ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী




বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম - আমার প্রথম কর্মস্থল। ১৪/১১/১৯৯৩ থেকে ২০/৬/১৯৯৮ পর্যন্ত কাজ করেছি সেখানে। সেই সময়ের টুকটাক কিছু স্মৃতির  রেখাচিত্র - ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী।






"দোস্ত, আলোর প্রতিসরণাঙ্কের সূত্রটা" - আবুল হোসেনের গলায় কিছুটা অস্থিরতা। ফিসফিস করে বললেও নিস্তব্ধ রুমে অনেক জোরে শোনালো তার কথা। আলোর প্রতিসরণাঙ্কের সূত্র আসলে স্নেলের সূত্র। ফিজিক্সের সব ছাত্রই এই সূত্র জানে। কিন্তু পরীক্ষার টেনশানে অনেক সময় জানা ব্যাপারটাও ভুলে যায় মানুষ। আবুল হোসেনেরও তাই হয়েছে।



সাদা দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা "Ask not what your country can do for you - ask what you can do for your country." - কী চমৎকার কথা! আমার দেশ আমার জন্য কী করতে পারে - সে প্রশ্নের চেয়েও জরুরি হলো আমি আমার দেশের জন্য কী করতে পারি। সেই ১৯৬১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবার দিন এই কথাগুলো বলেছিলেন জন এফ কেনেডি। তারপর থেকে এটা সারা পৃথিবীর সব দেশপ্রেমিকেরই মনের কথা হয়ে আছে। ছোলায়মান স্যারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সার্জেন্ট মেসে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করার কথা না বললে এদিকে আসাও হতো না - আর জানাও হতো না যে এমন চমৎকার সব কথা লেখা আছে ঘাঁটির বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে।

"খুব বেশি অইলে দুই ঘন্টা লাইব দে" - চুন লাগানো পানের বোঁটাটা মুখের ভেতর চালান করে দিয়ে খচ খচ করে চিবুতে চিবুতে বললেন সাহেব মিয়া।
বলে কী? মাত্র দু'ঘন্টায় ছরার কুল থেকে চন্দনপুরা চলে যাবে ঠেলাগাড়ি নিয়ে? আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। টেনেটুনে পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা হবেন না সাহেব মিয়া। নামের মধ্যে সাহেব এবং মিয়া দুটোই আছে, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সেঅর্থে তিনি সাহেবও নন, মিয়াও নন। তিনি ঠেলাগাড়ি চালান, এই স মিলে কাঠ আনা-নেওয়া করেন। গত সাড়ে ছয় বছর ধরে তাকে দেখছি। তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি তার - শরীরেও বাড়েনি, অর্থেও না। আজ আমার রুমের সব জিনিসপত্র তিনি চন্দনপুরায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন।


"স্যার, আমার মনে হয় ঠেলাগাড়ির প্রচলিত ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন ঘটানো দরকার।" - বেশ গম্ভীরভাবে বললো আদেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম - তার এ কথায় কোন দ্বৈত অর্থ আছে কি না। ক্লাসে ঠেলাগাড়ির প্রসঙ্গ নিয়ে আসাটা কি ইচ্ছাকৃত? সবাই কি জেনে গেছে আমার ঠেলাগাড়ি টানার ব্যাপারটা? নাকি কাক ডাকিল, তাল পড়িল টাইপের কাকতালীয় ঘটনা?

দু’একটা গোয়েন্দা কাহিনি পড়ার পর অনেক সময় নিজেকে গোয়েন্দা বলে মনে হয়। চিরকূট রহস্য খুব সহজেই সমাধান করে ফেলেছি ভেবে মনে মনে নিজেকে ফেলুদা ভেবে ফেলেছিলাম। কিন্তু ইদ্রিস আমার ভাবনার বেলুন ফুটো করে দিলেন। লেখাটা আয়শা ম্যাডামের নয়। তাহলে বাকি থাকে শুধু একজন – ইভা। কিন্তু সে আমার ক্লাসে পিয়নের মারফত চিরকূট পাঠাবে কেন? এমনিতেই তো তার সাথে প্রতিদিন দেখা হয়, কথা হয়। তবু নিশ্চিত হবার জন্য ইদ্রিসকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে দিয়েছেন ওটা?”



দরজার বেল টিপেছি অনেকক্ষণ হয়ে গেল। দরজা খোলা তো দূরের কথা, ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দও পাচ্ছি না। অপরিচিত কোন বাসার কলিংবেল একবার টেপার পর দরজা না খুললে ঠিক কতক্ষণ পর আবার বেল টিপলে অভদ্রতা হবে না  তা ঠিক জানি না। বুঝতে পারছি না আবার বেল টিপবো, নাকি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবো। সামাজিক ভদ্রতার নিয়মকানুনগুলো আমার কাছে অসহ্য রকমের জটিল বলে মনে হয়। 


“মুখে ঝাঁমা ঘষে দেয়া কাকে বলে জানেন?”
আমি ‘হ্যাঁ’ বলবো কি ‘না’ বলবো বুঝতে না পেরে ইন্টারভিউ বোর্ডে ভ্যাবাচেকা খাওয়া চাকরিপ্রার্থীর মতো ভাবলেশহীন নিরীহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সুচরিত স্যারের দিকে। তাঁর পরনের সাদা-কালো চেকের শার্টটা নতুন। সম্ভবত এবারের ঈদ উপলক্ষে কিনেছেন। তাঁর মাথার চুলের পশ্চাৎগামী ঢেউয়ের স্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। গোঁফ-টানায় ব্যস্ত তাঁর বাম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে আঙটির সংখ্যাও একটি বেড়েছে; তর্জনি আর অনামিকার পাথরগুলোর মাঝখানে মধ্যমাতে এখন একটির জায়গায় দুটি আংটির লাল-সবুজ পাথরের ঘনবসতি।


স্টেশন রোডে হানিফের কাউন্টারে যখন পৌঁছলাম তখন সাতটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। আরো একটু আগে আসতে পারতাম। ছ’টায় বের হয়েছিলাম বাসা থেকে। কিন্তু গলির মুখে আসতেই দেখলাম একপাল ক্ষুদে দেশপ্রেমিক - হাতে আলপিন আর মাইক্রো-সাইজের কাগজের পতাকা হাতে নিয়ে সামনের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই হই হই করে এগিয়ে এল আলপিন উঁচিয়ে। কিছু বলার আগেই একজন দক্ষ ভলিবল প্লেয়ারের মত লাফ দিয়ে খামচে ধরলো আমার শার্ট, এলোমেলোভাবে গেঁথে ফেললো একটি পতাকা আমার বুকপকেটের একটু নিচে – কলজে বরাবর।

আকাশী রঙের বৃত্তের মাঝখানে একটি ত্রিভুজ। ত্রিভুজের ভূমিতে শৃঙ্খলা, আর দুই বাহুতে শিক্ষা ও সংযম। শিক্ষা ও সংযমের মাঝখানে ডানা মেলে আছে সূর্য আর বই। নান্দনিক এই মনোগ্রামের ডিজাইন কে করেছিলেন জানি না। স্বাভাবিক কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম সাঈদ স্যারকে। কলেজের নাড়িনক্ষত্র সব জানেন সাঈদ স্যার। মনোগ্রামের ডিজাইন কে করেছিলেন তাও নিশ্চয় জানা আছে তাঁর। আমার প্রশ্ন শুনে স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বললেন, “এই তথ্য কোন্‌ কাজে লাগবে?”

“আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।“
কর্ণফুলির মাঝখানে এসে প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকাটা দুলে উঠতেই সুচরিত স্যার আমাকে জাপটে ধরে বিড়বিড় করতে শুরু করেছেন “আমি সাঁতার জানি না। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।“
দেখলাম তাঁর সারা শরীর কাঁপছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি অভয় দেবার চেষ্টা করলাম, “ভয় পাবার কারণ নেই। এরকম ঢেউয়ে কিচ্ছু হবে না।“

অনেকদিন টানা বৃষ্টির পর আজ রোদের দেখা পেলাম, কিন্তু কোন রিকশা পেলাম না। বের হতে দেরি করিনি। হাতে সময় আছে হেঁটে যাবার, তাই খুব একটা বিচলিত হলাম না। গলির মুখে প্রতিদিন এই সময় একটা রিকশা থাকে। লিকলিকে এক তরুণ রিকশাওয়ালা উদাসভাবে রিকশার সিটের উপর বসে থাকে। তার সাথে কোন চুক্তি হয়নি, বা নিয়মিত তার রিকশায় যাবো বলেও কথা হয়নি। কিন্তু সে থাকে। হয়তো খেয়াল করেছে – আমি প্রতিদিন সকালে বের হই। 



“প্রদীপের খবর আছে আজকে।“ – অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাসের খাতায় সাইন করতে করতে সাঈদ স্যার বললেন। আমার আজ তিনটি পিরিয়ড অফ ছিল। সবগুলো পিরিয়ডেই অ্যাডজাস্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। সাঈদ স্যার আমার অবস্থা দেখে সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন ভেবে বললাম, “জ্বি স্যার, আজ আমার অবস্থা বারোটা বেজে যাবে। একটা পিরিয়ডও অফ নেই।“
“আমি সেটার কথা বলছি না। তুমি যে ভাই সবুজ কালি দিয়ে সাইন করেছো।“

শুনেছি স্নেহ জিনিসটা খুব একটা ভালো জিনিস নয়। এই জিনিসটি বেশি হয়ে গেলে হাজারো ঝামেলা তৈরি করে। শরীরে স্নেহ-পদার্থ বেশি হলে সমস্যার শেষ থাকে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মধ্যপ্রদেশে। সেটা তখন স্ফীত হতে থাকে। বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি ছোলাইমান স্যারের মধ্যপ্রদেশ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। মহাবিশ্বের স্ফীতির

হাহা করে হাসতে পারলে নাকি শরীরের রোগ-ব্যাধি দূর হয়ে যায়। ডিসি হিল পার্কে অনেককে দেখা যায় হাহা করে হাসতে হাসতে রোগ-ব্যাধি দূর করছেন। পার্কে ব্যায়াম করতে করতে হাসা আর সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য। রঞ্জনের হাসির শব্দ এতটাই প্রচন্ড আর কর্কশ যে আশেপাশের মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমি পাভেলের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে

“কী সুন্দর মুরগি দেখেছিস! আল্লা কী সুন্দর!”
দরজা খুলে এদেরকে দেখে যতটা অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি এদের আচরণ দেখে। পশুপাখি দেখে মুগ্ধ হতে অনেককে দেখেছি, কিন্তু মুরগি দেখে এত আহ্লাদ করতে আর কাউকে দেখিনি। এই মেয়ে কি ফার্মের মুরগি দেখেনি কখনো? সে হাত বাড়িয়ে মুরগি ধরতে যাচ্ছে দেখে আরেকজন তাকে সাবধান করলো, “এই দ্যাখিস, কামড়ে দেবে।“

“ইস্‌ দুইটা ব্যাজে গেচে। আচকে বাছে ভির হবে।“
ছোলাইমান স্যার তাঁর কবজির সোনালী ঘড়িটার ডায়াল থেকে অদৃশ্য ধূলি ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে বললেন। কলেজের গেটের কাছে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ থেকে। এক বছর ধরে বিমান বাহিনীর এই বাসে আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি ছোলাইমান স্যারের কথা ঠিক। তাঁর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর পাশে

“প্রদীপ, তোমারে আমি খুচতেছি একটা কতা বলার জইন্য – “
টিচার্স রুমে ঢুকে আমার সামনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন নাসির স্যার।
“আরে বস বস। দারাইতে হবে না।” – হাসিমুখে বললেন তিনি। ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে টিচার্স রুম থেকে পাশের ছোট্ট অফিসে চলে যাওয়ার পর নাসির স্যার আমাদের টিচার্স রুমে খুব একটা আসেন না। অবশ্য ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়ার আগেও তাঁকে বেশিক্ষণ টিচার্স রুমে





আয়েশা ৬৪ টাকা দিয়ে ৮টি পেন্সিল কিনল। ২৪টি পেন্সিল কেনার জন্য সে দোকানদারকে একটি ৫০০ টাকার নোট দিলো। দোকানদার তাকে কত টাকা ফেরত দেবে? এটা কে কে – “

জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম এটা কে কে করতে পারবে না? কিন্তু আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই দেখলাম ক্রিকেট খেলার আম্পায়ার আউট দেবার সময় যেভাবে হাত তোলেন


পর্ব ৩৬

এজুকেশান ইজ দ্য ব্যাকবোন অব দ্য ন্যাশান। এটাকে বেঙ্গলিতে আপনারা কী বলেন?”

স্বাভাবিক অবস্থায় ক্লাস থ্রি-ফোরের ছেলেমেয়েরাও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এখন আমাদের কারোরই স্বাভাবিক অবস্থা নয়। আমাদের বলতে এখানে – প্রিন্সিপাল স্যার থেকে শুরু করে আমরা সবাই। সকাল ন’টা থেকে ঘাঁটির প্রশাসনিক কর্মধ্যক্ষ শিক্ষকদের সাথে মিটিং-এর কথা বলে ক্লাস নিচ্ছেন। উচ্চ-মাধ্যমিক


পর্ব ৩৭

“ডিবেইটিং ইজ অ্যান আর্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি।“

লাইনটা পড়েই অনেকটা আঁৎকে উঠলাম। বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার শৈল্পিক রূপই বিতর্ক? এই যে দিনরাত এত এত বইপত্র পড়ে রেফারেন্স ঘেঁটে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে, বিরতিহীন অনুশীলন করে করে আমাদের ছেলেমেয়েরা যে টেলিভিশন জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছে দেশের সবচেয়ে নামী স্কুলগুলির বিতার্কিকদের হারিয়ে – এর সবকিছুই বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা? একমত হতে পারছি না লেখকের সাথে।


পর্ব ৩৮

ট্রাই নট টু বিকাম এ ম্যান অব সাকসেস। রাদার বিকাম এ ম্যান অব ভ্যালু - আলবার্ট আইনস্টাইন এই কথাগুলো কখন কাকে কী কারণে বলেছিলেন জানি না। এটুকু জানি যে তিনি এই কথাগুলি বলেছিলেন। এই কথাগুলির প্রথম লাইনটি আমার খুবই পছন্দ। কারণ সাফল্যের ব্যাপারে আমার অবস্থা আঙুর ফল টক জাতীয়। আইনস্টাইনকে যে আমি কতভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছি তার কোন হিসেব নেই।


পর্ব ৩৯

বাঙালি মধ্যবিত্তের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম টেলিভিশন। টেলিভিশনের সাপ্তাহিক নাটক না দেখে বাঙালি রাতের ভাত খায় না। গ্রিক শব্দ টেলে যার অর্থ দূর এবং ল্যাটিন শব্দ ভিজিও  যার অর্থ দেখা  এই দুই মিলে উৎপত্তি হয়েছে টেলিভিশন  যার অর্থ দূরদর্শন। তবে আমরা বাংলাদেশে টেলিভিশনকে টেলিভিশন রূপেই চিনি। আমাদের দেশে এখন টেলিভিশন আভিজাত্যের প্রতীক। যাদের বাড়িতে যত বড় টেলিভিশন থাকে  আমরা তাদেরকে ততই বড়লোক মনে করি। 


পর্ব ৪০

দাদা, আপনি কি এই প্যাকেটটাও খাবেন?

“না।“

“তাহলে আমি খেয়ে ফেলছি“ – বলেই রঞ্জন টেবিলের উপর থেকে প্যাকেটটা নিয়ে দ্রুত খেতে শুরু করলো। এত দ্রুত কীভাবে খায় সে? আমার প্যাকেটটা খুলতে না খুলতেই তার প্যাকেটটা শেষ করে এখন এক্সট্রা প্যাকেটটায় হাত দিয়েছে। দেখলাম আস্ত সিদ্ধ ডিম নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। খেতে খেতে কথা বলছে সে। গত তিন ঘন্টা ধরে সে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে মহাবিশ্বে শুধুমাত্র চারটি মৌলিক বল নয়, আরো অনেক মৌলিক বল আছে। 


পর্ব ৪১

রাতের রেলগাড়ি

দিল পাড়ি

কামরায় গাড়িভরা ঘুম,

রজনী নিঝুম।

অনেকক্ষণ থেকেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এই ক’টা লাইন। দু’লাইনে চলা আস্ত রেলগাড়ির একটা কম্পার্টমেন্টের পুরো দৃশ্য বর্ণনা করে ফেলেছেন মাত্র দু’লাইনে।


পর্ব ৪২

‘গাড়িবারান্দা’ শব্দটি নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রায়ই দেখা যায়। বড়লোকদের বাড়ির গাড়িবারান্দায় গাড়ি এসে থামে। তারপর নায়ক কিংবা নায়িকা গাড়ি থেকে অভিজাত কায়দায় নামে। অনেক সময় দেখা যায় নায়িকা ধনী হলে নায়ক হয় হতদরিদ্র, অথবা ধনী নায়কের দরিদ্র নায়িকা ইত্যাদি। এসব গল্প পড়ার সময় গাড়িবারান্দার যে চিত্র মাথার ভেতর ফুটে উঠে – তার সাথে এখন যে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি তার কোন মিল নেই।


পর্ব ৪৩

When you sit with a pretty girl for two hours you think its only a minute, but when you sit on a hot stove for a minute you think its two hours. Thats relativity.

আলবার্ট আইনস্টাইন যখন থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কার করছিলেন, তখন একবারও কি ভেবেছিলেন যে একদিন তাঁর তত্ত্বের এরকম তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিতে হবে? 


পর্ব ৪৪

অ্যাই অঞ্জন্দা, এখানে বাঁশখাইল্যার সংখ্যা যে বেড়ে যাচ্ছে তা কি আপনি খেয়াল করছেন?” – সাঈদ স্যার তাঁর সামনে রাখা সিঙাড়ার প্লেটটা টেনে নিতে নিতে হাসিমুখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন অঞ্জন স্যারের দিকে।

অঞ্জন স্যার একটু আগেই নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ‘এই নিয়তি, চা ঠান্ডা কেন’ বলে নিয়তিদিকে একটি ছোটখাট ধমক দিয়েছেন। নিয়তিদি মিনমিন করে কী


পর্ব ৪৫

বাস ড্রাইডক পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে ঘাঁটির গেটের সামনে এসে থামলো। বাসের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালাম এক লাফে বাস থেকে নেমে গার্ডরুমের ছোট্ট দরজা দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সাধারণত সে দৌড়ে গিয়ে গেটম্যানকে গেট খুলতে বলে দৌড়ে চলে আসে। কিন্তু আজ অনেক দেরি করছে। গেটও খুলছে না। সামনের সিটে বসা বিমল স্যার বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী রে, কী হইল?”


পর্ব ৪৬

আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট নিয়েছিলেন ১৮৭৬ সালে। তারপর ১২০ বছর কেটে গেছে। শুনেছি উন্নত দেশের ঘরে ঘরে আজ টেলিফোন। অথচ আমাদের দেশে এই টেলিফোন এখনো আভিজাত্যের প্রতীক। এটা এতই অভিজাত যে এর জন্য টিএন্ডটি নামে খুব পাওয়ারফুল একটি সরকারি বিভাগ আছে। নতুন টেলিফোন সংযোগ পাবার জন্য নাকি এই প্রতিষ্ঠানে অনেক দেনদরবার করতে হয়। 


পর্ব ৪৭

“ইঁয়ান কন্‌অ পিকনিক অইয়ে নে বদ্দা? ইশকুলর পিছন্দি চুলা বানাই রান্ধি খঅন-“ – কৃষি-কাশেম স্যারের  কথা শেষ হবার আগেই সাঈদ স্যার বললেন, “পিকনিক ন অয়?”

সাঈদ স্যার মাঝে মাঝে যখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি দুটি বাক্য বলতে চেষ্টা করেন – খুব মজা লাগে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শ্রুতিমাধুর্য খুব কম। কিন্তু চট্টগ্রামের বাইরের কেউ যখন শখ করে এই ভাষায় একটা দুটো শব্দ উচ্চারণ করে তখন শব্দগুলি কেমন যেন বদলে যায়; অনেক নরম এবং মিষ্টি হয়ে যায়।


পর্ব ৪৮

সকাল দশটা থেকে পরীক্ষা। বলা হয়েছিল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যেতে। আমি ন’টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছি নেভি কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিসে। এইচএসসি পরীক্ষায় ডিউটি করার জন্য পালাক্রমে আমাদের কলেজ থেকে কয়েকজনকে এই কলেজে আসতে হচ্ছে, আবার এই কলেজ থেকে কয়েকজন আমাদের কলেজে যাচ্ছেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল আমাকে বসতে বলে পরীক্ষার খাতা গণনায় মন দিলেন। 


পর্ব ৪৯

“দাদা, এটা কোন্‌ জায়গা?”

বাসের মাঝখানের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে একটু ঝুঁকে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন শংকর স্যার। আমি যথাসম্ভব সিরিয়াসভঙ্গিতে বললাম, “হু কুইন্‌’স হ্যাট।”

“কী?” – শংকর স্যার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।

“এই জায়গার নাম হু কুইন’স হ্যাট” – একটুও না হেসে আমি আবার বললাম।


পর্ব ৫০

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি পল ডিরাক ঠিক কথাই বলেছেন – কবিতার কাজ হলো সহজ জিনিসকে জটিল ভাবে প্রকাশ করা, আর বিজ্ঞানের কাজ হলো জটিল জিনিসকে সহজ করা। পঠিত বিজ্ঞানের কিছু কিছু ব্যাপার আমি চেষ্টা করলে বুঝতে পারি, কিন্তু কবিতার মতিগতি আমি ঠিক বুঝি না। সে আমার কাছে চিররহস্যময়ী। পদে পংক্তিতে সে যতটুকু ভাব ব্যক্ত করে, অব্যক্ত রেখে দেয় তার চেয়ে বেশি। 


2 comments:

  1. অসাধারণ লেখনী স্যার। আমিও শাহীন কলেজ চট্রগ্রামের একজন প্রাক্তন ছাত্র। আফসোস হয়, আপনার ক্লাসগুলো যদি পেতাম। ভাল থাকবেন স্যার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আহসান।

      Delete

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts