এখন শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করি, উড়ে যাওয়ার বাসনা ডানা মেলে না।

          আকাশকে বলি বিদায়। মেঘকে বলি এসো তুমি বাংলার বুকে। তোমার ভ্রমণে তো পাসপোর্ট লাগে না। এভাবে শকুন্তলার মত মনে মনে আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিই। হুমায়ূন আজাদের মত কবিত্ব শক্তি থাকলে বলতাম, ভাল থেকো ফুল ...

          আজ দুপুরে আমাদের ফ্লাইট। রাকার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। তার বাবা নরম মনের মানুষ। কাঁদছে, দোয়া করছেন। রনি স্থিতধী। তার মনের ভাব সহজে প্রকাশ করে না। আর প্রদীপ সে তো জমাটবাঁধা নির্ঝরের পাষাণপাথর, ঘুম ভাঙলে ফল্গুধারা বইবে, কিন্তু ঝর্ণাধারা দৃশ্যমান হবে না।

          এয়ারপোর্টে বিদায় নিতে গিয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ি। একে একে আলিঙ্গনে, আদরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমিগ্রেশন এরিয়াতে ঢুকে যাই। বুকের কাছটায় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

          আবার সেই মেলবোর্ন-কুয়ালালামপুর-ঢাকা। বাংলাদেশে পৌঁছাবো মধ্যরাতে।

          এবার আস্তে আস্তে মন ঘুরছে দেশের দিকে। সারা আকাশ পাড়ি দিতে দিতে আবারও অস্ট্রেলিয়া-মেলবোর্ন-বাংলাদেশ। কত স্মৃতি, বিদেশের সম্পদ ঐশ্বর্য্য, দেশের সমস্যা ভাবতে ভাবতে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্লেন ঘোষণা দিল আমরা এখন বাংলাদেশের আকাশসীমায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ড করব, সবাই সিটবেল্ট বেঁধে নিন।

          রাতের ঢাকায় বাতি জ্বলছে। কিন্তু তার উজ্জ্বলতা উর্ধ্বমুখী নয়। কোথাও অন্ধকার। মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের পানশীরের আবদুর রহমানের। আফগানিস্তানের ঊষর মরুতে যেখানে গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম আর শীতে বরফ ঢাকা পাহাড়, দারিদ্র্য আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কষ্টকর বেঁচে থাকা তবু তার চোখে পানশীর হচ্ছে পৃথিবীর সেরা। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো সে এখানে ইনহাস্ত ওয়াতানাম।

          আমিও মনে মনে বললাম ইনহাস্ত ওয়াতানাম। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো এখানে আমার বাংলাদেশে।

_______


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts