মানব সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সময় সম্পর্কে মানুষ সচেতন
হতে শুরু করেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক হচ্ছে
ততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরভাবে সময় মাপার কলাকৌশল উদ্ভাবিত হচ্ছে। প্রাচীনকালে প্রাকৃতিক
ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করেই চলতো সময় মাপার কাজ – যেমন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত
এক দিন, সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত এক রাত। চাঁদ পর্যবেক্ষণ করে মাসের
হিসেব, ঋতু পরিবর্তন দেখে বছরের হিসেব। তারপর দিনের সময়কে বিভিন্নভাবে ভাগ করে মাপার
জন্য সূর্যের ছায়া ব্যবহার করে উদ্ভাবন করলো সূর্যঘড়ি। পানির প্রবাহের হারের সাথে তুলনা
করে প্রাচীন মিশর, চীন, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহার করা হতো জলঘড়ি। ত্রয়োদশ শতকে উদ্ভাবিত
হয় যান্ত্রিক ঘড়ি। ১৬৫৬ সালে ওলন্দাজ (ডাচ) পদার্থবিজ্ঞানী খ্রিসচিয়ান হাইগেনসের উদ্ভাবিত
পেন্ডুলাম ঘড়ি সময় পরিমাপে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের
সময় থেকে চালু হয় ব্যক্তিগত সময় মাপার জন্য ছোট আকারের পকেট ঘড়ি ও হাতঘড়ি। বিংশ শতাব্দীতে
এসে বিজ্ঞানীরা মনযোগ দেন – সময়ের পরিমাপকে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত করার দিকে। সেই পথ
ধরেই উদ্ভাবিত হয় পারমাণবিক ঘড়ি বা অ্যাটমিক ক্লক।
পারমাণবিক ঘড়ি কাজ করে পরমাণুর স্বাভাবিক দোলনকে কাজে লাগিয়ে।
পারমাণবিক ঘড়ি পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের শক্তি স্তর পরিবর্তনের সময় নির্গত বা শোষিত
মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের কম্পাঙ্ক পরিমাপ করে। এই কম্পাঙ্ক সুনির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়।
পারমাণবিক ঘড়ির আদর্শ পরমাণু হিসেবে ব্যবহৃত হয়
সিজিয়াম পরমাণুর সিজিয়াম-১৩৩ আইসোটোপ। সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুকে কিছুটা উত্তপ্ত
করে গ্যাসে পরিণত করে একটি ধাতব প্রকোষ্ঠে চালনা করা হয়। সেখানে মাইক্রোওয়েভ জেনারেটর
থেকে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভ পাঠানো হয়। মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক পরমাণুর
কম্পাঙ্কের সাথে মিলে গিয়ে পরমাণু শক্তি শোষণ করে এবং উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। পরমাণু
কতটুকু শক্তি শোষণ করলো এবং কতগুলি পরমাণু উচ্চতর শক্তিস্তরে প্রবেশ করলো তা একটি ডিটেক্টর
দ্বারা পরিমাপ করা হয়। মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যেন পরমাণুর কম্পাঙ্ক
এবং মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক মিলে সর্বোচ্চ রেজোন্যান্স বা অনুনাদ পাওয়া যায়। রেজোনেন্স
ফ্রিকোয়েন্সি বা অনুনাদ কম্পাঙ্ক নির্দিষ্ট হবার পর সেই কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার
করে কোয়ার্টজ দোলক চালু করা হয় – যা ঘড়ির দোলক হিসেবে নির্ভুলভাবে কাজ করে।
পারমাণবিক ঘড়ি এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভুলভাবে সময়ের পরিমাপ
করে। এর অনিশ্চয়তার মাত্রা এতই কম যে সিজিয়াম পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের ক্ষেত্রে এক কোটি
বছরে মাত্র এক সেকেন্ড তারতম্য ঘটে।
পরিমাপের যে সাতটি মৌলিক একক আছে তাদের মধ্যে সময়ের একক
‘সেকেন্ড’-এর সর্বশেষ সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে পারমাণবিক ঘড়ির ভিত্তিতে এভাবে: “এক সেকেন্ড
হলো সেই সময়কাল যা্তে সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর গ্রাউন্ড স্টেটের দুটি অতি সূক্ষ্ম মাত্রার
মধ্যে পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বিকিরণের ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০টি (নয় শ উনিশ কোটি ছাব্বিশ
লক্ষ একত্রিশ হাজার সাত শ সত্তর) পূর্ণ দোলন সম্পন্ন হয়।
বর্তমান তথ্যযোগাযোগের যুগে নেটওয়ার্কের সময়ের সমন্বয়, জিপিএসসহ
অত্যন্ত সময়সংবেদী সমস্ত বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক ঘড়ির এত সঠিক মাপেও পুরোপুরি
সন্তুষ্ট নন। পরমাণুর ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের বিকিরণের কম্পাঙ্ক যদি কাজে লাগানো যায়,
তাহলে নিউক্লিয়াসের প্রোটন বা নিউট্রনের শক্তিস্তরের বিকিরণকেও যদি একইভাবে কাজে লাগানো
যায়, তাহলে তো নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা এই ধারণাকেই বাস্তবে রূপ
দেয়ার জন্য কাজ করছেন গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী একেহার্ড পেইক এবং ক্রিসচিয়ান টাম
২০০১ সালে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেছিলেন পারমাণবিক ঘড়ির চেয়েও সঠিকভাবে সময় মাপার সক্ষমতা
সম্পন্ন নিউক্লিয়ার ঘড়ির। তাঁরা আশা করেছিলেন অতিদ্রুত নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব
হবে। প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কিত গবেষণাপত্র তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন ২০০৩ সালে [১]। কিন্তু এরপর বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাজার রকমের
পরীক্ষানিরীক্ষার পর অবশেষে ২০২৪ সালে এসে নিউক্লিয়ার ঘড়ির ধারণা বাস্তবে রূপান্তরিত
হতে যাচ্ছে [২,৩,৪]।
নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করতে গেলে কী ধরনের নিউক্লিয়াস দরকার
তা বোঝার জন্য দেখা যাক নিউক্লিয়ার ঘড়ির কলকব্জা এবং কার্যপদ্ধতি কী। নিউক্লিয়ার ঘড়ির
মূলনীতিও পারমাণবিক ঘড়ির মূলনীতির মতোই। যথোপযুক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে
লেজারের মাধ্যমে উত্তেজিত করার পর উত্তেজিত
শক্তিস্তর থেকে বিকিরণ নির্গত হবে। সেই বিকিরণের পরিমাণ গামা রে ডিটেক্টরের মাধ্যমে
শনাক্ত এবং পরিমাপ করে একই শক্তির কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট একটি কোয়ার্টজ দোলক দোলানো হবে
– যা থেকে ঘড়ির সময় মাপা যাবে।
পারমাণবিক ঘড়ির ক্ষেত্রে সিজিয়াম-১৩৩, রুবিডিয়াম-৮৭, হাইড্রোজেন,
স্ট্রনশিয়াম, ইটারবিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম আয়ন, মারকারি আয়ন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি পরমাণু
অথবা পরমাণুর আইসোটোপ ব্যবহার করে সফলভাবে পারমাণবিক ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু
নিউক্লিয়াসের যে শক্তিস্তর ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা যাবে সেরকম নিউক্লিয়াসের
সংখ্যা খুবই কম। এপর্যন্ত আবিষ্কৃত ১১৮টি মৌলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার আইসোটোপের নিউক্লিয়াসের
মধ্যে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার রকমের উত্তেজিত শক্তিস্তর বিশ্লেষণ করে এখনো পর্যন্ত
মাত্র একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াস পাওয়া গেছে যার উত্তেজিত শক্তিস্তর থেকে নিউক্লিয়ার
ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব [৫]। সেই নিউক্লিয়াসটি হলো থোরিয়াম-২২৯।
![]() |
নিউক্লিয়ার ঘড়ির মূলনীতি |
ক্যালসিয়াম ফ্লোরাইড ক্রিস্টালের মধ্যে থোরিয়াম-২২৯ পরমাণু
যুক্ত করে সেখানে আলট্রাভায়োলেট লাইটের কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার বিম প্রয়োগ
করা হয়। লেজার থেকে শক্তি শোষণের ফলে থোরিয়াম-২২৯
নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। থোরিয়াম-২২৯ নিউক্লিয়াসের
উত্তেজনা আইসোম্যারিক স্টেট তৈরি করে অর্থাৎ উত্তেজিত অবস্থায় এরা কিছুক্ষণ থাকার পর
শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে উত্তেজনা কমায়, অর্থাৎ গ্রাউন্ড স্টেটে ফিরে আসে। নিউক্লিয়াস
থেকে শক্তি নির্গমণ ঘটে গামা রে বিকিরণের মাধ্যমে। একটি গামা রে ডিটেক্টর এই শক্তি
নির্গমনের হার পরিমাপ করে। এই নিউক্লিয়ার গামা রশ্মির শক্তি পারমাণবিক বিকিরণের শক্তির
চেয়ে অনেক বেশি। ফলে তাকে কম্পাঙ্কে পরিণত করলে কম্পাঙ্কের পরিমাণ হয় পারমাণবিক কম্পাঙ্কের
চেয়ে প্রায় দশ হাজার গুণ বেশি। এই কম্পাঙ্কের সাথে অনুরণন ঘটিয়ে যখন একটি কোয়ার্টজকে
দোলানো হয় – তখন সেই দোলন পারমাণবিক দোলকের চেয়ে দশ হাজার গুণ বেশি দোলে। এই দোলনকে
যখন ঘড়ির সময় মাপার কাজে লাগানো হয় – তা স্বাভাবিক ভাবেই পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের চেয়েও
বেশি সঠিক হবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন –
চৌদ্দ শ কোটি বছরেও এক সেকেন্ডেরও তারতম্য ঘটবে না নিউক্লিয়ার ঘড়ির সময়ে।
নিউক্লিয়ার ঘড়ি কী কাজে লাগবে? আমরা যারা সাধারণভাবে যেকোনো
ঘড়িতে সময় দেখে জীবন চালাতে অভ্যস্ত, যাদের কাছে সেকেন্ডের হেরফেরে তেমন কিছু যায় আসে
না, তাদের জন্য নিউক্লিয়ার ঘড়ির অবদান খুব একটা দৃশ্যমান হবে না। কিন্তু নিউক্লিয়ার
ঘড়ি তৈরি সম্ভব হলে, বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক কিছু বিষয়ে খুবই উন্নতি ঘটবে। যেমন স্যাটেলাইট
নেভিগেশন সিস্টেমের অনিশ্চয়তার মাত্রা অনেক কমে যাবে। সাধারণ জিপিএস সিস্টেমে কোনো
বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিন থেকে দশ মিটারের একটা অনিশ্চয়তা থাকে। এই অনিশ্চয়তার
পরিমাণ অনেক কমে যাবে জিপিএস সিস্টেমে নিউক্লিয়ার ঘড়ি ব্যবহার করা গেলে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউক্লিয়ার ঘড়ি বিরাট
ভূমিকা রাখবে। বর্তমান মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানে নিয়োজিত স্যাটেলাইটগুলি পারমাণবিক
ঘড়ির সময়ের সাথে সংযুক্ত। ফলে মহাবিশ্বের তড়িতচৌম্বক ক্ষেত্রের একটা সূক্ষ্ম প্রভাব
পড়ে অতি সূক্ষ্ম মাত্রার হলেও মাঝে মাঝে কিছু
বিচ্যুতি ঘটে সময়ের পরিমাপে। নিয়মিতভাবে তার সংশোধনের দরকার হয়। নিউক্লিয়ার ঘড়ি এসব
থেকে মুক্ত হবে। ফলে ভবিষ্যতের স্যাটেলাইটগুলি হবে আরো অনেক বেশি সুসংবেদী এবং সুচারু।
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইটগুলি। পারমাণবিক ঘড়ির নেটওয়ার্কের সাথে সেগুলি
সংযুক্ত। নিউক্লিয়ার ঘড়ি সেসব ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি সঠিক মাত্রার ভূমিকা রাখতে পারবে।
নিউক্লিয়ার ঘড়ি এখনো তৈরি হয়নি, তবে আশা করা যাচ্ছে ২০২৫
সালের মধ্যে প্রথম নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্র
[১] ইউরোফিজিক্স লেটার, ভল্যুম ৬১, ২০০৩।
[২] ন্যাচার, ভল্যুম ৬৩৬, ১৯/২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, পৃ ৫৪৪-৪৫।
[৩] ন্যাচার, ভল্যুম ৬৩৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, পৃ ৪৩-৪৫।
[৪] ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড, নভেম্বর ২০২৪, পৃ ৩।
[৫] জার্নাল অব ফিজিক্স বি, ভল্যুম ৫২, পেপার ২০৩০০১, ২০১৯।
বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত