৩০
আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে তুমি কোন্ শহরের কোন্ দর্শনীয় স্থানটা সবার আগে
দেখতে চাও? আমি বলব –
বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং একবার নয় অসংখ্যবার। কিন্তু দুঃখ হল চিড়িয়াখানার মত
আমাদের বাংলাদেশের বোটানিক্যাল গার্ডেনও অযত্নে অবহেলায় এখন একরকম পরিত্যক্ত।
গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে সংবাদ আসে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ইত্যাদির অকুস্থল হিসেবে। তাই
একসময়ে অনেক বড় এলাকা নিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানার পাশে পরিকল্পিত বিশাল বোটানিক্যাল
গার্ডেন নব্বইয়ের দশকেও দ্রষ্টব্য ছিল। এখন আর সেই পরিবেশ নেই। জনজীবনের
নিরাপত্তার অভাবে নির্জনতার সুখ উপভোগের সুযোগ হারিয়ে গেছে। প্রচুর টাকাকড়ি থাকলে
এখন আছে সাজানো ফুলদানির মত রিসোর্ট। আর সাধারণের বিনোদনের জন্য? ওদের আবার বিনোদন
কী? তাই সুস্থ বিনোদনের অভাবে আমাদের দেশে অসুস্থ বিনোদন আর অপসংস্কৃতি ক্রমশ
বর্ধমান।
মেলবোর্নের বোটানিক্যাল গার্ডেন আয়তনে যেমন বৃহৎ, প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যেও তেমনি এবং এক দুদিনে এটি দেখে শেষ করা যাবে না।
এর আগে একদিন আমরা স্রাইন অব রিমেম্বারেন্স দেখতে গিয়ে সাজেদা
আপারাসহ গিয়েছিলাম। ওনার কর্তা শামসুল আলম সাহেব বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের ডিজি
হিসেবে রিটায়ার করেছেন। ব্যক্তিজীবনে এই দম্পতি ও তাদের সন্তানেরা অত্যন্ত
বন্ধুবৎসল, সজ্জন এবং সৎমানুষও বটে। আলম ভাই আবার রাকার আব্বুকে সঙ্গী হিসেবে পেতে
চান যেমন কোথাও যেতে গেলে আমি চাই সাজু আপাকে।
আমার কর্তাটি সিনিয়র বলে তিনি তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, আবার
তার কৌতুক শুনে এত মুগ্ধ যে কোথাও গেলে দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটেন। বয়স্য বলে
একটা অন্তরঙ্গতা দুজনের মধ্যে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। আমি আর সাজু আপাও তাই। কোন
বাসায় দাওয়াতে গেলে একজন না গেলে অন্যজন কিছুটা ম্রিয়মান থাকি। আমাদের প্রবাসী
কন্যারা সকলেই প্রায় একবয়সী। তাদের গল্পে সবসময় আমাদের ঠাঁই হয় না। কারণ মা-খালারা
তো গুরুজন।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে কোন দাওয়াতে পুরুষরা একদিকে,
মেয়েরা অন্যদিকে এবং শিশুরা তাদের জগতে। আমি পেশাগত কারণে কিনা জানি না, সবার সাথে
কথা বলতে, গল্প করতে পছন্দ করি। কথার আদান প্রদানেই তো জ্ঞান, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা
বাড়ে। অথচ সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও এই বিভাজন আমাকে বিস্মিত করল। দু’একজনকে দেখলাম পরিবারের নারীরা যেমন নেকাবে ঢাকা, পুরুষরাও
তেমনি মেয়েদের কক্ষের আশেপাশেও আসেন না। বুঝি ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তারা হয়তো এসব
করেন। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা – তাহলে তারা ঐসব বেপর্দার দেশে যান কেন? শালীনতাবোধই কি আসল পর্দা নয়?
*****
৩১
আউটিং-এর কথা শুনলে
পূর্বা-দিব্য লাফিয়ে ওঠে। এবার দ্বিগুণ লাফ দিল যখন শুনল পরদিন আমরা শহরে সি-লাইফ
অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে যাব। ওরা আগে যখন গিয়েছিল সেই ছবি দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
এবার স্বচক্ষে দেখব – স্বভাবত
আগ্রহ আমারও অপরিসীম। সাজু আপাদের আজ অন্যত্র যাওয়ার প্রোগ্রাম, তাই আমরা একক
পরিবারই যাত্রা করলাম শহরের উদ্দেশে।
রনি টিকেট জমা দিলো। আমরা ভেতরে ঢুকতেই একজন আমাদের দাঁড়াতে
অনুরোধ করল। তারপর দাঁড় করিয়ে ফটাফট কয়েকটা পারিবারিক শট নিল। এবার আমরা যাত্রা
করলাম অ্যারো চিহ্ন দেয়া পথ অনুসরণ করে সাগরতলের প্রাণী দেখতে শুরু করলাম। আমাদের
বিজ্ঞানলেখক ড. আবদুল্লাহ আল-মূতির ‘সাগরতলের রহস্য’ পড়ে জেনেছিলাম পৃথিবীর উপরিভাগে যত প্রাণী আছে, জীববৈচিত্র্য আছে, সাগরতলে
তার চেয়ে বহুগুণ বেশি এবং সৌন্দর্যে ও সম্পদে অতুলনীয়।
প্রবাল, নানারঙের মাছ-হলুদ,
বেগুনি, কমলা, নীল আবার নানা রঙের মিশেলে অপূর্ব সুন্দর মাছগুলো লেজ আর পাখনা নেড়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। অ্যানিমেল প্ল্যানেটে যেমন দেখি এখানে তাই দেখছি বাস্তবে। দেহ
রোমাঞ্চিত, মন বিস্ময়মুগ্ধ। যে যে অবস্থায় থাকে ঠিক তেমনি পরিবেশ তৈরি করে সবাইকে
রাখা হয়েছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদ, নানারকম আর নানা রঙের প্রবাল, ঝিনুক, শামুক – দেখতে দেখতে ভুলে যাই আরো দেখার আছে, হাতে সময় কম। একমাত্র
তিমি মাছ ছাড়া হাঙর, কুমির, ডলফিন, স্টিং রে, আরো কতরকম সামুদ্রিক প্রাণী – দেখে শেষ করা যায় না।
হাঙর আর স্টিং রে দেখার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত
প্রাণিপ্রেমিক স্টিভ আরউইনের কথা মনে পড়ে গেল। অ্যানিমেল প্ল্যানেটে এই মানুষটির
কুমিরের সঙ্গে নানারকম কসরৎ দেখতাম। তার কথা, হাসি, দুঃসাহসী কাজ অবলীলায় করার
প্রবণতা আমাকে এত মুগ্ধ করত যে আমি তার ভক্ত বনে গিয়েছিলাম। আমেরিকান স্ত্রীকে
সাথে নিয়ে তার একটি চলচ্চিত্রও দেখেছিলাম। হঠাৎ একদিন টিভি সংবাদে জানা গেল স্টিং
রে মাছের আঘাতে তিনি মারা গেছেন। অথচ জীবস্বভাবে স্টিং রে নাকি নিরীহ। আপনজন
হারানোর মত দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাদের মত আবেগপ্রবণ নয়। ঘটনার পর পরই তার বাবা, ভাই, স্ত্রী, এমনকি শিশুকন্যাটিও
বাবার অসম্পূর্ণ কাজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। পারিবারিক কুমীরের খামার আছে তাদের। ছোট্ট
শিশুটি সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যোগ দিল। কী দুঃসাহস। এখন মেয়েই খামারে
দর্শনার্থীদের খেলা দেখায়।
সেই স্টিং রে? অনেকটা রূপচাঁদা মাছের মত, কিন্তু আকৃতি বিশাল
আর পেছনের লেজটা অনেকটা লম্বা। দেখে মনে হচ্ছে বাঁশের লম্বা কঞ্চির মত চিকন,
কিন্তু শক্ত।
এমনভাবে অ্যাকুরিয়ামকে তৈরি করা হয়েছে ঘুরে দেখার জন্য।
মাঝখানে করিডোর অনেকটা সুড়ঙ্গ পথের মত। মাথার উপর দিয়ে হাঙর, স্টিং রে, আরো নাম না
জানা নানা জাতের বড়মাছ ঘুরছে ফিরছে। কাচের গায়ে লেখা আছে এই প্রাণিগুলো আমরা যা
দেখছি তার চেয়ে কমপক্ষে তিনগুণ বড়, কারণ নিরাপত্তার খাতিরে কাঁচের দেয়াল অনেক পুরু
যাতে কোন বড় আঘাতেও ভেঙে না যায়।
সাগরতলের প্রবাল প্রকৃতির এক
অপূর্ব সৃষ্টি। রঙে, গঠনে, রূপে-বৈচিত্র্যে এগুলো অতুলনীয়। মহাসাগর বেষ্টিত
অস্ট্রেলিয়ায় মনে হয় এসবের বৈচিত্র্য আরো বেশি।
অ্যাকুরিয়ামের ভিতরে একটি রুমে শিশুদের মেলা বসেছে। এতক্ষণ
তারা যেসব সামুদ্রিক প্রাণী দেখেছে রং-পেন্সিল দিয়ে কাগজে সেগুলোর ছবি আঁকছে। সাথে
সাথে ওখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীটি কম্পিউটারে স্ক্যান করে দিতেই একপাশের
দেয়ালে পর্দায় সেই ছবি ভেসে উঠছে, এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করছে। পূর্বা-দিব্যও ছবি
আঁকল এবং পর্দায় সেগুলো দেখা মহাউচ্ছ্বসিত। দিব্যর উৎসাহ সবচেয়ে বেশি।
এবার আমরা যাব দক্ষিণ
মেরুতে। কারণ যেখানে যাচ্ছি সেখানে বরফে ঢাকা সমুদ্র, তার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো পেঙ্গুইন। নানা জাতের পেঙ্গুইন।
ডিজিটাল যুগে সবার হাতে ক্যামেরা। অতএব ছবি তোলা হচ্ছে খটাখট। একদিকে
বরফভাসা পানিতে মহাআনন্দে সাঁতার কাটছে পেঙ্গুইনের দল। আমার খুব ইচ্ছে হল সাঁতার কাটি ওদের সাথে। বাস্তবে না হোক, মনে মনে ডুব দিলাম বরফঢাকা পানির
নিচে। উফ্ কী ঠান্ডা!
‘আম্মু, এবার চলেন’ – হঠাৎ রাকার ডাকে চমক ভাঙল। হ্যাঁ, এবার তো
যেতে হবে। ফেরার পথে যে মেয়েটি ছবি তুলছিল সে একটা
কাগজের অ্যালবামে আমাদের কয়েকটা ছবি ধরিয়ে দিল। গেটে তোলা ছবির পেছনে অ্যাকুয়ারিয়ামের নানারকম দৃশ্য ইমপোজ করে দিয়েছে। এটুকুর দাম ৪০ ডলার। আমি
রাকাকে বললাম, ‘দরকার আছে নেয়ার?’
‘নিই। স্মৃতি
হিসেবেতো মূল্য আছে। আর আসবেন এখানে এমন সিওরিটিতো
নেই’।
যুক্তি আছে মেয়ের কথায়। বললাম, ‘তাহলে নাও’।
ক্ষিধে পেয়েছে। আজ আমরা খেতে যাবো ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে।
*****
৩২
প্রদীপ ছুটি কাটাতে সাউথ
আফ্রিকা যাবে। অবশ্য রথদেখা-কলাবেচার মত সেখানে তার একটা
কনফারেন্সও আছে। সুতরাং শেষবারের মত তার বাসায় আজ ঘুরে আসব।
তার বাসা থেকে আসার আগে আমরা লাঞ্চ সেরে নার্সারিতে গেলাম। তিনটা গাছের চারা কিনলাম আমাদের পছন্দে। তারপর একটা তার দুলাভাই আর বাকি দুটো গাছ আমি লাগালাম তার
ব্যাকইয়ার্ডে। খাটুনি যা সে নিজেই করল। আমরা ভিনদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের মত মাটি ছুঁয়ে, পানি দিয়ে স্মৃতির চিহ্ন রেখে গেলাম। বেশ
ভি-আই-পি মনে হল নিজেকে।
*****
৩৩
যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে মেয়ের মন ততই খারাপ। পূর্বারও। আর আমাদের কথা নাইবা বললাম। আবার কবে দেখব ওদের। কখন কাছে পাব এই ভাবনায় মন
নিয়ত ক্রন্দনশীল। কিন্তু বাইরে তা দেখানো যায় না। দিব্যকে ছোটবেলায় আমি তেমন
কাছে পাইনি। কিন্তু এবার সে নানুর সাথে খুব স্বতঃস্ফুর্ত। স্কুল থেকে ঘরে ঢুকেই
নানুকে খোঁজে। পূর্বাতো আছেই – আমার হিয়ার মাঝে।
ওদের স্কুলে দিয়ে এসে রাকা বাসার কাজে হাত লাগায়, রান্না করে। আমাকে কিছুই করতে দেয় না – ভয় যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি। মা-মেয়ে গল্প করি। পুরনো দিনের কতশত স্মৃতি। বন্ধু-স্বজন কে কেমন আছে। মাঝে মাঝে বাগানে যাই। গাছ, ফুল, আকাশ, মেঘ, সূর্যডোবার রঙ দেখি। মাঝে মাঝে নাতি-নাতনির
সাথে লুডো খেলি। কিন্তু বেশিক্ষণ খেলা হয় না। দিব্যবাবু সব পন্ড করে দেয়। তবু আনন্দ, কত আনন্দ।
দিঠুনের সাথে প্রতিদিন কথা
বলি। বাংলাদেশে প্রচন্ড গরম পড়েছে। বিশ্বজলবায়ু পরিবর্তনের
প্রভাব আর পরিকল্পনাহীন নগরায়ন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ষোল কোটি মানুষের বসত। গরম তো লাগবেই। এবার কালবৈশাখী বেশি হচ্ছে
এবং বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা গেছে- যাচ্ছে। সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ
ঘোষণা করেছে। অপঘাতে মৃত্যু যেন আমাদের নিয়তি।
আর এখানে এসে অবধি দুটো দুর্ঘটনার কথা শুনেছি। একটি – একজন আফ্রিকান মা নাকি তার বাচ্চাসহ গাড়িকে ঠেলে পানিতে ফেলে দিয়েছে। এটা আসলে দুর্ঘটনা নয়, মায়ের মনোবিকার। আরেকটি – ধর্ষণের ঘটনা। অবশ্য
এদেশে ঘটনা ঘটে না দেখে এগুলোকে অনেক বড় করে দেখে।
একদিন কোথায় যেন যাওয়ার পথে প্রদীপ জেলখানা দেখিয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোন কয়েদি নেই। কারণ সুদৃশ্য জেলখানায় থাকা-খাওয়া,
সেবা-সুশ্রুষার যে ব্যবস্থা তাতে কয়েদির যেমন আরাম, তেমনি সরকারের প্রচুর অর্থের অপচয়। তাই
অপরাধীকে জামাই আদরে রাখার চেয়ে অর্থদন্ডের শাস্তিই বেশি দেয়া হয়।
*****
৩৪
এখানে মাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ইস্টার পরব সবকিছুতে দোকানগুলোতে মূল্যহ্রাসের হুড়োহুড়ি
পড়ে যায়। মানুষও দেখলাম প্রচুর কেনাকাটা করে। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে অবাক করল – আজ যে পোশাক বা দ্রব্যের দাম ১০ ডলার দেখলাম, কাল গেলে দেখি সেই একই টি-শার্ট আট ডলার এবং আরো দু’দিন পরে গেলে ছয় ডলার। আগে কিনে ফেললে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে।
প্রত্যেক দোকানে প্রতি সপ্তায় কিছু না কিছু মূল্যছাড় থাকে আর ক্রেতারাও সেই সুযোগে
কিছু বেশি জিনিস কিনে রাখে। এতে
সাশ্রয় হয়। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় খাবার ছাড়া অন্যান্য
জিনিসের দাম অনেক বেশি। রাকাকেও দেখলাম খুঁজে খুঁজে
সংসারের দরকারি জিনিস বেশি করে কিনে রাখছে। কারণ
অন্যান্য পণ্য তারা বেশিরভাগই আমদানি করে যেহেতু এদেশে শ্রমিকের পারিশ্রমিক অনেক
বেশি।
কিন্তু এত দাম কমায় কেন? প্রথম দিন থেকে কমালেই তো পারে – জানতে চাইলাম। এখানে
স্টোরেজ বা গুদামের ভাড়া বেশি। জিনিস
জমে গেলে বেশি কড়ি গুণতে হয়, তাই যত
তাড়াতাড়ি পারে বিক্রি করে। যে
জিনিসটা দেখে সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হলাম সেটা হচ্ছে টি-শার্ট, গেঞ্জি, জিন্সের
ট্যাগে লেখা আছে ‘মেড ইন
বাংলাদেশ'।’
এখানে শ্রমের দাম বেশি বলে ওরা আমাদের দেশ থেকে পোশাক আমদানি করে। তাহলে কত কম দামে আমাদের পোশাক শ্রমিকেরা (যাদের প্রায় সবাই নারী) তাদের শ্রম বিক্রয় করছে। তাদের জীবন পিষ্ট করে গার্মেন্টস মালিকরা একেকজন ধনকুবের হচ্ছে, আর মালয়েশিয়া, আমেরিকায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। সন্তানকে বিদেশে পড়াচ্ছে। জীবন-যাপন, বিবাহ-উৎসবাদিতে প্রাচুর্য উপচে পড়ছে। অন্যদিকে রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস-এ শ্রমিকের কংকালসার শরীর পোড়া কংকাল ভাস্কর্য তৈরি করছে।
*****
৩৫
মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার
মাদার্স ডে। এখন আমাদের দেশেও ঘটা করে এটা পালিত হয়। এটি মূলত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি।
বাবা-মা থেকে আলাদা থাকে বলে তারা বৃদ্ধাশ্রমে অথবা বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাদের
গিফ্ট দেয়, খাওয়াতে নিয়ে যায়। যারা দূরে থাকে তারা পার্সেল পাঠায়। আমাদের দেশে
এখনও এই সংস্কৃতি এতটা প্রবল হয়নি। শৈশবে বাবা-মা, আর বার্ধক্যে সন্তান এখনও
পরস্পরের অবলম্বন। নগরায়নের কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে অণুপরিবার। হলেও আমরা মা-বাবাকে
কাছে রাখতেই ভালবাসি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবু এই সংস্কৃতি আমার ভাল লাগে এই
জন্যে যে অন্তত একদিন হলেও আমার সন্তানরা আমাকে নিয়ে আনন্দ করে।
সকালেই রনি-রাকা আমাকে উইশ করল। রনি স্বভাবে মিতভাষী, কথা বলে
নিচুস্বরে। সেই ঘোষণা দিল, ‘আম্মার অনারে আজ আমরা বাইরে খাব’।
দুপুরে আমরা গেলাম ওয়্যারবি প্লাজার মালয়েশিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘মাকান প্লেস’-এ। ওরে বাবা এত ভীড়। টেবিলই খালি নেই। বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে তরুণ-তরুণীরা ভীড়
জমিয়েছে। প্রায় সবার হাতে গিফ্ট আর ফুলের তোড়া।
মালয়েশিয়ান খাবার এখানে খুব জনপ্রিয়। অজিরাও পছন্দ করে।
কিন্তু চীনে খাবার নাকি একেবারে যাচ্ছেতাই। বাংলাদেশের বঙ্গীয় স্টাইলে চাইনিজ
খাওয়া ছেলেমেয়েরাতো সে খাবার মুখে তুলতে পারে না। তাই এখানে তারা সবচেয়ে বেশি মিস
করে বাংলাদেশের নানারকম ও নানাস্বাদের মিষ্টি আর চাইনিজ খাবার।
*****
৩৬
কাল ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, আজ আবার সকাল থেকে আকাশের
মুখভার। টিপ টিপ বৃষ্টি। অথচ আজ আমাদের যাওয়ার কথা মেসিডোন গার্ডেন। বৃষ্টিতে
যাতায়াতে অবশ্য সমস্যা নেই কারণ এই বৃষ্টি বাংলাদেশের শ্রাবণধারা বাঁধনহারা নয়।
সকাল বেলাতেই রওনা দিলাম। আজ ফেরদৌস-তন্বী পরিবার আছে সাথে।
আছেন শামসুল আলম ভাই ও সাজু আপা। রাকার আব্বু ওনাদের সাথে যায়। রনির গাড়িতে আমি
বসলে আরেকজন বসার জায়গা থাকে না এবং এতজন
চড়া দন্ডনীয় অপরাধও বটে। ফেরদৌসের একটা গাড়ি সে চালায়, আরেকটা ওর ছোটভাই বাবন। সেই
গাড়িতে আলমভাই আর সাজু আপাদের যাত্রাসঙ্গী হয় রাকার আব্বু। ওনারা না থাকলে গাড়িতে
কোথাও যাওয়া আমাদের জন্য একটা সমস্যাই হত। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় আমরা একসাথে
বেড়াতে গিয়েছি।
মেসিডোন গার্ডেন বেশ দূরের পথ। যেতে যেতে দেখছি তৃণভূমি – ভেড়া, গরু,
ঘোড়া চরছে। স্বাস্থ্যসম্পদে আকর্ষণীয় প্রতিটি পশুই দর্শনীয়। আর প্রাণিদের মধ্যে
সৌন্দর্যে, দৈহিক গঠন এবং চলনে ঘোড়া অতুলনীয়। যেতে যেতে একটা মাঠে দেখলাম অনেক
ঘোড়া, অনেক মানুষও। অ্যানাউসমেন্ট হচ্ছে। রনি বলল, ‘রেস আছে মনে
হচ্ছে। বৃটিশ রক্তের উত্তরাধিকারী অস্ট্রেলিয়ানরা রেসের বাজিতো খেলবেই।
তৃণক্ষেত্র, গাছপালা, আন্ডারওয়ে পার হয়ে আমরা মেসিডোন
গার্ডেনে এলাম। এখানে বেশ কয়েকটি বাগান কিন্তু সব একদিনে দেখে শেষ করা যাবে না।
ওদিকে আকাশে ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে’।
মেসিডোন গার্ডেনের বৈশিষ্ট্য এর বহুবর্ণিল ম্যাপেল পাতা। কত
যে রঙ – কোনটি হালকা, গাঢ়, আগুন রঙ, মিষ্টি আপেল রঙ, সোনালী।
প্রকৃতিতে এক ম্যাপেল পাতারই এত সৌন্দর্য – যে না দেখেছে সে ভাবতেই পারবে না।
রাস্তা নিচু থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে।
এখানে হুইল চেয়ার চলবে না, মাটিও ভিজে ঈষৎ
কর্দমাক্ত। আমি মুক্তি পেলাম। মাঝখানে সমতল মাঠ, চারপাশে উঁচু পথচলা রাস্তা, দূরে
ঘন ছাই রঙা মেঘ এত গর্ভবতী মনে হচ্ছে তাকে যেন এখনই ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে।
আমাদের সৌভাগ্য - মাঝে মাঝে টিপ টিপ ফোঁটা ছাড়া বর্ষণ হলো না।
বাগানের মাঝে মাঝে নানা রকম গাছ। যেসব কৃত্রিম ফুল দোকানে দেখে মুগ্ধ হয়েছি এখানে
দেখি সেগুলোর সবই বাস্তব রূপ। দেখে মন গেয়ে উঠল – এই লভিনু
সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।
এক জায়গায়
হিপোক্রিটাসের বেশ বড় মূর্তি একটি চেয়ারে আসীন। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলা হয়
হিপোক্রিটাসকে। আবার ভন্ডামি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘হিপোক্রেসি’ – কেন?
দলের অন্যরা সবাই সিঁড়ি দিয়ে অনেক নিচে
নেমে আরো বৃক্ষশোভিত বাগান দেখে এলেন। আমি একটি কৃত্রিম জলাধারের পাশে বসে চারদিক
দেখতে লাগলাম। প্রকৃতি এমন এক বিষয় যার শুরু-শেষ নেই। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আজ এই
অপার সৌন্দর্য আমার মনকে সোনারঙে রাঙিয়ে দিল। ‘এই তো তোমার
রূপ, ওগো হৃদয়-হরণ, এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ’...।
এবার ফেরার পালা। আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের
নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে রনিদের সাদেক ভাইয়ের বাসায়। আবার সবাই মিলে চলা শুরু।
পথে পথে শুধু মেসিডোন গার্ডেনের গল্প।
*****
৩৭
আজ
বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ দিন। গতকাল ১১.৫.২০১৬ তারিখ রাত ১২.১০ মিনিটে যুদ্ধাপরাধী
এবং রাজাকারদের নেতা কুখ্যাত মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিলের
রিভিউ নিয়ে একটু সংশয় ছিল – যদি সাঈদী-গোলাম আজমের মত শাস্তি
গুরু থেকে লঘুতর হয়ে যায়। নাহ্ হয়নি। স্বস্তি পেলাম। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালোম সময়ে
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী এ দানব শেষপর্যন্ত চরম শাস্তি পেল। জয়
বাংলা।
No comments:
Post a Comment