৬
রডোডেনড্রন
বাগান
আগের মত পাহাড়ি পথ। দুপাশে তাকালে বড় বড় গাছ আর ঝোপ। এখানকার ঝোপগুলো খুব সুন্দর।
বেশিরভাগ গোলাকৃতি ধরনের পাতা। আর
পাতাগুলো ভারী – অনেকটা আমাদের দেশের পাথরকুচির মতো দেখতে। মনে হয় মুখে দিয়ে চিবুলেই রস বেরোবে। তাতে ছোট ছোট ফুল, গুটি
গুটি গোলাপী মিষ্টি রঙের ফল।
আবহাওয়ায় আর্দ্রতা কম বলে ধুলোবালিও তেমন নেই। আমাদের দেশেতো এখন বর্ষাকাল ছাড়া গাছের সবুজ পাতা দেখাই মুশকিল। দেশের আনাচে কানাচে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সড়কপথ প্রশস্ত
হয়েছে এবং ছালওঠা সেসব সড়কের কল্যাণে গ্রামের পথেও সবুজ পাতা এক দুর্লভ বস্তু। প্রকৃতি আমাদের প্রচুর নদী জলাশয় আর শ্যামলিমা দান করেছিল। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে আর ভূমিদস্যুদের রাক্ষুসে ক্ষুধার
ভোজের আয়োজনে আমরা সব হারাতে বসেছি। আর এরা
পাহাড়কে রেখেই বাড়িঘর তুলছে, বসবাস
করছে প্রকৃতিকে সযত্নে সংরক্ষণ করে।
পথে যেতে যেতেই মনে পড়ল ছোটবেলায় চট্টগ্রাম যেতে আসতে
রেলগাড়িতে উঠলে ব্যাকুল হয়ে থাকতাম পাহাড় দেখতে। পাহাড়ের সৌন্দর্য দূরশৈশবে মনে কল্পনার মুগ্ধ আবেশ তৈরি করত। মনে হত – ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। আর আজ! পাহাড় কেটে-খুবলে সেখানে
ঘটে চলেছে শিল্পায়ন যা দেখতে মাটির কোমল বুকে দগদগে ঘায়ের মতো মনে হয়। অথচ যত অপছন্দই করি ব্রিটিশরা সেই উনবিংশ এবং বিংশ
শতাব্দীর শুরুতে পাহাড়ের উপর বাংলো তৈরি করেছে, কিন্তু পাহাড় কাটেনি।
চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ থেকে আরম্ভ করে যে পাহাড় একসময় দৃষ্টিতে স্বপ্ন বুনতো, আবাসনের নামে তা আজ উধাও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত চট্টলার কর্ণফুলি নদীর পাশ দিয়ে পতেঙ্গা
বিমানবন্দর পর্যন্ত যে রাস্তা ছিল সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় অপর পারের পাহাড়, দূরে নদী আর সাগরের সঙ্গমস্থল দুচোখে মায়া-অঞ্জন বুলিয়ে
দিত। শিল্পায়নের দৌরাত্ন্যে আজ সেগুলো দেয়ালের
আড়ালে চাপা পড়েছে।
ফিরে এলাম বর্তমানে। মনরে
তুই এত ঈর্ষাকাতর কেন? সবসময় শুধু নিজের কথা ভাবিস। এখানে কতকিছু দেখার আছে সেসব দ্যাখ।
মসৃণ পাহাড়ি রাস্তা দিতে আমরা
চড়াই উৎরাই করে রডোডেনড্রন বাগানে এলাম। রাকা, তন্বী, রনি, ফেরদৌস সবাই হতাশ। কিছুদিন
আগেও সামারে এসে এ বাগানে তারা যে ফুলের শোভা এবং সমারোহ দেখেছে এখন তার কিছুই নেই।
কিছু নেই! নিবিড় জঙ্গলতো আছে। বাগানের মাঝে পিচঢালা পাকা রাস্তা। গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসের গালিচা, পাতার
ফাঁকে আলোর ঝিলিমিলি। মাটির বুকে আলো-ছায়ার মিষ্টি
লুকোচুরি। হঠাৎ কিছুটা দূরে বৃক্ষপতনের শব্দ হল। আমাদের প্রবাসীরা জানালো গাছ কাটা হচ্ছে। যে গাছ বৃদ্ধ হয়ে গেছে অথবা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তাকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
এখানেই আমরা গাছের ছায়ায় মাটিতে মাদুর বিছিয়ে আর উদ্যানের
বেঞ্চে এবং কাঠের টেবিলে বসে দুপুরের খাওয়া সারলাম। খাওয়ার সাথে যে বিষয়টি অনিবার্যভাবে আসে সেটি হচ্ছে বর্জ্য ত্যাগ। এরকম বনে এলে আমাদের দেশে গাছের আড়াল বা ঝোপের আড়াল ছাড়া
গত্যন্তর নেই। কিন্তু এখানে সবকিছুর সুবন্দোবস্ত আছে। অতএব, মনের
সুখে খাও দাও ফুর্তি করো।
নানারকম গাছ। তবে রডোডেনড্রনই বেশি। প্রকৃতির সবুজ, আকাশের নীল প্রাণকে সতেজ করে
নিমেষেই। আমাদের নাতি-নাতনী দিব্য-পূর্বা, তাসিন-তানিশা দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে, খেলা করছে। এরা উইকএন্ডে নিয়মিত বেড়াতে যায়। কখনও আউটিং, কখনও
এখানকার বন্ধুসমাজে বিভিন্ন বাঙালি বাড়িতে।
বাচ্চারা বেশিরভাগ বাংলা বলে। কারণ
তাদের বাবা-মায়েরা ভাষার ব্যাপারে ও সংস্কৃতির বিষয়ে খুব স্পর্শকাতর। যত দূরেই যাক নিজের পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারের ধারা তারা
প্রবহমান নদীর ধারার মত সাথে নিতে চায়। ধরে
রাখতে চায় নিজেদের স্বকীয়তা। কিন্তু
শিশুরাতো শিশু। তারা স্কুলে বন্ধুদের সাথে এবং বাইরের জগতে
সর্বত্রই ইংরেজি পড়ে-শুনে শিখে অভ্যস্ত। তাই
বড়দের আড়ালে শিশুরা ইংরেজি বোলচালেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
দেশে চার বছর বয়সী নাতনী অথৈকে রেখে এসেছি। সে একরকম আমার বুকেই বড় হয়েছে। এসব আনন্দে তার নানা আর আমার তার কথাই শুধু মনে পড়ে। নানাভাই বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। কারণ
ঢাকা শহরের এগারো তলার যে ফ্ল্যাটবাড়িতে আমরা থাকি সেটি মূলত খাঁচার সমতুল্য। তার বাবা-মা চিকিৎসক, তাদের ব্যস্ততা বেশি। আমাদের
পক্ষেও এই যানজটে তাকে নিয়ে কোথাও যাবার উপায় থাকে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নগরশিশুই এভাবে বড় হচ্ছে। কিন্তু এখানে শিশুরা প্রাণচঞ্চল এবং নিরাপদ।
একটাই কষ্ট – এত সুন্দর জায়গা অথচ আমার হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ নেই। আর আমি হাঁটতে চাইলে মেয়ে ধমক দিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এখনতো ওরাই আমার অভিভাবক। যা বলে তাই শুনতে হয়।
*****
৭
প্রযুক্তির কল্যাণে
ইন্টারনেট, ওয়াইফাই, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, স্কাইপ – ‘দূরকে নিকট করিবার’ কত যে সুবন্দোবস্ত। এত কিছুর পরও দেশের খবরের জন্য
মন পড়ে থাকে। সেজন্য বাঙালির ঘরে ঘরে দেশের টিভি চ্যানেলের
লাইন। বাইরে না গেলে টিভি খুলে দেশের সংবাদ
শুনি-দেখি। আমাদের ভাল খবর খুব কম। আজকে টিভি খুলতেই সময় টিভিতে জানলাম চিত্রশিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠু গাছ চাপা
পড়ে মারা গেছেন। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে
এল। হায় এত বড় সর্বনাশ। একের পর এক দুর্ঘটনায় আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলব?
মনে পড়ল আলমগীর কবির, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের কথা। ২০১১ সালে তারেক মাসুদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু সংবাদে হাউমাউ
করে কেঁদেছিলাম। দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে অগণিত মানুষ
মারা যায়। তাদের মধ্যে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ যেমন থাকে, তেমনি থাকে শিক্ষক, ডাক্তার ও বিভিন্ন পেশাজীবী যাদের অবদানে জাতি সমৃদ্ধ হতে পারত।
আজও কাঁদলাম। কেন যেন
মানুষটাকে ভাল লাগত। তাঁর শান্ত-সৌম্য মুখশ্রী। শিল্পী কনকচাঁপা ও পুত্র-কন্যা আর্য-শিরোপাকে নিয়ে ভালবাসা
নিবিড় একটি পরিবার ছিল। কনকচাঁপাকে দেখলাম গভীর শোকেও
শান্ত-স্থিতধী। ক্যাথারিন মাসুদকেও এমন দেখেছিলাম। মনে হল এজন্যেই কেউ সাধারণ কেউ অসাধারণ। অন্তরে অন্তরে শোক-সমবেদনা ছাড়া আর কি করার আছে। চকিতে মনে পড়ল, সেদিন
রডোডেনড্রন বাগানে পড়ো পড়ো গাছটি খুব সাবধানে কাটা হচ্ছিল যাতে অন্য গাছেরও ক্ষতি
না হয়। আর আমাদের ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার রাস্তার
পাশের মাটি আলগা এ গাছটি সামান্য কালবৈশাখী ঝড়ে উপড়ে পড়ল! এসব কিছু তত্ত্বাবধানের
ও সংরক্ষণের দায়িত্বতো সিটি কর্পোরেশনের।
দেখভালেরও লোক আছে। সে বেতনও খায়। কিন্তু দেখে কি? আর কতদিন এভাবে চলবে – আরো কতদিন? সড়কপথে, নৌপথে প্রতিদিন অগণিত মৃত্যুর মিছিল আমাদেরকেও দয়ামায়াহীন
করে দিচ্ছে। আমরা তাই দেখি আর ভুলে যাই। কখনও কখনও দেখতে দেখতে খাই, ঘুমিয়ে পড়ি। কারণ আমরা অসহায়। কখনও শক্তির কাছে, কখনও
অস্ত্রের কাছে, কখনও লোভ ও দুষ্টবুদ্ধির কাছে, খলমানুষদের খলচরিত্রের কাছে।
‘রোম যখন
পুড়ছিল সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’ – এই ট্রান্সলেশন বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থী
জীবনে একবার হলেও পড়েছে। এখন মনে হয় একা নিরোই শুধু দোষী? দেশে এত অনাচার দেখেও আমরা ‘খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে
ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি’ এবং
আনন্দে বাঁশিও বাজাচ্ছি।
*****
৮
আজ বেশ ঠান্ডা। আকাশও মেঘলা। আজকে
আমরা যাব ফিলিপ আইল্যান্ড চকলেট ফ্যাক্টরি এবং ফিলিপ আইল্যান্ড বিচ দেখতে। প্রস্তুত হতে গিয়ে আমার ছাত্রী ডাক্তার নাসরিন সুলতানার
দেয়া শালটা হাতে নিলাম। মেলবোর্নে আসার আগে ২০১৬-র
বইমেলায় প্রকাশিত কয়েকটি নতুন বই এবং এ শালটা সে আমাকে উপহার দিয়েছে। শালটা এই দূরদেশে আমার গায়ে জড়াবে তার ভালবাসা হয়ে হয়তো এই
ছিল তার প্রত্যাশা। কারণ আমার এই ছাত্রীটি খুব চাপা স্বভাবের। ভালবাসে কিন্তু দিতে হলে আসা-যাওয়ার পথে বাসার সিকিউরিটি
গার্ডদের কাছে দিয়ে যায়। ওরাই পৌঁছে দেয়। ছেলে-মেয়েদের এই ভালবাসা আমার উপরি পাওনা।
শালটা নেড়েচেড়ে দেখে গায়ে
জড়ালাম আর মনে মনে বললাম, নাসরিন
তোমার ভালবাসা আমি মনের গভীরেও জড়িয়ে নিলাম। এই
ভালবাসাই আমার জীবনের সঞ্চয়, বাঁচার
প্রেরণা।
আজকেও আমরা অনেকে যাচ্ছি – ফেরদৌস-তন্বী,
লুনা-মেহেদী এবং মেলবোর্নের প্রবাসী চিকিৎসক ডাক্তার আনোয়ারের পরিবার। শহর পেরিয়ে যেতে যেতে চোখ পড়ে সাজানো বাড়িঘর, বিশাল তৃণভূমি এবং সেখানে বিচরণরত ভেড়া-গরু আবার ঘোড়ার দল। সকল প্রাণীই স্বাধীনভাবে চরে বেড়াচ্ছে। যদিও সত্যিকার অর্থে তারা স্বাধীন নয়। প্রাণীগুলোর হৃষ্টপুষ্ট নধর শরীরে যত্নের ছাপ। অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানি আয়ের একটি বড় উৎস গরুর দুধ, দুগ্ধজাত পণ্য এবং পশুর মাংস। তারপরও
পশু বা প্রাণীর প্রতি তারা সংবেদনশীল।
দেখতে দেখতে যাই। আমাকে পাগল করে দুপাশের গাছপালা আর উঁচু-নিচু মসৃণ রাস্তা। রাস্তা যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে না এলে জানতেও পারতাম
না। এরা রাস্তা বানায় পরিকল্পনা করে। একটা রাস্তা কতদিন টিকবে, কতটুকু ভারসহ হবে সবকিছু মাথায় রেখে। আর
নির্মাণ কাজ করে সাধারণত রাতে। দিনে
যদি করেও সেটা যাতায়াতের রাস্তার পাশে সম্প্রসারণের কাজ। আমাদের মত যখন তখন ‘জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটার জন্য দুঃখিত’ নোটিশ দিয়ে চলাচল অচল করে না। তারপর রাস্তা ঠিক করার পর শুরু হয় ওয়াসা, গ্যাস লাইন আর স্যুয়ারেজ লাইনের খোঁড়াখুড়ি। এসব কাজ আবার শুরু হয় বর্ষা শুরুর মৌসুমে। এমনই পাকাপোক্ত কাজ বৃষ্টিজলে ধুয়ে গর্তগুলো মুখ ব্যাদান
করে যথা পূর্বং তথা পরং। আবার বাজার চলতি গুজব আছে
ঈদ-পার্বণের আগে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকৌশলী আর ঠিকাদাররা উপরি পাওনার জন্য কাজে নামে। যেমন পুলিশ নামে মার্কেটে-শপিং মলে ভারতীয় চোরাই কাপড়
উদ্ধার করতে। জনগণও এসব ঘটনায় তাদের টু পাইস ইনকামের ঘটনা
নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে। অথচ এখানে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ
নেই। নির্দেশনা দেয়া আছে কোথায় কত কিলোমিটার বেগে
চলবে। গতিবেগ অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র
চালককে সতর্ক করবে। পরবর্তীতে জরিমানা। অতএব, গাঁটের কড়ি গচ্চা দেয়ার চাইতে আইন মেনে চলাই
ভাল। আর আইন মেনে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়াতে
এটাই সিস্টেম হয়ে গেছে। ছোট ছোট শিশুরাও এভাবে দেখতে
দেখতে শিখে বড় হয় এবং এই ডিসিপ্লিন তাদের করোটিতে ঢুকে যায়।
ফিলিপ আইল্যান্ড চকলেট
ফ্যাক্টরি বিশাল। তাদের দাবি পৃথিবীর বড় চকলেট ফ্যাক্টরির
মধ্যে এটি একটি। এখানে টিকেটও দেয়া হয় চকলেট। ডলার দিলে কাউন্টারের কর্মীরা চকলেট দেয় এবং এটাকে কুপন
হিসেবে দেখিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। তারপর
খাও মজা করে। ফ্যাক্টরিটা সত্যিই দেখার মতো। কী নেই সেখানে যা চকলেট দিয়ে বানানো নয়। মেলবোর্ন শহরের পুরো মডেলটাই চকলেটে তৈরি। আমরা সেটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। বাচ্চারা মহাআনন্দে নানাকিছুতে চাপ দিচ্ছে আর চকলেট বেরিয়ে আসছে। বুড়োরাও কম যায় না। তারাও
হুড়োহুড়ি করছে।
সত্যি, আনন্দ
উপভোগে বয়স লাগে না। আমাদের দেশে আমরা কত অল্পে
বুড়িয়ে যাই। বিশেষত মনের দিক থেকে। কোন কিছুতে উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করতে গেলে মনে হয় লোকে হাসবে না তো। এই ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র ভাবনায় আমরা আনন্দ করতে পারি না। আর
এখানকার বয়স্ক প্রবীণরা লাঠিতে ভর দিয়ে, হুইল
চেয়ারে চড়ে কিংবা ব্যাটারিচালিত অটোতে চড়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাজার করছে, আনন্দ
করছে – কোথাও বাধা নেই। শপিং মল থেকে শুরু করে সব রাস্তাঘাট, পার্ক, রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে তাদের কথা মাথায় রেখে। অথচ আমাদের রাস্তায় ম্যানহোলের ফুটোতেই মানুষ পড়ে আহত হয়, কখনও কখনও হারিয়েও যায়। বিশাল শপিং মলে আচমকা আগুন ধরে যায়। সব
সরঞ্জাম থাকলেও মহড়ার অভাবে সেসব কোন কাজে লাগে না। ঘটে প্রাণহানি আর সম্পদের অপচয়। আহারে আমার দুঃখিনীঈ স্বদেশ, মা আমার, কবে তোমার দুঃখ ঘুচবে। আমরা কি পারব না! পারব। আমরা না
পারি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পারবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে আমাদের তরুণ-তরুণীরা ঘুরে
দাঁড়াচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি স্বনির্ভর হচ্ছে। পদ্মাসেতু হচ্ছে। হবে হবে, উই শ্যাল ওভারকাম।
ধুর্, এলাম
নতুন দেশ ঘুরতে অথচ মন সারাক্ষণ সবকিছুতে মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। এটাকে কী বলব?
পরশ্রীকাতরতা?
ফ্যাক্টরির শেষ পর্যায়ে চকলেটের তৈরি নানান জিনিসের মডেল। সেখানে জুতা, ব্যাগ
থেকে শুরু করে পশু-পাখি, মানুষের
মুখ সবই আছে। আর তাদের যে দাম লেখা আছে তা দেখলে পিলে চমকে
যায়। মনে মনে অঙ্ক কষতে শুরু করি এক ডলার সমান এত
টাকা হলে এটার দাম ...। মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। কিন্তু এর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি যেমন আছে, তেমনি আনন্দও আছে। কারণ
এগুলো আমাদের জন্য নয়, এবং এগুলো কেনার ইচ্ছেও আমার
কখনও হবে না।
সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে ভ্রমণ কাহিনিতে পড়েছিলাম গ্রিক
দার্শনিক সক্রেটিসের নির্মোহ কাটাতে তার শিষ্য প্লেটো এবং অন্যরা তাঁকে বিপণী
দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁদের ধারণা ছিল বিপণীকেন্দ্রের
এত মনোলোভা জিনিস-পত্রের কিছু না কিছু তো গুরুকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু সবকিছু দেখা শেষে সক্রেটিস নাকি মন্তব্য করেছিলেন, এসবের কোন কিছুইতো আমার প্রয়োজন নেই। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে জন্মালে সক্রেটিস কি
একথা বলতেন? হয়তো এটাই বলতেন। কারণ বিশেষরা সব সময়েই বিশেষ আর আমাদের মতো সাধারণরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও
লোভাতুর। এত সুন্দর চকলেটের তৈরি ব্যাগ, টুপি, জুতা, পুতুল দেখতে দেখতে আর সক্রেটিসের কথা ভাবতে ভাবতে আমারও
মনে হল, এসবে আমার কোন প্রয়োজন নেই। হায়, জীবনের
সর্বক্ষেত্রে যদি এমন করে নিজেকে মোহমুক্ত করতে পারতাম!
শিশুরা অনেক আনন্দ করল। প্রচুর
চকলেট খেল তারপর আমরা রওনা দিলাম ফিলিপ আইল্যান্ড সি-বিচের দিকে। মুগ্ধ হয়ে রাস্তা দেখছি। আজ আকাশে কিছুটা মেঘলা। বাতাস
ঠান্ডা। মেলবোর্নে নাকি আবহাওয়ার মর্জি বোঝা ভার। এজন্যে সবাই মোটামুটি সারা সপ্তাহের আবহাওয়ার খোঁজখবর রাখে
তার সাথে প্রতিদিনকারটাও। না হলে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান
করা যায় না। এখানে শুধু ‘রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার
পর রাঁধা’ নয়,
উইকএন্ডে সবাই সপরিবারে বেড়াতে যায় আর বেড়ানোর জায়গাও অফুরন্ত।
এক মেলবোর্নের চারপাশেই
অনেকগুলো বিচ, তারপর সাফারি পার্ক, সি লাইফ অ্যাকুয়ারিয়াম,
বোটানিক্যাল গার্ডেন, পার্লামেন্ট হাউজ, জেমস কুক কটেজ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং তারসাথে আছে সর্বত্রই
চিত্তবিনোদনের জন্য পার্ক। যার
খুশি শুয়ে থাকো, বসে থাকো। ভালোবাসার জনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাও কেউ ফিরেও দেখবে না। মানুষ এখানে আইনের অধীন, কিন্তু
ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ফিলিপ আইল্যান্ড বিচে পৌঁছলাম। এখন প্রায় দুপুর। বিভিন্ন
দেশের ট্যুরিস্ট এবং অস্ট্রেলিয়ান এসেছে আবার অনেকে আছে আমার কন্যা-জামাতার মত
ইমিগ্র্যান্ট বা অভিবাসী। আছে প্রচুর গাড়ি পার্কিং এর
সুবন্দোবস্ত। আমরা যারা একসাথে গিয়েছি তারা সবাই পৌঁছে
একসাথে হলাম। এবার খাওয়ার পালা। লাঞ্চ। সব পরিবারই খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছে।
প্রয়োজনীয় সবকিছুই গাড়ির পিছনে মজুত আছে। প্রত্যেক পরিবার নিজেদের খাবার অন্যদের সাথে
ভাগ করে খেলো।
আমাদের চার পরিবারের শিশুদের আনন্দের শেষ নেই। তারা কাঠের
সেতু দিয়ে বিচের দিকে যাচ্ছে আসছে। এরই মাঝে একজনের চোখে পড়ল সেতুর নিচেচ বেশ
ভিতরে ছোট ছোট দুটি পেঙ্গুইনের বাচ্চা। এবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল দেখার জন্য। ছবি
তোলার জন্য। সেতু ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক আলাপ করতে
চাইলেন। বললেন, ‘ম্যাম, ইউ লুক সেইম টু মাই মাদার’।
আমি হাসলাম। ‘সো ইউ আর মাই সান, অ্যাম আই রাইট?’
‘রাইট,
রাইট। বাই দি ওয়ে, হোয়ার ইউ ফ্রম ম্যাম?’
‘বাংলাদেশ।
ডু ইউ নো বাংলাদেশ?’
‘ইয়া, ইয়া। উই আর ফ্রম মুম্বাই। মাই মাদার উইল কাম হিয়ার
আফটার রামাদান। দিস ইজ মাই ফ্যামিলি’ – বলে স্ত্রীপুত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার
স্ত্রীও সায় দিল, হ্যাঁ, আমি দেখতে তার শাশুড়ির মত। ভদ্রলোক ততক্ষণে তার মানিব্যাগ
খুলে মায়ের ছবি দেখালেন। আমারই বয়সী, কিছুটা মিল হয়তো আছে। আমার ততটা মনে হল না।
কিন্তু আমার ভিনদেশী পুত্রটি বারবারই বলল। সুতরাং আমাকে মেনে নিতে হল আমি তার
মায়ের মতো। কিছুটা সস্নেহে তাকে পুত্রবৎ সম্ভাষণ জানালাম, তার মাকে সালাম। মনে পড়ল
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার কথা যেখানে কন্যার জন্য ব্যাকুল পিতা আর এখানে মায়ের
জন্য ব্যাকুল পুত্র। এত যান্ত্রিক পরিবেশে বাস করেও আমরা এভাবেই গোপনে লালন করে
যাই প্রিয়জনের জন্য ভালোবাসা, ব্যাকুলতা।
এখন সেলফি তোলার জ্বরে আক্রান্ত বিশ্ব। বিশেষ করে তরুণ সমাজের
তো কথাই নেই। তবে ছবি তোলার দিকে আমার নিজেরও ঝোঁক আছে। মাস্টারি জীবনে এসএসসি
এইচএসসি ফেয়ারওয়েলের সময় ছাত্রছাত্রীদের সাথে এত ছবি তুলতে হত যে মনে হতো ফটোসেশন
করছি। এখন বয়স বেড়ে গেলেও ছবি তোলার শখ যায়নি। সেই শখে রনি আমাদের অনেক ছবি তুলল।
আফসোস একটাই কম্পিউটারে ছাড়া এখন ছবির প্রিন্ট কমই দেখা যায়। কিন্তু আমরা তো
সাদাকালো যুগের স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা মানুষ। এই দৌড়ে তাই নিজের অজ্ঞতা ও
যন্ত্রের প্রতি অনীহার কারণে পরনির্ভরই থেকে যেতে হয়।
ফিলিপ আইল্যান্ড সি-বিচ উর্মিমুখর সফেন সৈকত নয়। অনেক দূর
থেকে ঢেউ আসছে ভাঙছে। আমাদের বঙ্গোপসাগরের মত উন্মাদ উতরোল নয়, কর্দমাক্তও নয়।
স্বচ্ছ সুন্দর পানি। সেই পানিতে আকাশের প্রতিবিম্ব। এই কি রবীন্দ্রনাথের সেই সুনীল
সাগর যার শ্যামল কিনারে তিনি দেখেছিলেন তাঁর তুলনাহীনারে!
মেলবোর্নে যেখানেই যাচ্ছি আকাশের নীল আর সীমাহীন দিগন্ত আমাকে
মুগ্ধ করে রেখেছে। আজ সাগরে মুগ্ধ হলাম।
বেলা পড়ে আসছে। তবে সূর্যাস্তের দেরি আছে। তাই ফেরদৌসের
ছোটভাই বাবন বলল, ‘আমরা যদি এখন ফিরি তাহলে কিছু দূরে আরেকটা বিচ
আছে ‘ব্যারিস বিচ’ – সেটা
দেখে যেতে পারব। সেটা আরও সুন্দর’।
সাথে সাথে সবাই সায় দিল।
বেরিয়েছি যখন তখন দেখেই যাই। অল্পক্ষণের ড্রাইভে (অবশ্য এখানে অল্প সময়ে অনেক
দূরের রাস্তা পাড়ি দেয়া যায়) আমরা ব্যারিস বিচে পৌঁছালাম।
ওমা! এটা দেখি আরো সুন্দর। তবে বিচ অনেক নিচে। সেখানে সমতল।
আমরা সেই হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি পাহাড় সমান উঁচুতে। যেখানে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল তার
চারপাশে বেশ ঝোপঝাড়। এই ঝোপগুলোও বেশ মন কাড়ানিয়া দৃষ্টিনন্দন। একবার তাকালেই মনে
হয় ডাকছে – তাকাও, আবার দ্যাখো আমাকে। শুধু চোখ দিয়ে নয়,
মন দিয়ে দ্যাখো। আমার মন বলে, হ্যাঁ, এই রূপই তো দেখতে এসেছি। কিন্তু তোমাদের রূপ
ফুটিয়ে তোলার ভাষা যে আমার নেই। তবু প্রিয় পাতা, ফুল, তোমাদের ছোট্ট সুন্দর ফলের
কথা আমি লিখব।
ব্যারিস বিচ আসলেই খুব সুন্দর। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব
মেনে মনে হল ফিলিপ আইল্যান্ড বিচ থেকেও ব্যারিস বিচ বেশি সুন্দর। বিচ অনেক নিচুতে
বলে কাঠের সিঁড়ির ব্যবস্থা। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে তবে বিচে নামতে হয়। পাহাড়ি টিলার
উপরে বসার জন্য কাঠের পাটাতনের উপর বেঞ্চ দেয়া। আমি সেখানেই বসলাম। ‘পঙ্গুতে পর্বত লঙ্ঘিতে পারিলেও আমি সোপান ভাঙিতে অসমর্থ’।
রনি আমাকে একা রেখে যেতে চাইল না। কিছুক্ষণ বসার পর আমি জোর
করে তাকে পাঠালাম। নিচে সবাই হুড়োহুড়ি দৌড়াদৌড়ি করছে। তার স্ত্রী-সন্তানেরা আছে।
সে নিজেও ছেলেমানুষ। আনন্দ করবে না? অনেকবার বলার পর শেষে গেল। আমি উপরে বসে
ওদেরকে দেখতে লাগলাম।
শিশুরা ছুটছে বেলাভূমির বালিতে। এখানে তাদের শৈশব অনেক বেশি
আনন্দময়। দূরে সৈকতে কালো ঢিবির মত দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কালো পাথরের স্তূপ। ওরা
হাঁটতে হাঁটতে দল বেঁধে ঢিবিগুলোর উপরে উঠছে। কেউ বসছে।
একসাথে ভ্রমণ করতে করতে আমার
গৃহকর্তা জনাব ইসলাম আর ফেরদৌসের বাবা শামসুল আলম সাহেবের মাঝে বন্ধুত্ব তৈরি
হয়েছে। যেখানেই যায়, আলম ভাই তার হাত ধরে হাঁটে, গল্প করে। আমার উনি আবার রসের
ভান্ডার আগেই বলেছি। প্রাসঙ্গিক চুটকি শোনাতে তাঁর জুড়ি নেই। কীভাবে এত গল্প মনে
রাখে আর সময়মতো বোমা ফাটায় জানি না। যদি বলি লিখে রাখো না তোমার এসব গল্প। তোমার সাথে হারিয়ে যাবে এমন গল্পগুলো! তিনি শোনেন, পাত্তা
দেন না। বলেন, ‘প্রাসঙ্গিক না হলে এসব গল্প জমবে না’।
সৈকত একেবারেই নির্জন। দুটো জুটি দেখতে পাচ্ছি পরস্পর জড়াজড়ি
করে হাঁটছে। স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়। আমাদের দেশে
যত্রতত্র এখনও তরুণ-তরুণীদের মেলামেশায় আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। যদিও ইদানীং
এক্ষেত্রে যথেষ্ট সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। তবুও এতটা খোলামেলা নয়। অথচ এখানে এই
ঘনিষ্ঠতা কত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আবার এরা গড়েও তাড়াতাড়ি, ভাঙেও দ্রুত। আমরা
বিশেষ করে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ এখনো কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে আন্তরিক।
এক্ষেত্রে সামাজিক নৈতিকতার দায়ও আছে, সেটাও কম নয়।
ইসলাম সাহেব আমাকে একা বসে থাকতে দেখে উঠে এলেন। হাতে এক
টুকরো কালো রাবারের মত কিছু একটা। বললেন, ‘এটা গাছের ছাল। দ্যাখো, কী শক্ত। এগুলো জমেই ঐ টিলার মত ঢিবিগুলো তৈরি হয়েছে’।
‘একদিন
এগুলোই পাথর হয়ে যাবে?’ আমি
জানতে চাইলাম। বালি, পানি, রোদ সব মিলিয়ে একদিন তাই হবে হয়তো।
‘দ্যাখো
চারপাশের ঝোপগুলো দেখতে কী সুন্দর লাগছে’। তখনই চোখ পড়ল নিচে নামার পথে একটা ঝোপের পাশে কিশোরী
বয়সীদের কিছু পুরনো কাপড়, পুতুল, স্যান্ডেলের একপাটি পড়ে আছে। তার পাশে লেখা
মেয়েটিকে উৎসর্গ করে কিছু বিচ্ছেদের কথা। পড়ে মনে হল বালিকাটি চতুর্দশ বর্ষীয়া
কিশোরী ছিল এবং সে আত্মহত্যা করেছিল। পাশে সতর্কীকরণ আরেকটি নোটিশ – সন্ধ্যার পর এখানে একা থাকা যাবে না।
হায়! কত সীমাহীন বিষাদ সমুদ্রে ডুবে এই কিশোরীটি আত্মহননের পথ
বেছে নিয়েছিল কে জানে। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি দিতে চোখে পড়ল রঙের খেলা। সূর্য যত
অস্তাচলের দিকে নামছে, পানিতে তত রঙের খেলা চলছে। কখনো মনে হচ্ছে সবুজ, কখনও নীল,
কখনও কমলা – এই অপরূপ সুন্দরের বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার
নেই। তাই নয়ন মেলে তাকিয়ে থাকি নয়ন ভুলানো সুন্দরের পানে।
সন্ধ্যার পর এখানে থাকা মানা।
সুতরাং প্রদোষের ধূসর অন্ধকার তার অস্পষ্টতার পর্দা নামিয়ে দিতে শুরু করলে আমরা
আবার গাড়িতে উঠি। সামনে এগিয়ে চলি, মন মেতে থাকে পিছনে সফেন ঢেউয়ের শিখরে শিখরে
রঙের খেলায়।
এখন আমরা মেলবোর্ন সিটির পাশ
দিয়ে হাইওয়েতে যাচ্ছি। শহরের স্কাইস্ক্র্যাপার ভবনগুলোতে আলো জ্বলছে। আলোকোজ্জ্বল
শহর অথচ ঘুমন্তপুরী যেন। রনি বলল এগুলো সব অফিস। শহরে যারা আবাসিক এলাকায় থাকে
তারা প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক। আর থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অথবা স্টুডিও
অ্যাপার্টমেন্টে অণুপরিবারগুলো। বাচ্চা হওয়ার পর তারা এখানে থাকতে পারে না। কারণ
বাচ্চার বড় হওয়ার জন্য যে সুযোগ সুবিধা অর্থাৎ ডে-কেয়ার, স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক – সেগুলো এখানে নেই। তাই বাচ্চা হওয়ার পর বাবা-মাকে
সাব-আর্বান আবাসিক এলাকায় চলে যেতে হয়।
সারাদিন ঘুরে ফিরে সবাই ক্লান্ত। পূর্বা-দিব্য দু ভাইবোন খেলতে খেলতে গাড়িতেও ঝগড়া লেগে যায়। আমার
শান্তশিষ্ট মেয়েটি অনেকক্ষণ সহ্য করে একসময় রেগে যায়। আজকে ছুটোছুটি হুটোপুটি করে
ওরাও ক্লান্ত। সবারই ঝিমুনি ধরেছে। আমি রনির পাশে বসে মাঝে মাঝে কথা বলছি। এটা ওটা
প্রশ্ন করছি। সেও ড্রাইভ করতে করতেই বর্ণনা দিচ্ছে। গাড়িতে জিপিএস লাগানো। তাতে
একটি নারীকন্ঠ স্পষ্ট ইংরেজিতে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে – কত মিটার গেলে কোথায় মোড় ঘুরতে হবে, কোথায় ডান দিক বা বাঁ
দিকে যেতে হবে।
শহর পেরিয়ে এখন আমরা ওয়েস্টগেট ব্রিজে। ব্রিজে উঠতেই নিজের
অজান্তেই বলে উঠলাম – ইস কী
সুন্দর। উঁচু ব্রিজ থেকে ডানে বাঁয়ে সামনে অনেকগুলো সাবার্ব দেখা যাচ্ছে। রাতের
বৈদ্যুতিক আলোয় দূর থেকে সাবার্বগুলোকে কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে। সোনালি এ আলোকমালার
সৌন্দর্যে আমি অভিভূত। মনে হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্রের দীপাবলি উৎসব। পরিকল্পিত
প্রত্যেকটি সাবার্ব যেন সেই রাতের উৎসবে সেজেছে। আবার এও মনে হল দূর থেকে দেখা এ
সৌন্দর্য কাছে গেলে অন্যরকম মনে হবে। কারণ বাতি অনেক থাকলেও গৃহগুলো নির্জন। কোথাও
হৈ চৈ নেই। হুশ হাশ শব্দে কিছু গাড়ি, দিবারাত্রি খোলা কিছু দোকানপাটে অল্পসংখ্যক
মানুষ হয়তো দেখা যায়। কিন্তু যে জনাকীর্ণ দেশ থেকে আমি এসেছি সে তুলনায় মেলবোর্নকে
জনশূন্যই মনে হয়।
তবুও মনে হল এই রূপলোক শুধু নয়ন ভরে দেখার নয়, মন ভরে উপভোগেরও। এরপর থেকে যখনই রাতের বেলা কোথাও থেকে ফিরেছি, আমার মন সারাক্ষণ ওয়েস্টগেট ব্রিজ থেকে দেখা আলোর সৌন্দর্য দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকত।
*****
No comments:
Post a Comment