Saturday, 8 March 2025

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

 




এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Empowerment. সকল নারীর জন্য অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন।

যতই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকুক না কেন,  নারীর সম্মান এবং নারীর অধিকার দুটো ভিন্ন বিষয়। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই নারীদের সম্মান দেয়া একটি লোকদেখানো ব্যাপার। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নারীর সম্মান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে নারীর অধিকার হরণ করে নেয়া হয়। “আপনার সম্মান বজায় রাখার জন্যই আপনার উচিত হবে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলা”, “ঐ কমিটিতে আপনি থাকলে আপনার মানসম্মান থাকবে না”, “নারী যদি প্রকাশ্যে ধুমপান কিংবা চা-পান করে তাহলে তো নারীর সম্মান থাকে না” – এরকম আপাতসুশীল অজুহাতের কোন অভাব নেই প্রবল পুরুষালি মনোবৈকল্যে আক্রান্ত সমাজে। এগুলির সাথে আমরা আজন্ম এতটাই পরিচিত যে এর কোন ব্যতিক্রম হলেই বরং আমাদের – নারী পুরুষ উভয়েরই - অস্বস্তি লাগে।

তো আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে ঘটা করে ঘন্টার পর ঘন্টা বকর বকর করে পালন করা হয় – তার মূল হেতু কী? হেতুর সেতু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বছর বছর লম্বা হয়, কিন্তু তাতে পৃথিবীর সকল নারীর অধিকার ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমাদের বিশাল উপচে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক (৪৯%) নারী। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের স্বাভাবিক ফল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জনগণের সামগ্রিকভাবে বেঁচে থাকার গড় আয়ু বেড়েছে, গড় আয়ও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নারী হবার কারণে তাদের মানবিক নাগরিক রাষ্ট্রিক অধিকারগুলির সূচক থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলাদাভাবে আমাদের নারীগোষ্ঠীর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারীরা পুরুষের সমান বেতন মজুরি পাবার দাবিতে এবং ভোটের অধিকার পাবার দাবিতে একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে এখনকার আমেরিকানরা লজ্জা পাবেন কি না জানি না, তবে সত্য এই – যে আমেরিকা ব্রিটিশদের চেয়ে ভালো সভ্য হবার দাবিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, সংবিধান রচনা করেছে ১৭৮৭ সালে, সংবিধান অনুসারে দেশ চালানো শুরু করেছে ১৭৮৯ সাল থেকে – সেই  স্বাধীন আমেরিকায় ১৪৪ বছর ধরে নারীদের কোন ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। সেখানে নারীর সম্মান ছিল না – সেটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মূল নাগরিক অধিকার – ভোট – সেটা প্রয়োগ করার অধিকার ছিল না। সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী এনে ১৯২০ সালে আমেরিকান নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এর অনেক আগেই পৃথিবীর অনেক দেশের নারীরা ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়েছিল ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ ইওরোপের অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। নারীদিবস পালনের দাবি জোরদার হয় মূলত সোভিয়েত বিপ্লবের সময় সোভিয়েত নারীদের মাধ্যমে। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ রাশিয়ার নারীরা “রুটি ও শান্তি”র দাবিতে জোর আন্দোলন করেছিলেন। ১৯২১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণা করে। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালিত হয়েছে। তবে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে প্রতিবছর নারীর অধিকার উন্নয়নের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করা হয়। এই সূচকগুলিকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির উন্নয়নের সূচকে সংখ্যাগত উন্নয়নের চিহ্ন দেখে আমোদিত হবারও কিছু নেই। কারণ এগুলি সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয় সরকারের তোষামোদকারি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমেই।

তাহলে নারীর অধিকারের উন্নয়ন হয়েছে কি না কীভাবে বুঝবো? আপনি যে দেশে থাকেন, আপনি যদি নারী হন, নিজের অধিকার কেমন আছে আপনার পুরুষ সহ-নাগরিকের তুলনায় – তা দেখেই আপনি বুঝবেন। আপনি যদি পুরুষ হোন, তাহলে আপনি  কোন্‌ দেশের ক্ষেত্রে আপনার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যাসহ নারী আত্মীয়দের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেমন উৎকন্ঠা অনুভব করেন – সেটা দিয়েই আপনি বুঝতে পারবেন সেই দেশের নারীদের কী অবস্থা। আপনার স্ত্রী, আপনার বোন, আপনার কন্যা কী পরে বাইরে বের হচ্ছে – তা নিয়ে যদি তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনার উদ্বেগ- বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশে নারীর অধিকার বলতে কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ নিরাপত্তাহীন অধিকার কেবল মূল্যহীন কথার কথা।

যে দেশে কন্যা-শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় না, যে দেশে নারীর হেনস্তাকারিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, যে দেশে যৌন হেনস্তাকারির বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার আছে – কিন্তু মামলা করার পর মামলাকারিকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় -  সে দেশের নারীর অধিকার উন্নয়নের সূচক যদি বাড়তে বাড়তে হিমালয়েও উঠে যায় – তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সে দেশে কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে বর্ণাঢ্য নারীদিবস পালন অসহায় অপমানিত নারীর মুখে চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। 



No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts