ভূমিকা
প্রাকৃতিক
বিজ্ঞান তথা পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার সূত্রপাত হয়েছে মানব সভ্যতার একদম
শুরু থেকেই এবং তা হয়েছে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। সে হিসেবে
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। কিন্তু বিজ্ঞান
গবেষণার সাথে এই উপমহাদেশের সংযোগ ঘটেছে মাত্র দু’শ বছর আগে।
ইংরেজ শাসকেরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার উদ্দেশ্যে বিলেত থেকে
প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ নিয়ে এসে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করেছিল আঠারো শতকের
শেষের দিকে। কিন্তু সত্যিকারের কোন বিজ্ঞান-শিক্ষার সূত্রপাত হয়নি। নিজেদের
স্বার্থেই ইংরেজরা প্রতিষ্ঠা করেছিল রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেনস, মানমন্দির, সার্ভে
স্কুল, ট্রিগনোমেট্রিক্যাল সার্ভে, এশিয়াটিক সোসাইটি। জর্জ এভারেস্ট এসে জরিপ কাজে
নেতৃত্ব দিলেন ঠিকই - কিন্তু মূল কাজটা যিনি করেছিলেন - হিন্দু কলেজের উজ্জ্বল
ছাত্র রাধানাথ শিকদার - তাঁকে কোন ধরনের কৃতিত্বের ভাগ না দিয়ে নিজের নামেই চালিয়ে
দিলেন সবকিছু। এরকম বঞ্চনার ইতিহাস অনেক লম্বা। তারপরেও ছিঁটেফোঁটা সুযোগকে কাজে
লাগিয়ে সংগ্রাম ও সাধনায় বিজ্ঞানের জগতে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন উপমহাদেশের
বিজ্ঞানীরা।
ঊনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিংশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত উপমহাদেশের পদার্থবিজ্ঞানে অনেকগুলো নতুন মাইলফলক স্থাপিত
হয়েছে। যাঁদের মেধা, পরিশ্রম ও অক্লান্ত সাধনায় আবিষ্কৃত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের
অনেক নতুন তত্ত্ব, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নতি হয়েছে
প্রযুক্তির, অর্জিত হয়েছে নোবেল পুরষ্কার- তাঁদের মধ্য থেকে এগারজন
পদার্থবিজ্ঞানীর জীবন-সংগ্রাম ও বিজ্ঞান-সাধনার কথা সহজভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা
করেছি এই বইতে।
উপমহাদেশের প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী
জগদীশচন্দ্র বসু বেতার-তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন মার্কনিরও অনেক
আগে এবং ১৮৯৫ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন।
পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে
গবেষণার সূত্রপাত করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু।
মহাজাগতিক রশ্মি, পারমাণবিক ও
নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার গবেষণায় অসীম অবদান রেখেছেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু।
তিনিই প্রথম ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতিতে ‘মেসন’ এর ভর নির্ণয়
করেছিলেন। তাঁর পদ্ধতি অনুরসণ করে মেসনের ভর নির্ণয়ের জন্য ১৯৫০ সালে
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল।
‘রামন ইফেক্ট’
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক আশ্চর্য মাইলফলক হয়ে আছে ১৯২৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে
- যেদিন এই আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। রামন-প্রভাব আবিষ্কারের জন্য
সি ভি রামন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩০ সালে। শুধু ভারতীয়
উপমহাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই হলেন বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী।
ভারতীয় উপমহাদেশে বেতার যোগাযোগ
সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে
- তিনিও আরেকজন বাঙালী পদার্থবিজ্ঞানী - ডক্টর শিশির কুমার মিত্র। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সূচনা করেন তিনি। তিনিই উপমহাদেশের
প্রথম বেতার সম্প্রচার চালু করেন - কলকাতা থেকে তাঁর ‘রেডিও
টু-সি-জেড’ কেন্দ্রের মাধ্যমে। বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের বিভিন্ন
স্তরের অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ প্রথম তাঁর হাত দিয়েই ঘটেছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে শুধু নয় - সমগ্র
বিজ্ঞানের জগতে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে ক’জন মানুষের
মৌলিক তত্ত্বের ওপর - অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম। ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার
তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল
পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ
দ্বারা প্রভাবিত। মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। উপমহাদেশে
নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাত দিয়ে। মেঘনাদ সাহা নিরলস
চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘বোস-আইনস্টাইন
সংখ্যায়ন’ ও বোসন কণার জন্য বিখ্যাত। তাঁর ‘বসু-আইনস্টাইন
ঘনীভবন’ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০০১ সালে নোবেল পুরষ্কার
পেয়েছেন কলরাডো ইউনিভার্সিটির এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যান এবং এম-আই-টি’র ভলফ্গ্যাং
কেটেরি। বসু তাঁর বিখ্যাত গবেষণাগুলো করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার
সময়।
রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের সাথে রামনের
পাশাপাশি অন্য যে মানুষের মেধা ও পরিশ্রম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল তিনি স্যার কে এস
কৃষ্ণান। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের এমন অনেক শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছেন যে তাঁর পরিচয়
হয়ে ওঠে একজন ‘পরিপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানী’ হিসেবে। ১৯২৮
সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিয়ে ক্রিস্টাল ম্যাগনেটিজম বিষয়ে গবেষণায় নতুন
দিগন্তের সূচনা করেন কৃষ্ণান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত সুযোগের মধ্যে বসে
পরবর্তী পাঁচ বছরে এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন কৃষ্ণান। বিভিন্ন বিষয়ে কৃষ্ণানের
গবেষণাগুলো ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখাকে আজ আমরা ‘কনডেন্সড
ম্যাটার ফিজিক্স’ হিসেবে জানি তার পরিপূর্ণ বিকাশের অনেক আগেই কৃষ্ণান এ
বিষয়ের অনেক গবেষণা করে রেখেছেন।
ব্রিটিশ শাসনের
অবসানের সাথে সাথে স্বাধীন ভারতকে বৈজ্ঞানিক দক্ষতায় গড়ে তোলার জন্য দিনরাত
প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন যে বিজ্ঞানী তাঁর নাম হোমি ভাবা। নিউক্লিয়ার
পদার্থবিজ্ঞানে ‘ইলেকট্রন-পজিট্রন’
স্ক্যাটারিং-এর পরিমাণ হিসেব করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা ‘ভাবা
স্ক্যাটারিং তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ভারতের পারমাণবিক শক্তির বিকাশ ঘটে হোমি
ভাবার হাত ধরে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ভাবা অ্যাটমিক
রিসার্চ সেন্টার’ বর্তমানে বিশ্বের একটি প্রথম শ্রেণির পারমাণবিক গবেষণা
প্রতিষ্ঠান।
১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নাসা’র সংবাদ
সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় এক্স-রে অবজারভেটরির নাম রাখা হয়েছে সুব্রাহ্মনিয়ান
চন্দ্রশেখরের নামানুসারে ‘চন্দ্র’। আইনস্টাইনের
পর চন্দ্রশেখরই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মহাবিশ্ব নিয়ে এত দীর্ঘসময় ধরে এবং এত
গভীরভাবে ভেবেছেন। শুধু তাই নয় মহাবিশ্বকে বুঝেছিলেন আইনস্টাইনের চেয়েও সঠিকভাবে,
কারণ আইনস্টাইন ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। আর চন্দ্রশেখর ব্ল্যাকহোলের
অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। নভোপদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র
সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৮৩ সালে।
নক্ষত্রের ভরের সীমা সংক্রান্ত যে গবেষণার জন্য চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পান সেই
গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল ভারতে - চন্দ্রশেখরের বয়স তখন মাত্র উনিশ বছর।
ভারতে মহাকাশ গবেষণা ও রকেট
প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই'র অক্লান্ত
প্রচেষ্টায় এবং সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায়। আজকের ভারত টেলিযোগাযোগে যে এত
উন্নতি করেছে, টেলিভিশন সম্প্রচারে পরিমাণগত দিক থেকে বিশ্বের প্রথম দিকে স্থান
করে নিয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পূর্ব-সতর্কীকরণ সহ চব্বিশ ঘন্টা প্রকৃতির ওপর
নজর রাখছে - ষাটের দশকের শুরুতেও এসব কিছুই ছিল না। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সেদিন যেসব
সুবিধে ছিল তা ভারতের মত স্বল্প-আয়ের দেশে প্রয়োগ করার চিন্তাও ছিল অসম্ভব। কিন্তু
মাত্র এক দশকের মধ্যেই যিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন তিনি বিজ্ঞানী বিক্রম
সারাভাই।
বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্রথম
মুসলমান বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তাঁর সত্যিকারের
বিচরণ শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সাল থেকে যখন তিনি লাহোর থেকে কেমব্রিজে পড়তে যান। দুর্বল
নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের সমন্বয় সাধন করার জন্য ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার
পান তিনি। তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা দেয়ার জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন
আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানের
গবেষণায় গতিসঞ্চার করার জন্য অনেক সহযোগিতা করেছেন আবদুস সালাম।
এই বইতে যাঁদের কথা বলা হয়েছে তাঁদের
সবারই জন্ম, পড়াশোনা, গবেষণা ভারতীয় উপমহাদেশে- বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানে।
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা এঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করছি। তাঁদের জীবন ও কাজের
কথা অনেক বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর কাছেই হয়তো অজানা। নতুন প্রজন্মের পাঠক যদি এঁদের
জীবন ও বিজ্ঞান সাধনা থেকে কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা পায় তবে মনে করবো এই বইয়ের
উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল শুদ্ধস্বর
থেকে ২০১৪ সালে। বন্ধু অজিত পোদ্দারের উৎসাহে এবং মীরা প্রকাশনীর মো: হারুন অর রশীদ সাহেবের উদ্যোগে এবার
বইটির পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ
প্রকাশিত হলো। অধ্যাপক শ্রাবণী পাল বইটির
পান্ডুলিপি নিরীক্ষণ করে দিয়েছেন। এঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
জুন
২০১৬ প্রদীপ দেব
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া pradipdeb2006@gmail.com
সূচিপত্র
No comments:
Post a Comment